sas উপসর্গ মিলছে না। তাই রক্ত পরীক্ষাই রোগ চেনার একমাত্র উপায়। জিন বদলে যে ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া এ বার হানা দিয়েছে এ রাজ্যে, তাতে জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রক্ত পরীক্ষার দাওয়াই দিচ্ছেন ঠেকে শেখা চিকিৎসকেরা।

রাজ্য সরকার ডেঙ্গি পরীক্ষায় এনএস-ওয়ান-এর উপরে ভরসা করতে নিষেধ করে দিয়েছে। পুর ক্লিনিকগুলিতে বা সরকারি হাসপাতালে এনএস-ওয়ান পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বেসরকারি ক্লিনিকে ডেঙ্গি শনাক্ত করার জন্য এনএস-ওয়ান পরীক্ষার উপরেই নির্ভর করছেন বহু চিকিৎসক। তাঁদের মন্তব্য, রোগ শনাক্ত করতে যত দেরি হবে, শরীরের মধ্যে জীবাণুর সংখ্যা তত বাড়তে থাকবে। রোগের তীব্রতাও বাড়বে।

 এক চিকিৎসকের কথায়, এনএস-ওয়ান পরীক্ষায় আগাম ডেঙ্গির আভাস পাওয়া যায়। ওই পরীক্ষার ফল হাতে পেয়েই তিনি বহু রোগীর প্লেটলেট পরীক্ষা করাতে দিয়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালে ওই রোগীর ডেঙ্গি ধরা পড়েছে। কিন্তু এনএস-ওয়ান এবং প্লেটলেট পরীক্ষার পরে প্রথাগত চিকিৎসা শুরু করে দেওয়ায় ডেঙ্গি সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছে বলে ওই চিকিৎসকের দাবি। এলাইজা পরীক্ষার ফল পেতে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে চার-পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হয়। ডেঙ্গি হয়ে থাকলে এই সময়ের ব্যবধানে রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে।

গত বছর ডেঙ্গির সময়েও স্বাস্থ্যকর্তারা এই যুক্তি মানেননি। এ বারেও ডেঙ্গি যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখনও তাঁরা বলছেন এনএস১-এর ওপরে নির্ভর করার কোনও যুক্তি নেই। কারণ সেটা প্রাথমিক পরীক্ষা। পরবর্তী ধাপে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার রিপোর্টেই আসল তথ্য পাওয়া সম্ভব। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘এ নিয়ে এত কথাই বা উঠছে কেন? ডেঙ্গি নির্ণয় হলেই চিকিৎসা পদ্ধতি বদলে যাবে, এমন নয়। ডেঙ্গির আলাদা কোনও চিকিৎসাই নেই। তাই সামান্য গা গরম হলেই রক্ত পরীক্ষা করতে না ছুটে সাধারণ জ্বরের চিকিৎসা এবং পর্যাপ্ত জল খাওয়াই যথেষ্ট।’’

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের এই প্রবণতাই যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কারণ ডেঙ্গি চিহ্নিতকরণ, চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র নির্দেশিকার (২০০৯) চতুর্থ পর্বে ডেঙ্গি চিহ্নিতকরণ কী ভাবে করতে হবে সে বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘ডেঙ্গির এমন অনেক উপসর্গ রয়েছে যেগুলি দেখে রোগটা বোঝা যায় না। তার জন্য যত দ্রুত সম্ভব রক্ত পরীক্ষা জরুরি। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে খুব অল্প সময়েই জীবাণুর প্রভাব অত্যন্ত বেড়ে যায়। রোগীর অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে প্রাণ বাঁচানোই মুশকিল হয়ে পড়ে।’ যে সব চিকিৎসক ডেঙ্গি রোগীর চিকিৎসা করেন তাঁরা বলছেন, ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ায় যে সব মৃত্যু হয়, তার শতকরা ৯০টি ক্ষেত্রেই ঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় হলে আক্রান্ত রোগীকে বাঁচানো যেত।

এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘একটি ১৮ বছরের মেয়ের জ্বর এবং হাত পায়ের ব্যথা দেখে আমি এনএস-ওয়ান পরীক্ষা করতে দিয়েছিলাম। সেই পরীক্ষার ফল দেখে প্লেটলেট পরীক্ষা করতে দিয়েছিলাম। পর পর দু’দিন প্লেটলেট পরীক্ষায় দেখা গেল তা অনেকটাই নেমে গিয়েছে। পরে এলাইজা পরীক্ষায় ডেঙ্গি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। এনএস-ওয়ান পরীক্ষার ফল দেখে চটজলদি প্লেটলেট মাপতে দেওয়ায় তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা গিয়েছিল।’’

কোনও কোনও চিকিৎসক আবার এনএস-ওয়ান পরীক্ষা করা উচিত, নাকি উচিত নয়— সেই চক্করে না পড়ে এই মরসুমে জ্বর হলেই পর পর তিন-চার দিন রক্তের প্লেটলেট, শ্বেত কণিকা ও লোহিত কণিকার পরিমাণ দেখে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, প্লেটলেট যদি দ্রুত হারে কমে তা হলে এলাইজা পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগেই বলে দেওয়া সম্ভব যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। শ্বেত কণিকার হেরফের বুঝিয়ে দেয় শরীরে কোনও জীবাণুর সংক্রমণ ঘটেছে। কারণ, বাইরে থেকে কোনও জীবাণু রক্তের মধ্যে ঢুকলে শ্বেত কণিকা তাদের সঙ্গে লড়াই করে। ম্যালেরিয়া-সহ অন্য নানা রকমের জীবাণু রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে দেয় (হিমোলাইসিস)। রক্তে বর্হিশত্রুর আক্রমণ হয়েছে কিনা তার অন্যতম নির্দেশক হিমোলাইসিস।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনএস-ওয়ান পরীক্ষার পাশাপাশি জ্বর হলে এখন প্লেটলেট পরীক্ষা করিয়ে নেওয়াটাই সব থেকে জরুরি। পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘যত তাড়াতাড়ি রক্ত পরীক্ষা করিয়ে রোগ নির্ণয় করা যায় ততই ভাল। প্রয়োজনে দ্বিতীয় বার রক্ত পরীক্ষার সময় পাওয়া য়ায়।’’ চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র বলেন, ‘‘ডেঙ্গি হয়েছে কি হয়নি, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। তত ক্ষণে হয়তো প্লেটলেট এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গিয়ে কোনও ঝুঁকির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা এই কারণেই প্রথমে প্লেটলেট পরীক্ষার কথা বলি।’’

সাধারণ ভাবে ডেঙ্গির অন্যতম প্রধান উপসর্গ জ্বর। কিন্তু এ বার সে ভাবে জ্বর আসেইনি, অথচ ডেঙ্গি পজিটিভ, এমন অনেক নজির মিলছে। ১১ বছরের ছেলের পেট খারাপ চলছিল চার-পাঁচ দিন ধরে। সঙ্গে সামান্য গা ম্যাজম্যাজ। শুধু পেট খারাপের ওষুধই খাওয়ানো হচ্ছিল তাকে। দিন কয়েক পরে যখন একেবারে নেতিয়ে পড়ল সেই ছেলে, তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। প্লেটলেট পরীক্ষা করে জানা গেল, ৪০ হাজারেরও নীচে নেমে গিয়েছে।

শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘জ্বর না হয়ে জ্বর-জ্বর ভাব থাকলেও সেটা ডেঙ্গি হতে পারে। ইদানীং আমরা দেখছি জ্বর কমে যাওয়ার পরে অসুস্থতা বাড়ছে। তখন রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গি পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। জ্বর কমার পরে অন্তত ৭২ ঘণ্টা আমরা খুব সাবধানে থাকতে বলছি। এ বারের ডেঙ্গির চরিত্রটাই এমন যে সামান্য হেলাফেলা করলে তা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।’’

রক্ত পরীক্ষা করাটা জরুরি কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, ডেঙ্গি হলে বেশ কিছু ওষুধ খাওয়া যায় না। তাতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় থাকে। যেমন আইবুপ্রফ্রেন জাতীয় ওষুধ একেবারেই খাওয়া চলে না। ডেঙ্গি আর ওই ওষুধ দুইয়ে মিলে কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে। রক্ত পরীক্ষা না করে এটা বোঝা যাবে কী করে?’’

কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর বা পুরসভার তরফে তো কোনওই প্রচার নেই। তা হলে সাধারণ মানুষ এ নিয়ে ওয়াকিবহাল হবেন কী করে? স্বাস্থ্য দফতর এবং পুরসভা কারও কাছেই এর কোনও উত্তর নেই।

দেবদূত ঘোষঠাকুর ও সোমা মুখোপাধ্যায়

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫,