এই আগস্ট মাসের ৭-৮ তারিখে আয়ার্ল্যান্ডের ডাবলিন শহরে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আন্তর্জাতিক কাউন্সিল করে সিদ্ধান্ত নিল যে, এ বার সব দেশকে বলবে, বারবণিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত মেয়েদের অধিকার রক্ষায় তারা সমস্ত ধরনের উদ্যোগ নিক, এঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও ভাবে অপরাধী বলে চিহ্নিত করা বন্ধ করুক। সারা পৃথিবীর অধিকার আন্দোলনের মানুষরা, সেলেব্রিটিরা, এমনকী সাধারণ মানুষও সরাসরি দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন এই সিদ্ধান্তে। শরীর বেচা-কেনার বিষয়ে দুই প্রান্তের বক্তব্য মোটামুটি এ রকম: এক দল মনে করেন, সব অবস্থাতেই এটা শোষণ, এই কাজ শরীর যে কেনা যায়, এই কথা প্রতিষ্ঠা করে, যা চূড়ান্ত অনৈতিক, সেই কাজ যতই স্ব-ইচ্ছায় করার কথা বলা হোক না কেন। আর এক দল মনে করেন, দু’টি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি অন্যের ক্ষতি না করে নিজেদের মধ্যে কোনও চুক্তি করেন, তাতে রাষ্ট্র নাক গলাবে কেন? তাই এক দল এই কেনা-বেচা পুরোপুরি বন্ধের পক্ষে, আর এক দল অপরাধ মুক্তকরণের পক্ষে, যিনি স্ব-ইচ্ছায় এই কাজে এসেছেন, তাঁকে যেন অপরাধী বলে চিহ্নিত না করা হয়। অনিচ্ছুক আর শিশুদের এই কাজে, এমনকি স্ব-ইচ্ছাতেও কোনও অবস্থাতেই নিয়োগ করা যাবে না— এ বিষয়ে দু’তরফই একমত।

অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, সমাজে লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম, ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের ইতিহাস, কাজের খোঁজে দেশান্তরে যাওয়া— এ সবের ভিত্তিতে সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীই বারবণিতাবৃত্তির পেশায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় হাজির। উপরতলার মানুষের হাতে রয়েছে ভালমন্দ নির্ধারণের অধিকার। মেয়েরা মন্দচরিত্র, হিজড়েরা নোংরা, বিদেশিরা চোর— এগুলো জনমানসে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এই বঞ্চিত মানুষদের জন্য সুযোগ তৈরির সত্যিকারের চেষ্টা হয়েছিল কি-না, সেই কথা তোলার আগেই এই মানুষদের জন্য যে ঘৃণা জনমানসে তৈরি হয়, সে জন্য তাঁরা নিজেদের কথা কখনওই নিজেরা বলার সুযোগ পান না। এই মানুষরা সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন, এবং সেটা খুব ‘স্বাভাবিক’ ধরে নিয়েই প্রতিকারের পথ সাধারণত বন্ধ করে দেওয়া হয়। নীরবেই সমস্ত অপমান ও যন্ত্রণা তাঁদের হজম করতে হয়। শরীর কেনা-বেচার প্রসঙ্গে ‘মানুষ’ শব্দটি ব্যবহার করছি, কারণ নারী-পুরুষ এবং লিঙ্গান্তরিত বা রূপান্তরকামীরাও এখানে যুক্ত এবং সমান ভাবেই, অথবা একটু বেশিই মানবাধিকার হরণের শিকার।

 এই বৃত্তির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল যে, অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া, পুলিশের খাতায় নাম উঠে যাওয়া। ফলে কেউ এর পর এই বৃত্তি ছেড়ে অন্য পেশা নিতে চাইলেও অপরাধীর তকমা সহজে মেটে না, তাই এক দুষ্টচক্রের আবর্তে কাটে সারাটা জীবন। অ্যামনেস্টি সমস্ত দেশকে আইন এমন ভাবে বদল করতে বলছে, যাতে এই বৃত্তির ক্রেতা বা বিক্রেতা, বা এই বৃত্তিতে নিযুক্ত মানুষদের আয়ের উপর নির্ভরশীলরা অপরাধী বলে চিহ্নিত না হন। সেই সঙ্গে এমন ব্যবস্থা করা, যাতে এই বৃত্তির মানুষেরা তাঁদের অধিকার হরণের ঘটনায় নির্ভয়ে দেশের ফৌজদারি আইনকে ব্যবহার করতে পারেন, স্বাস্থ্য-চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, বিশেষত প্রান্তিক আর দরিদ্র মানুষরাই যেহেতু এই বৃত্তিতে আসছেন, তাই তাঁদের আর্থিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক অধিকারকে এমন ভাবে সুরক্ষিত করতে হবে, যাতে কেউ বাধ্য হয়ে এই বৃত্তিতে না আসেন। আর যদি বা আসেনও, তা হলেও যেন চাইলে বেরিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ না হয়ে যায়। তবে এই বৃত্তিকে সরকারি ভাবে কাজ বলে ধরা হবে কি-না, সেই কাজকে রেগুলেশনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে অ্যামনেস্টি কোনও মন্তব্য করছে না। শুধু বলছে, যদি তা করাও হয়, তা যেন মানবাধিকারের মৌলিক শর্তগুলি মেনে নিয়েই করা হয়। আর এই বৃত্তি যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁদেরকে সঙ্গে নিয়েই যেন রেগুলেশনের নিয়মনীতি নির্ধারণের কাজটা করা হয়।

বিতর্ক কোথায়?

নাম করা পশ্চিমি তারকা অ্যালিসন উইলিয়ামস, লেনা ডানহ্যাম, কেট উইনস্লেট, অ্যান হ্যাথোয়ে, মেরিল স্ট্রিপরা অ্যামনেস্টির এই প্রয়াস বারবণিতাবৃত্তিকে বৈধতা দিচ্ছে বলে তীব্র ভাবে সরব হয়েছেন। বিরোধিতা করেছেন প্রখ্যাত নারীবাদী সংগঠক ও লেখিকা গ্লোরিয়া স্টাইনেম। এমনকী যে ডাবলিন শহরে এই প্রস্তাব পাশ করেছে অ্যামনেস্টি, সেখানেই এর তীব্র বিরোধিতা রয়েছে। সুইডেন, নরওয়ে, ভারত— কেউ শরীর কেনাকে, কেউ বেচাকে, কেউ সাহায্য করাকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে।

তাইল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি— কাউকে অপরাধী করেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ল্যান্সেট পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণা বলছে, যেখানে ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউই অপরাধী সাব্যস্ত হন না, সেখানে এই বৃত্তিতে যুক্ত মানুষ অনেক সহজে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিতে আসেন, এডস সংক্রমণ অনেক কম। তবে পশ্চিম দুনিয়া তাদের দেশের মানুষদের বৈচিত্রের সন্ধানে যাওয়া আটকাতে পারছে না বলে ‘সেফ সেক্স’-এর নিদান দিচ্ছে কি-না, সে প্রশ্ন আছেই। কিন্তু সেখানেও অভিযোগ, সত্যিটাকে পুরোটা নয়, সাজিয়েগুছিয়ে বলা হচ্ছে।

গত দু’বছর ধরে অ্যামনেস্টি তার প্রত্যেকটি শাখায় নারী সংগঠন, বারবণিতাদের বিভিন্ন সংগঠন বা এই বৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে লড়ছেন, এ রকম সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন সংগঠন যেমন ইউএনএডস প্রভৃতিদের সঙ্গে আলোচনা করে ডাবলিনের সম্মেলনে এই সনদ গ্রহণ করেছে। ক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল বলে ১৪টি নাম করা পাচার-বিরোধী সংগঠনের জোট অ্যামনেস্টির এই সনদে আতঙ্কিত হয়ে বলেছে, এর ফলে দালালদের বিরুদ্ধেও কোনও আইনি পথ নেওয়া যাবে না। বলেছে, এই বাণিজ্যে ‘কেউ অপরাধী নয়’ এই অবস্থান যে যে দেশ নিয়েছে, সেই সব দেশেই মানুষ পাচার বেড়ে গেছে। তারা অ্যামনেস্টিকে বলেছে ‘যৌনকর্ম’ শব্দবন্ধ প্রয়োগ না করে ‘যে মানুষরা শরীর বেচা-কেনায় নিযুক্ত’ এই ভাবে উপস্থিত করতে। আরও বলেছে, প্রধানত মেয়েরাই এখনও এই বৃত্তিতে বেশি আসেন, তাই অপরাধমুক্তকরণের নামে পুরুষের উপভোগের জন্যই যে নারীশরীর— এই পিতৃতান্ত্রিক অবস্থানকেই অ্যামনেস্টি পুষ্ট করছে। আর অপরাধমুক্তকরণকে যারা শরীর বেচা-কেনা করছে, তাদের বাইরে অন্য কোনও তৃতীয় ব্যক্তি, যথা দালাল, এদের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে না, সেটি নিশ্চিত করা হবে কী করে? এই প্রশ্ন ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

এখানে যাঁরা এই বৃত্তিতে স্ব-ইচ্ছায় আসছেন, আর যাঁরা পাচার হয়ে আসছেন, তাঁদের চিহ্নিত করা আর তাঁদের জন্য দু’রকম মাপকাঠি রূপায়ণ আর প্রয়োগের বাস্তব চেহারাটি কী হতে পারে, তা নিয়ে কেউ স্পষ্ট জবাব দিচ্ছেন না। পুলিশ-বাবু-দালালের খপ্পর থেকে ইচ্ছুক মেয়েদের বার করে এনে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু এ বৃত্তিকে ঘিরে অপরাধ-নেশার জিনিস-দালাল-মাসি-প্রশাসন-রাজনীতির যে চক্র কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চালাচ্ছে, অপরাধমুক্তকরণের সুযোগ তারা কী ভাবে নেবে, কেউ তা আগাম বলতে পারছেন না।