সমাজতন্ত্র পতনে গণতন্ত্র সফল হয়নি সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলোতে

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৫

lalসোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর কেটে গেছে ২৪ বছর। বেকারত্ব বৃদ্ধি, শিল্পক্ষেত্রে নিম্নমুখী উৎপাদন, জাতিগত বিরোধ ও লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা সমস্যা এবং সমাজতন্ত্রের আদর্শিক সংকটে সোভিয়েত ইউনিয়ন উড়িয়েছিল গণতন্ত্রের পতাকা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গঠিত হয়েছিল ১৫টি দেশ। তবে দুই যুগ পরও সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি পূর্ব ইউরোপসহ সাবেক সোভিয়েত বলয়ভুক্ত বেশিরভাগ দেশ।

মিখাইল গর্বাচেভের পদত্যাগের পর ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে তার আগে থেকেই এর গণরাজ্যগুলো স্বাধীনতা ঘোষণা করা শুরু করে। ১৯৯০ সালে সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করে লিথুয়ানিয়া। ১৯৯১ সালের আগস্টে সোভিয়েত ছাড়ে এস্তোনিয়া। এর পরপরই দলছুট হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশ। এ সব গণরাজ্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, মলদোভা, আর্মেনিয়া, উজবেকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও লাটভিয়া।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ‘জনগণ সব ক্ষমতার উৎস’ এই স্বপ্ন দিয়ে যাত্রা শুরু করা ওই দেশগুলোতে গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে বার বার। সোভিয়েত ভেঙে গঠিত বেশ কয়েকটি দেশে গণতন্ত্রের নামে চলছে একতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ফ্রিডম হাউসের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়াকে বলা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র। ১৯৯১ সালের পর এস্তোনিয়ায় নির্বাচন হয়েছে ১০ বার, লিথুয়ানিয়ায় নির্বাচন হয়েছে ১১ বার ও লাটভিয়ায় নির্বাচন হয়েছে ১৩ বার। প্রতিবেদন অনুযায়ী সবগুলো নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, কিরগিজিস্তান, মলদোভা ও ইউক্রেনকে বলা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে আংশিক সফল। ১৯৯১ সালের পর আর্মেনিয়ায় নির্বাচন হয়েছে ১১ বার। তবে প্রতিবারই কারচুপি ও অস্বচ্ছ নির্বাচনের অভিযোগ উঠেছে। জর্জিয়ার ১৯৯১ সালের পর ১৩ বার নির্বাচন হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র চারবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিরগিজিস্তানে ১২ বারের মধ্যে একবারও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। মলদোভায় নির্বাচন হয়েছে মোট নয়বার। এর মধ্যে আটবারই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হওয়ার পর ইউক্রেনে নির্বাচন হয়েছে ১২ বার। তার মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে পাঁচবার।

এ ছাড়া আজারবাইজান, বেলারুশ, কাজাখস্তান, রাশিয়া, উজবেকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান ও তাজিকিস্তান রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন নয় বলে ফ্রিডম হাউসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তার মধ্যে উজবেকিস্তান ও তুর্কেমেনিস্তানের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯১ সালের পর আজারবাইজানে নির্বাচন হয়েছে ১২ বার। এর মধ্যে একবারও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। বেলারুশে নির্বাচন হয়েছে আটবার। এর মধ্যে একবারও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। কাজাখস্তানেও নির্বাচন হয়েছে মোট ১২ বার। তার মধ্যে মাত্র একবার সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। রাশিয়ায় ১১ বার নির্বাচন হলেও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে চারবার। তাজিকিস্তানে ১৯৯১ সালের পর মোট নয়বার নির্বাচন হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনেই কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। তুর্কেমেনিস্তানে আটবার নির্বাচন হলেও কোনোবারই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উজবেকিস্তানে নির্বাচন হয়েছে সাতবার। তবে একবারও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি।

আগেই বলা হয়েছে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত অনেক দেশেই গণতন্ত্রের পর্দায় আড়ালে চলছে একনায়কতন্ত্র। এক্ষেত্রে সবার আগে আসে উজবেকিস্তানের ইসলাম করিমভের নাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগে ১৯৯০ সাল থেকেই উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ১৯৯১ সালের পর মোট সাতবার নির্বাচন হয়েছে দেশটিতে। প্রতিবারই নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছেন করিমভ। সর্বশেষ নির্বাচনে ৯১ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন তিনি।

এরপরই বলা যায় কাজাখস্তানের কথা। সোভিয়েত ভাঙার বছরখানেক আগে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন নুরসুলতান নাজারবায়েভ। তারপর থেকে একই চেয়ারে আসীন তিনি। সর্বশেষ নির্বাচনেও বিজয়ী হয়েছেন ৯৬ শতাংশ ভোট পেয়ে।

আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ অবশ্য ২০০৩ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। এর আগে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সেখানকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইলহামের বাবা হায়দার আলিয়েভ। তাই আজারবাইজানে একনায়কতন্ত্র না হলেও পরিবারতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে এ কথা বলা যেতেই পারে।

১৯৯৯ সাল থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আছেন ভ্লাদিমির পুতিন। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে তকমা পাওয়া পুতিনও শরীর থেকে একনায়কের কালিমা মুছতে পারেননি। তার বর্তমান মেয়াদ শেষ হবে ২০১৮ সালে।

একনায়কতন্ত্রের আরেকটি উদাহরণ বেলারুশ। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেনকো ১৯৯৪ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন।

গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও কোনো দেশে গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম মাপকাঠি। এই মাপকাঠিতেও পিছিয়ে আছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশই। ২০১৫ সালে প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস প্রকাশিত প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী এস্তোনিয়ায় গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা বিদ্যমান। বাল্টিক অন্য দুই রাষ্ট্র লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার পরিস্থিতিও সন্তোষজনক।

এদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, কিরগিজিস্তান ও মলদোভার পরিস্থিতি খুব একটা সন্তোষজনক নয়।

এ ছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে বেলারুশ, কাজাখস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি বেশ নাজুক।

তবে ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী আজারবাইজান, তুর্কেমেনিস্তান ও ইউক্রেনের গণমাধ্যমগুলোর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ।

সাবেক সোভিয়েতভুক্ত কয়েকটি দেশে গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থার জন্য কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করা যায়। এ সব কারণের মধ্যে সবার আগে আসে রাশিয়ার খবরদারির বিষয়টি। রাশিয়া এখনো সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোকে নিজের কক্ষপথের অংশ বলেই মনে করে। অনেক দেশের ওপর রাশিয়ার অকারণ হস্তক্ষেপও এ জন্য দায়ী। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ওপর রাশিয়ার হস্তক্ষেপের সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইউক্রেন সংকটের কথা।

এ ছাড়া সাবেক সোভিয়েতভুক্ত যে সব দেশ এশিয়া মহাদেশের মধ্যে পড়েছে সেসব দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক সংকট বেশি দেখা গেছে। কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের নির্বাচনের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়।

সমাজতান্ত্রিক বলয়ের আরেক প্রভাবশালী রাষ্ট্র যুগশ্লোভিয়া। ১৯৮০ সালে অবিসংবাদিত নেতা মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর সেখানে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নানা জাতিসত্তা এই দেশটিতে ভাঙন দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তাদের মিত্রদের নানা ষড়যন্ত্রে একসময় দেশটি ছয়টি খণ্ডে বিভক্ত হয়। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, মন্ট্রেনেগ্রু, সার্বিয়া ও স্লোভেনিয়া। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশগুলোতে জাতিগত সংঘাতে কয়েক লাখ মানুষ মারা যায়। থমকে সমাজতান্ত্রিক আমলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা।

সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতার নতুন সুরা পানের পর ওই সব দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র আসেনি। লম্বা সময় পেরিয়ে গেলেও গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হয়নি দেশগুলোতে। তবে এদিক দিয়ে একটু আলাদা সোভিয়েত বলয়ের পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এর মধ্যে রয়েছে পূর্ব জার্মানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম জার্মানি থেকে আলাদা হয়ে যায় পূর্ব জার্মানি। আর জার্মানির এই অংশটি থাকে সোভিয়েত বলয়ের ইস্টজোনে।

১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত বলয়ভুক্ত থাকলেও পরে দেশটি পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে যোগ দেয়। দুই জার্মানি এক হওয়ার পর সেখানে গণতন্ত্র বলতে যা বুঝায় তার সবই পেয়েছে ইস্ট জার্মানির নাগরিকরা। নিয়মিত নির্বাচন, বাকস্বাধীনতা, মৌলিকঅধিকারগুলো ভালভাবেই অনুসরণ করে যুক্ত জার্মানি। তাই মাঝে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে কিছুটা ছিটকে গেলেও ফের স্বমহিমায় নিজেদের জায়গা দখল করে নিয়েছে বিসমার্কের দেশ। ফেডারেল পার্লামেন্টারি সংসদীয় রীতি মেনে সরকার গঠন করে জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলো।

এই বলয়ের আরেক দেশ পোল্যান্ড। এই দেশটিও সোভিয়েত বলয় থেকে বেরিয়ে আসার পর একদলীয় শাসন ছেড়ে গণতন্ত্রের ট্রেনে উঠেছে। এখানে মোটামুটি সফল দেশটি। যদিও ১৯৪৪ থেকে ১৯৮৯ সাল অবধি সোভিয়েত ইউনিয়নের সেটেলাইট স্টেট হিসেবে বিবেচনা করা হত পোল্যান্ডকে। কিন্তু ওই বলয় থেকে বেরিয়ে আসার পর সে তকমা ঘুচে গেছে দেশটির। এখন সংসদীয় রীতি মেনে নির্বাচন হয় এখানে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পোল্যান্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন ইওয়া কোপাকস।

সমাজতন্ত্রের পতনের পর সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলোতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া মানুষের গণতন্ত্রের স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে সেখানে।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.