খাদ্য সরবরাহ না করেই ২৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ
সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৫ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে খাদ্যপণ্য সরবরাহ না করেই ভুয়া বিল বানিয়ে ২২ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩৬ টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি চক্র। কারাগারের নিবন্ধিত দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয় থেকে গত মে মাসে এই টাকা (চারটি চেকে) তুলে নেওয়া হয়।
টাকা আত্মসাতের এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের তিন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। হয়েছে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিও। তবে কারা টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত, তা এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ ও হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্র জানায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইয়ুব আলী ট্রেডার্স ও চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের নাম ব্যবহার এবং কারা কর্তৃপক্ষের সই ও সিল জাল করে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এপ্রিল মাসে কারাগারে খাদ্যপণ্য সরবরাহের বিল বাবদ চক্রটি এই টাকা তুলে নেয়। অথচ দুটি প্রতিষ্ঠানে
র নামে এপ্রিল মাসে কোনো বিল হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে পাঠায়নি কারা কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের কারাধ্যক্ষ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, গত এপ্রিল মাসে কারাগারে মাছ, মাংস, ডাল, সাবান, তরকারিসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সরবরাহের খরচ বাবদ ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৯৯ লাখ ১৩ হাজার ১১০ টাকার বিল তৈরি করে টাকা ছাড় করতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে পাঠানো হয়। গত ১ মে পাঠানো এসব বিলের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইয়ুব আলী ট্রেডার্স ও চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের নাম ছিল না।
কারাধ্যক্ষ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, গত ছয় মাসে খাদ্যপণ্য সরবরাহের কোনো কাজই পায়নি আইয়ুব আলী ট্রেডার্স। আর চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের নামে গত এপ্রিল মাসে কারা কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে কোনো বিল পাঠায়নি। তিনি বলেন, কারা কর্তৃপক্ষের সিল-সই জাল করে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে কেউ বিল জমা দিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে। কীভাবে ভুয়া বিল পাস হয়ে টাকা ছাড় (চেক) করানো হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে কারাগারের নিবন্ধিত ঠিকাদারদের তালিকা দেওয়া আছে।
এ বিষয়ে আইয়ুব আলী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আইয়ুব আলী বলেন, ‘ছয় মাস ধরে কারাগারে খাদ্যপণ্য সরবরাহের কোনো কাজই পাইনি, বিল দিয়ে টাকা তুলব কীভাবে?’
চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. বদরুদ্দীন চৌধুরী বলেন, এপ্রিল মাসে কারাগারে খাদ্যপণ্য সরবরাহ বাবদ বিলের কোনো চেক তাঁর নামে ছাড় করেনি কারা কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, গত এপ্রিল মাসে কারাগারের খরচ বাবদ হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয় ১ কোটি ২২ লাখ ২ হাজার ৯৪৬ টাকা ছাড় করে। কিন্তু ২২ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩৬ টাকার গরমিল থাকায় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষকে গত ৬ মে চিঠি দেওয়া হয়। ওই দিনই চট্টগ্রাম কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর কবির (এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্মরত) হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে জানান, এপ্রিল মাসে কারাগারের সংশ্লিষ্ট রেজিস্টার ও খরচের বিবরণীতে কোনো গরমিল পাওয়া যায়নি। দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ২২ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩৬ টাকার কোনো বিল হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে পাঠানো হয়নি।
কারাগার থেকে এই চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টির তদন্তে চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপহিসাব নিয়ন্ত্রক রাজীব বড়ুয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শওকতুল ইসলাম লতিফী, সুপারিনটেনডেন্ট শাহজাহান গাজী ও অডিটর (নিরীক্ষক) আলমগীর চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে সরানোর (ওএসডি) সুপারিশ করা হয়।
বিল না পাঠানোর পরও কীভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা ছাড় (চেক) করা হয়েছে, তা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক মো. মোস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ভুয়া বিলগুলো যাচাই-বাছাই না করে পাস করায় প্রাথমিকভাবে তিন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। আরও তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঢাকায় মহাহিসাব নিয়ন্ত্রককে জানানো হয়েছে। এ ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি হয়েছে।
মো. মোস্তফা কামাল জানান, চট্টগ্রাম হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয় থেকে পাস হওয়া দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ২২ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩৬ টাকার চারটি চেক আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ঢাকার দুটি শাখা থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে গত ৪ মে তুলে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংককে জানানো হলে ব্যাংক হিসাব দুটির নাম-ঠিকানা দিয়েছে তারা। এখন ওই নাম-ঠিকানা ও ট্রেড লাইসেন্স সঠিক কি না, তা যাচাই করা হচ্ছে। চেক জমা দিয়ে টাকা উত্তোলনকারীদের শনাক্ত করা গেলে পুরো জালিয়াত চক্রকে বের করা যাবে।
হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শওকতুল ইসলাম লতিফী বলেন, ‘বিলগুলো দেখে বোঝার উপায় ছিল না, এগুলো ভুয়া। কারা কর্তৃপক্ষের সিল, সই সবই ছিল। এখন ওএসডি হয়ে আছি। যা বলার তদন্ত কমিটিকে বলেছি।’ শাহজাহান গাজীও প্রথম আলোকে একই কথা বলেছেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান ও মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (ডাক ও টেলিযোগাযোগ) কে এম সিরাজুল মনির গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে টাকাগুলো তুলে নেওয়ার বিষয়টি সত্য। জাল-জালিয়াতির সঙ্গে কারা জড়িত, তা তদন্ত শেষ না হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।