ডিএনসিসির দুর্নীতির ‘কেঁচো’ খুঁজবে দুদকের টাস্কফোর্স

অক্টোবর ১৬, ২০১৫

09ঢাকা: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ২০১২-২০১৪ অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নবগঠিত টাস্কফোর্স। এসব দুর্নীতির মধ্যে ডিএনসিসর বিভিন্ন ব্যায়ের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম না মানা, বিল-ভাউচারে ব্যাপক গরমিল, বিধিবিধান ও বাস্তবতাবিবর্জিত চুক্তি বাস্তবায়ন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একচেটিয়া সুবিধা দেয়ার কথা বলা আছে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর আসা এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এ জন্য দুদকের টাস্কফোর্স টিম ‘এ’র কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম ও সহকারী পরিচালক দেবব্রত মণ্ডলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা আগামী সপ্তাহ থেকে এই বিপুল পরিমান দুর্নীতি অনুসন্ধানে নেমে পড়বেন বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

২০১২-১৪ অর্থবছরের ডিএনসিসিতে পাঠানো অডিট বিভাগের আপত্তিপত্রের বরাত দিয়ে দুদকে আসা ওই অভিযোগে বলা আছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল সংলগ্ন ডিএনসিসির ৭০০ কোটি মূল্যের সাত বিঘা জমি একটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে মাত্র ৩০ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে। অথচ এ এলাকায় জমির ডেভেলপার চুক্তিতে মালিকপক্ষ ৬০ ভাগ এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ৪০ ভাগ শেয়ার পেয়ে থাকে। জমির মালিককে কাঠাপ্রতি প্রায় কোটি টাকা সাইনিং মানি দেয়া হয় এবং প্রতি কাঠা বাণিজ্যিক জমির বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এমন সাত বিঘা বা ১৪০ কাঠা জমি একটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে মাত্র ৩০ ভাগ শেয়ার মূল্যের বিনিময়ে এবং সাইনিং মানি পাওয়ার কথা থাকলেও তা পায়নি ডিএনসিসি। যার ফলে এই এ প্রকল্পে ডিএনসিসির ক্ষতি হয়েছে ৫৬০ কোটি টাকা।

তাছাড়া ২০০৭ সালে চুক্তিকৃত এই প্রকল্প পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ তলা-বিশিষ্ট মার্কেট করে ডিএনসিসিকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও, এখনও সেখানে কোনো কাজই শুরু হয়নি। চুক্তি ভঙ্গের দায়ে প্রকল্পটি বাতিল হওয়ার কথা থাকলেও রহস্যজনক কারণে চুক্তি বহাল রয়েছে।

একইভাবে টেন্ডার ছাড়াই নামমাত্র মূল্যে গুলশান-২ এলাকার ডিএনসিসির দুই বিঘা পাঁচ কাঠা জমি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ারের বিনিময়ে। ওই এলাকায় প্রতি কাঠা জমির দাম প্রায় ২০ কোটি টাকা এবং ন্যূনতম ২ কোটি টাকা করে সাইনিং মানি দেয়া হয়। কিন্তু ৩৫ শতাংশ শেয়ার কম দেয়ার কারণে ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৬ কাঠা জমি বা ৩২০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে সাইনিং মানি বাবদ ৩২ কোটি টাকার ক্ষতিসহ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৫২ কোটি টাকা। তবে এ জায়গায় ১৫ তলা ভবন গড়ে তুলেছে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান। আগামী জানুয়ারির আগেই ওই ভবনের ২৫ ভাগ অংশে ডিএনসিসির অস্থায়ী কার্যালয় করার ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র আনিসুল হক।

রায়ের বাজারের কাঁচাবাজারে ডিএনসিসির জমির পরিমান চার বিঘা বা ৮০ কাঠা।  বাজারমূল্য অনুযায়ী, ওই এলাকার প্রতি কাঠা জমির দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা এবং ন্যূনতম কাঠাপ্রতি কোটি টাকা সাইনিং মানি দিতে ডেভেলপের কোম্পানিকে। আগের জালিয়াতির মতই ৩৫ ভাগ (২৮ কাঠা) শেয়ার কমে কাজটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সাইনিং মানি না নেয়ায় ডিএনসিসির ক্ষতি হয়েছে ৮০ কোটি টাকা এবং শেয়ার কমে চুক্তি হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে ডিএনসিসির ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৪৩০ কোটি টাকা।

২০০৭ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ বছরের মধ্যে ওই জায়গায় ২০ তলা ভবন নির্মাণ করার কথা থাকলেও কাজই শুরু করেনি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। একদিকে আর্থিক ক্ষতি ও অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি করায় সিটি করপোরেশনের সামগ্রিক ক্ষতির পরিমান বাড়ছে।

অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, পিপিআর বিধিমালা লঙ্ঘন করে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার একক কাজ একাধিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ২২৮ কোটি টাকার কোনো বিল-ভাউচার নেই। এছাড়া ঢাকা মহানগরীর মিরপুর এলাকায় সড়ক সংস্কার কাজে রেডি মিক্স কংক্রিট ঢালাইয়ে নকশা ও মূল প্রাক্কলন অপেক্ষা চূড়ান্ত বিলে কাজের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বড় ধরনের গরমিল করে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় ডিএনসিসির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ টাকা। একাধিক কাজের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দেয়ায় ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৭ টাকা। গাবতলী, মহাখালী ও আমিনবাজার বাসটার্মিনালের দরপত্র আহ্বান না করে নিজেদের মনোনীত এজেন্ট নিয়োগ, সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দিয়ে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান, খননকৃত রাস্তা থেকে বালির মূল্য বাদ না দিয়ে মাটির মূল্য বাদ দেয়া, ক্রয় বিধিমালা অনুসরণ না করে গাড়ি ক্রয় করা, ডিএনসিসির অনুমতি ছাড়াই ট্রাকস্ট্যান্ড স্থাপন করা। এসব মিলে ডিএনসিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার।

অডিট বিভাগের আপত্তিকৃত এসব প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই সম্পন্ন হয়েছে ডিএনসিসির বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হকের সময়ে। কিছু প্রকল্পের কাজ অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময়ে হলেও তার চূড়ান্ত কার্যাদেশও দিয়েছেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হক। এমনটাই অভিযোগে বলা আছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান এম বদিউজ্জামান  বলেন, ‘ডিএনসিসির এ রকম অভিযোগের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে অভিযোগে কি কি আছে তা এখন বলা যাচ্ছে না। অনুসন্ধানে শেষে কি হয়, সে অনুযায়ী পরে মন্তব্য করা হবে।’

দুদকের অনুসন্ধান বিভাগের কমিশনার ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি ওই সময়ে দেশের বাইরে ছিলাম। কয়েকদিন আগে দেশে ফিরে এসেছি। তাই কোন ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা বলতে পারছি না।’
 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.