বিভীষিকাময় সেই ২১ আগস্ট আজ

আগস্ট ২১, ২০১৫

43

ঢাকা জার্নাল প্রতিবেদক: সেই বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট আজ । ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে স্মরণকালের নৃশংসতম গ্রেনেড হামলার রক্তঝরা দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে সংঘবদ্ধ গ্রেনেড হামলা চালায় ঘাতকের দল। সেদিন স্পষ্টতই তাদের হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলেন এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক শক্তির প্রধান নেত্রী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ভাগ্যক্রমে ঘাতকের গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও গুলিবর্ষণ থেকে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও নিহত হন আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী। বেদনাবিধুর স্মৃতিবহ সেই গ্রেনেড হামলার দিনটি আজ এমন এক পরিস্থিতিতে পালন করা হচ্ছে, যখন সেদিনের গ্রেনেড হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।41
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর আদর্শচ্যুত কয়েকজন হিংস্র লোভী ঘাতক ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়িটিতে সপরিবারে হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন লক্ষ্যে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ঘটানো হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ইতিহাসের বর্বরতম সেই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১১তম বার্ষিকী আজ। অথচ বিগত বছরগুলোতে সেই হামলাকারী খুনিদের বিচার হয়নি। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামাত জোটের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হীন চেষ্টা, হামলাকারীদের আড়াল করার লক্ষ্যে তদন্তের নামে নানারকম টালবাহানা এই ঘটনার সুবিচার পাওয়ার আশাকে করে তোলে সুদূর পরাহত।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে তদন্তের গতি সঠিক ধারায় নিয়ে এলে সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন সংশ্লিষ্টরা। তদন্তে একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে সেদিনের হামলার ঘটনার সঙ্গে মৌলবাদী জঙ্গিচক্র ও তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের নেতাদের সংশ্লিষ্টতার কথা। তবে সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নেপথ্য নায়করা আজও রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সেদিন যা ঘটেছিল
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট,সেদিন ছিল শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তৎকালীন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাবেশে অন্য নেতাদের বক্তৃতার পর বক্তৃতা করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার বক্তৃতা মাত্র শেষ হয়েছে। সময় তখন বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। হঠাৎ বিকট শব্দে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। তারপর খই ফোটার মতো একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটতেই থাকে। জনাকীর্ণ সমাবেশে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাককে লক্ষ্য করে ছোড়া হলো গ্রেনেডগুলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরিত হলো ১৩টি গ্রেনেড। হামলাকারীদের লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে পেরে ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা ঘিরে ফেলেন তাকে। প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করতে মানবঢাল রচনা করেন 40তারা।
হামলাকারীরা যখন বুঝতে পারলো গ্রেনেড জখম করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে, তখন গুলি ছুড়তে শুরু করলো তারা। নেতৃবৃন্দ ও দেহরক্ষীরা দ্রুত শেখ হাসিনাকে তার বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুলে দেন। এ সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পর পর ৬টি বুলেট। ভাগ্যক্রমে বুলেট থেকেও রক্ষা পান শেখ হাসিনা। তবে বুলেটবিদ্ধ হন শেখ হাসিনাকে পেছন থেকে আগলে রাখা তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মাহবুব। গাড়িতেও একাধিক বুলেট আঘাত হানে। গ্রেনেড বা বুলেটের আঘাতে শেখ হাসিনা আহত না হলেও গ্রেনেডের বিকট শব্দে তার কানের শ্রবণযন্ত্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরই পরিণতিতে বাম কান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে শেখ হাসিনার। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার পর তার কানে হেয়ারিং এইড স্থাপন করা হয়েছে।
গ্রেনেড হামলায় যারা নিহত হন
সেদিন শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও হতাহত হন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। গ্রেনেড ও গুলির আঘাতে ঘটনাস্থলে এবং পরে হাসপাতালে প্রাণ হারান মোট ২৪ জন। এরা হচ্ছেন আইভি রহমান, মোস্তফা আহমেদ সেন্টু, মাহবুবুর রশীদ, সুফিয়া বেগম, আব্বাস উদ্দিন শিকদার রতন, লিটন মুন্সি, রফিকুল ইসলাম, আব্দুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, বেলাল হোসেন, রেজিয়া বেগম, আবুল কালাম আজাদ, হাসিনা মমতাজ রীনা, আতিক সরকার, আবুল কাশেম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, নাসির উদ্দিন সরদার, মামুন মৃধা, মুমিন আলী, ইসহাক মিয়া, শামসুদ্দিন এবং অজ্ঞাতনামা আরো দুজন। ২৪ জন নিহত হওয়া ছাড়াও সেদিন আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ ৪ শতাধিক নেতাকর্মী।
ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে পুলিশের ভূমিকা
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে পরিকল্পিত হামলায় ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে এবং সমাবেশস্থলে ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া যায়। সুপ্রশিক্ষিত হামলাকারীরা সমাবেশস্থলের জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে এবং বিপরীত দিকের ভবন থেকে একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ে মারে। পরে হামলাকারীদের একটি গ্রুপ মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাকের খুব কাছে থেকে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্তমাংসের স্তূপে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সমাবেশস্থল। সেদিন সমাবেশস্থল ও এর আশপাশে কয়েকশ সশস্ত্র পুলিশ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কর্তব্যরত থাকলেও রহস্যজনকভাবে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় হামলাকারীরা। পুলিশ কাউকে আটক তো করতে পারেনি বরং হতাহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসা নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপকভাবে লাঠিচার্জ এবং টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে হামলাকারীদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। পরবর্তীতে মামলার তদন্তেও তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় পুলিশ।
প্রকৃত খুনি ও অপরাধীদের আড়াল করার হীন উদ্দেশ্যে জজ মিয়া নামক এক অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে এবং তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপপ্রয়াস চালায়। এই ন্যক্কারজনক কর্মকা-ে তদানীন্তন সরকারি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী ছাড়াও বিএনপি-জামাত জোট সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরাও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। তাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রকৃত অপরাধী এবং হুকুমের আসামিদের যথোপযুক্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
শোক থেকেই শক্তি
২০০৪ সালের সেই নারকীয় গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা এ দেশের মানুষকে সাময়িকভাবে শোকস্তব্ধ করে দিলেও শিগগির শক্তিতে পরিণত হয় সে শোক। জনজীবনে নানাবিধ সমস্যা ও সংকট নিরসন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দাবির পাশাপাশি গ্রেনেড হামলাকারী খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে দানা বাঁধে আন্দোলন। দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে রাজপথের আন্দোলন। সে আন্দোলনের তোড়ে টালমাটাল হয়ে ওঠে তৎকালীন সরকারের তখতে তাউস। এক পর্যায়ে তা মিলে মিশে যায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের নিরপেক্ষ প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সঙ্গে।এরই পরিণতিতে এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সূচিত হয় পরিবর্তনের ধারা। আসে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিপুল বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী।
ঢাকাসহ সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং ভাবগম্ভীর পরিবেশে দিবসটি পালনের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছে নানা কর্মসূচি। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, দেশে স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা, উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দৃপ্ত শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আজ স্মরণ করা হচ্ছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় শহীদদের।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.