নাইকোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যাচ্ছে বাপেক্স
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৫ ঢাকা: দুর্ঘটনার ১০ বছরেও ক্ষতিপূরণ না পেয়ে অবশেষে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স; যে আদালতে নাইকো আগে থেকেই ক্ষতিপূরণ না দেয়ার জন্য একটি মামলা ঠুকে রেখেছে। ২০০৫ সালে টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে দুই দফা দুর্ঘটনার পর নাইকোর যে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ছিল তা আদায়েই শক্ত এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এজন্য লন্ডনের বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে (ইকসিড) ইতোমধ্যে নোটিশ অব ডিসপিউট দেয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাইকো পরিচালিত ছাতকের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন দুই দফা অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর ক্ষতিপূরণ দাবিতে স্থানীয় আদালতে মামলা করে পেট্রোবাংলা। এছাড়া আদলতের নির্দেশনা অনুসারে নাইকোর অন্য গ্যাসক্ষেত্র ফেনী থেকে সরবরাহকৃত গ্যাসের বিপরীতে প্রাপ্য অর্থ আটকে রাখে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলার আটকে রাখা ওই অর্থ আদায়ে ও ক্ষতিপূরণ না দেয়ার জন্য ইকসিডে দুটো মামলা দায়ের করে নাইকো। আন্তর্জাতিক আদালত গত বছর নাইকোর গ্যাসের দাম পরিশোধের মামলার রায় দেয়। এদিকে নাইকো টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রের জন্য নিরাপত্তা জামানত হিসেবে রাখা অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে। স্থলভাগের ৯ নম্বর ব্লকে (কুমিল্লা অঞ্চল নিয়ে গঠিত) তাদের যে শেয়ার রয়েছে, তাও বিক্রি করছে। সব মিলিয়ে নাইকোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এজন্যই নতুন করে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইকসিডে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। এতোদিন ধরে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে যারা মামলা পরিচালনা করেছেন তাদের গাফিলতি ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কয়েকজন কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, ইকসিডে মামলায় নিয়োগকৃত বাংলাদেশের আইনজীবী তৌফিক নেওয়াজকে (সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির স্বামী) দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মামলার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত পেট্রোবাংলার সাবেক সচিব ইমাম হোসেনকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।
নতুন করে মামলা পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ল’ ফার্ম ফলে হগ এলএলপিকে (ওয়াশিংটন ডিসি) নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর সার্বিক আইনী সহায়তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ আসিফকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার।
নাইকো মামলা নিয়ে জটিলতা কাটাতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ইতোমধ্যে দুবার লন্ডন সফর করেছেন। ঈদের আগে আইনমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) ও নাইকো রিসোর্সেস (কানাডা)-এর বিরদ্ধে একটি নতুন মামলা দায়েরের জন্য ফলে হগ চলতি মাসের ১৭ তারিখে ইকসিডে বাপেক্সের পক্ষে নোটিশ অব ডিসপুট দিয়েছেন।
এছাড়া নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলে উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
মামলা নিয়ে আলোচনা করতে নসরুল হামিদ, ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ আসিফ ও আইনমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব আগামী মাসের ১০ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন।
১৯৯৯ সালে নাইকো টেংরাটিলা, ফেনী ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রের ইজারা লাভ করে। অভিযোগ রয়েছে, এ ইজারা দিতেও দুর্নীতি হয়। কারণ ‘প্রান্তিক’ (বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলন সম্ভব নয়) দেখিয়ে এ গ্যাসক্ষেত্রগুলো ইজারা দেয়া হয়। যদিও গ্যাসক্ষেত্রগুলো ছিল সম্ভাবনাময়। সে সময় জ্বালানি সচিব ছিলেন বর্তমনে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধূরী।
২০০৩ সালে টেংরাটিলায় কূপ খননের জন্য বাপেক্স ও নাইকোর মধ্যে চুক্তি হয়। কূপ খননকালে ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন দুই দফায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অগ্নিকাণ্ডে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পুড়ে যায়। আশপাশের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে নাইকোর কাছ থেকে দামি গাড়ি নেয়ার অভিযোগে সে সময় পদ ছাড়তে হয় তৎকালীন বিএনপি সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনকে। ২০০৫ সালে গাড়ি কেলেঙ্কারির ঘটনা এদেশের পত্রিকায় ফাঁস হলেও সে সময় নাইকো অভিযোগটি স্বীকার করেনি। তবে পরে কানাডার একটি আদালতে মন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করে তারা। মোশাররফ হোসেনকে দামি গাড়ি ছাড়াও ভ্রমণব্যয়ের পাঁচ হাজার ডলার ঘুষ দেয় কোম্পানিটি। এজন্য ২০১১ সালে কানাডার আদালত নাইকোকে ৯৭ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৪ মার্কিন ডলার জরিমানা করে।
দুর্ঘটনার কারণে নাইকোর কাছে ৭৪৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে পেট্রোবাংলা। এ বিষয়ে সরকার ও নাইকোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলে। কিন্তু তা ব্যর্থ হলে ২০০৮ সালে ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা করে পেট্রোবাংলা। এ মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে। মামলায় গতি আনতে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ক্ষতিপূরণ দাবিতে নাইকোর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের দাবিও ছিল তাদের। হাইকোর্ট চুক্তি বাতিলের কোনো নির্দেশনা না দিলেও টেংরাটিলার ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত ফেনী ক্ষেত্রের গ্যাস বিক্রি বাবদ নাইকোর পাওনা পরিশোধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং কোম্পানিটির বাংলাদেশে পরিচালিত সব ধরনের ব্যাংক হিসাব সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য নাইকোর ব্যাংক হিসাব খুলে দেয়া হয়।
এ অবস্থায় নাইকো আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল এবং ১৬ জুন দুটি মামলা দায়ের করে। মামলা দুটি হলো- গ্যাসের বকেয়া বিল আদায় সংক্রান্ত (আরবি/১০/১৮) মামলা এবং অন্যটি টেংরাটিলা বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ থেকে অব্যাহতি চেয়ে মামলা (আরবি/১০/১১)। এরমধ্যে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় মামলার একটি রায় ঘোষণা করে ইকসিড, যাতে নাইকোর আটকে রাখা গ্যাস বিল সুদসহ পরিশোধ করতে বলা হয়। ফেনীর গ্যাসবিল বাবদ নাইকোর আসল পাওনা প্রায় ২১৬ কোটি টাকা (২০০৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০১০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সরবরাহ করা গ্যাসের দাম)। একই সঙ্গে এ পাওনার ওপর ২০০৭ সালের ১৪ মে থেকে পরবর্তী সময়ের জন্য নির্ধারিত হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে।
ক্ষতিপূরণ বিষয়ক মামলাটির পরবর্তী শুনানির জন্য নভেম্বরে দিন ধার্য রয়েছে।