নেপালে ভারতের ‘অবরোধের রাজনীতি’

অক্টোবর ১০, ২০১৫

খাদ্য, 12ভোগ্যপণ্য এবং শতভাগ জ্বালানী আমদানির জন্য ভারতের ওপর প্রায় পুরোটাই নির্ভরশীল ভূমিবিধৌত নেপাল। তবে তিন সপ্তাহ ধরে নেপালে ভারতের ‘অঘোষিত অবরোধ’ দেশটিকে এরইমধ্যে নানা সঙ্কটে ফেলেছে। অচল হয়ে পড়েছে দেশটির ৩ কোটি মানুষের জীবনধারা। আর এ পরিস্থিতি সামনে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার বিশ্লেষণে। আল জাজিরার জন্য এই বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন তাদের প্রতিবেদক থমাস বেল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নেপালের ওপর রিপোর্টিং করছেন তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নেপালের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়নি বলে দাবি করে আসছে ভারত। কিন্তু নেপালি ট্যাঙ্কারকে সেবা দিতে ভারতীয় তেল কর্পোরেশনের অস্বীকৃতি আর সীমান্ত ইস্যুতে কর্মকর্তাদের অকপট মন্তব্যের মধ্য দিয়ে অবরোধ আরোপের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

যখন থেকে সঙ্কটের শুরু
গেল আগস্টে দেশের নতুন সংবিধানের বিরোধিতা করে নেপালের দক্ষিণাঞ্চলে ভারত সীমান্তের কাছে বসবাসরত মাধেসি জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সঙ্কটের সূত্রপাত। সেসময় থেকে প্রস্তাবিত নতুন প্রাদেশিক সীমান্তের বিরোধিতা করে আসছে তারা। আর নেপালের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই মাধেসি জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের অভিযোগ, জাতীয় পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্বকে সীমিত করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আলাপ না করেই সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয়েছে উল্লেখ করেও ক্ষোভ জানায় তারা। বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৪৫ জন নিহত হয়। এমন অবস্থায় নেপালের দক্ষিণাঞ্চলে ডাকা ধর্মঘট ৫০ দিন পেরিয়ে গেছে। প্রায় দুমাস ধরে অচলাবস্থায় রয়েছে দেশটির বেশিরভাগ এলাকা।
ছবি: এএফপি

নেপালের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ রাজের সময় থেকেই নেপালি রাজনীতির ওপর ভারতের একটি প্রভাবশালী ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির ১০ বছরের শান্তি প্রক্রিয়াকে নির্দেশনা এবং নিশ্চয়তা দেয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

এই সময়গুলোতে ভারতের তরফে বারবার বলা হতো নেপালের সংবিধানে সেখানকার সব জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে চান তারা। তবে ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণের পর এই আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে কথা বলার পরিমাণ কমতে থাকে। পাশাপাশি আগের মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট থেকেও সরে যায় দিল্লি। তবে নেপালের সঙ্গে ১শ কোটি ডলার মূল্যের সহায়তা চুক্তি করে মোদি সরকার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নয়াদিল্লির সংকেত খুব অস্পষ্ট। খোদ কাঠমুন্ডুর রাজনৈতিক শ্রেণি মনে করে তাদের নতুন সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভালোভাবে নেয়নি মোদি সরকার। তারা মনে করেন, এমনটা না করে জলবিদ্যুতের মত বাণিজ্যিক স্বার্থ বিনিময়ের মধ্য দিয়ে মাধেসিদের জন্য একটি খসড়া চুক্তি গ্রহণ করতে পারে ভারত।

সীমান্তজুড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মাধেসি জনগোষ্ঠীর মানুষের দৃঢ় সংশ্লিষ্টতা রয়েছে উল্লেখ করে আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়, এর মানে হল নেপালের অস্থিরতার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নিরাপত্তার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। একইসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। আর তা হল, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিহার রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর তা মোদির দল বিজেপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়, ভারত যদি আগে আরও বেশি মার্জিত ভূমিকা পালন করতে পারত, তাহলে হয়তো নেপালে এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন করা যেত যাতে মাধেসিদের কম আপত্তি থাকত। তা না করে সংবিধান ঘোষণার পর একদিন কিংবা দুইদিনের জন্য নেপালে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হল।

ভারতের ওপর নেপালের নির্ভরতা
নেপালের ভৌগোলিকতা এমন যে, তিন পাশ থেকে ভারত দিয়ে ঘেরা দেশটি। আর নেপালের উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল। সবমিলে ভারতের উপর নেপালের একটি বড় ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে অপশাসন এবং দেশের অর্থনীতি নিয়ে শাসকদের দূরদর্শিতা না থাকার কারণে তৈরি হয়েছে সে নির্ভরতা। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, দিনের অনেক ঘণ্টা বিদ্যুৎ নেই। ভারতীয় ডিজেল ছাড়া কিভাবে চলবে নেপালের জেনারেটর?

এছাড়া নেপালের রাজনীতিবিদদের অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত অভিসন্ধি পূরণের জন্য নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে আল জাজিরার বিশ্লেষণে। ভারতীয় গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের অনেকের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অনেকেরই জানা বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

কাঠমুন্ডুতে রাস্তাঘাটে খুব কমই যানবাহন চলছে এবং গাড়ি চালকদেরকে সামান্য পরিমাণ জ্বালানির জন্যও চারদিন ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং ক্রমাগত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নেপাল সরকারের দম ফুরিয়ে আসছে। আসন্ন উৎসবে দুই সপ্তাহের জন্য ছুটি ঘোষণা করে নেপাল সরকার একরকমের শ্বাস ফেলার উপায় খুঁজছে বলে মনে করেন থমাস বেল।

ছবি: পিটিআই

ভারতের ‘নগ্ন’ হস্তক্ষেপে কি নেপালের রাজনীতির মেঘ সরবে না?
গেল এপ্রিলে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৮ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানির পর ২২শে জুন ‘ত্রাণ কার্যক্রম’ ঘোষণা করে নেপাল সরকার। তারচেয়েও বড় সত্য এইযে, পর্যাপ্ত খাদ্য আর আশ্রয়ের মত অপরিহার্য প্রয়োজনগুলো পূরণের আশায় নেপালের লাখ লাখ মানুষ এখন উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুনর্গঠনের জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়া ৪শ কোটি ডলারের এক সেন্টও খরচ করেনি সরকার। ভূমিকম্পের কারণে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নেপাল সরকারের কাছে একেবারেই অবহেলিত ছিল উল্লেখ করে বিশ্লেষণে বলা হয়, ভারতের অঘোষিত এ অবরোধ কেবল সেই ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্দশাকেই গাঢ় করেছে।

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সরবরাহের পাশাপাশি অবরোধের রাজনৈতিক কারণের ব্যাপারে একটি  সংলাপপ্রসূত সমাধানের ওপরও জোর দিচ্ছে নেপাল সরকার। তবে সংবিধানের অজনপ্রিয়তাকে যারা আভ্যন্তরীণ ইস্যু না ভেবে বিদেশি ষড়যন্ত্র ভাবতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য এ অবরোধ কাজে লাগছে।

তবে সত্যিকার অর্থে শিগগির কিংবা পরে যখনই ভারতীয় অবরোধ তুলে নেয়া হোক না কেন নেপালের আভ্যন্তরীণ ভুল বিষয়গুলো থেকেই যাবে বলে মনে করেন আল জাজিরার প্রতিনিধি। তার মতে, ভারতের ‘নগ্ন হস্তক্ষেপ’ আসন্ন বছরগুলোতেও নেপালের রাজনীতিকে মেঘাচ্ছন্ন করে রাখবে।

সূত্র: আল জাজিরা

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.