সিরাজের মৃত্যুদণ্ড, আকরামের আমৃত্যু কারাদণ্ড

আগস্ট ১১, ২০১৫

Shiraj_Akramঢাকা জার্নাল: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাগেরহাটের রাজাকার কমান্ডার শেখ সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড ও খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে এ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে যেভাবে সুবিধাজনক, সেভাবে ‘বাগেরহাটের কসাই’ কুখ্যাত সিরাজের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলার তিনজন আসামির মধ্যে অন্যজন আব্দুল লতিফ তালুকদার গত ২৮ জুলাই মারা গেছেন। ফলে গত ৫ আগস্ট তাকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে তাই তার কোনো দণ্ড ঘোষিত হয়নি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২)/এ, ৩(২)/সি, ৩(২)/ডি, ৩(২)/জি ও ৩(২)/এইচ এবং ২০(২) ধারা অনুসারে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়। এসব অভিযোগের মধ্যে সিরাজ মাস্টার ছয়টিতে এবং খান আকরাম তিনটিতে অভিযুক্ত হন। সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে আনা ছয়টির মধ্যে পাঁচটি (১, ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর) প্রমাণিত অভিযোগের সবগুলোতেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ পাঁচটি অভিযোগের চারটিতেই তিনি একা অভিযুক্ত হন, অন্যটিতে অভিযুক্ত ছিলেন আকরাম-লতিফও। বাকি অভিযোগটিতে (৬ নম্বর) তিনি খালাস পেয়েছেন আকরামের সঙ্গে।

আকরাম তার তিন অভিযোগের মধ্যে প্রমাণিত একটিতে (৭ নম্বর) আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন, যেটিতে প্রয়াত লতিফ তালুকদারও অভিযুক্ত ছিলেন। সিরাজ-লতিফের সঙ্গে থাকা একটিতে (৫ নম্বর) সিরাজের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হলেও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি তার বিরুদ্ধে। প্রয়াত লতিফের সঙ্গে থাকা অন্য অভিযোগটিও (৬ নম্বর) প্রমাণিত হয়নি তার বিরুদ্ধে। ফলে দু’টি অভিযোগের দায় থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে আকরামকে।

বাগেরহাটের রনজিৎপুর (১ নম্বর) গণহত্যা, ডাকরা (২ নম্বর) গণহত্যা, কান্দাপাড়া (৩ নম্বর) গণহত্যা,  চুলকাঠি (৪ নম্বর) গণহত্যা শাঁখারিকাঠি বাজার(৫ নম্বর) গণহত্যাসহ ৮ শতাধিক মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন রাজাকার কমাণ্ডার সিরাজ। তার সহযোগী আকরামকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের তেলিগাতীতে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদারকে আটক করার পর তাকে নির্যাতন করে হত্যার দায়ে  (৭ নম্বর)।

মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) এ রায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। বেলা ১১টা ৫ মিনিট থেকে ১২টা ২৪ মিনিট পর্যন্ত ১৩৩ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়েন বিচারকরা।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় সিরাজ মাস্টার ও আকরামকে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, অভিযুক্ত সিরাজ মাস্টার একাত্তরে হত্যা করে উল্লাস প্রকাশ করতেন। তিনি তার অপরাধের জন্য অনুতপ্তও হননি। তাই তিনি কোনো অনুকম্পা পেতে পারেন না। সর্বোচ্চ সাজাই তার প্রাপ্য।

এ রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করলেও সংক্ষুব্ধ আসামিপক্ষ বলেছেন তারা আপিল করবেন।

মামলার প্রসিকিউটর সাইয়েদ্যুল হক সুমন বলেন, কসাই সিরাজ মাস্টারের যে রায় হয়েছে তা যথাযথ। তিনি ১৯৭১ সালে প্রতিদিন একজন করে মানুষ হত্যা করতেন। তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন, শিক্ষক এতো নিচে নামতে পারেন আমরা এটা ভাবতে পারি না। কিন্তু তিনি তা করেছেন।

অপরদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত শেখ সিরাজুল ইসলামের (সিরাজ মাস্টার) আইনজীবী আবুল হাসান বলেন, এ রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। রাজাকার কমান্ডারের অভিযোগের সপক্ষে কোনো দলিল দেখাতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষ। আসামিপক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে আপিল করা হবে। খান আকরাম হোসেনের আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। আপিলের প্রস্তুতি নেওয়া হবে এখন থেকেই।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কচুয়ার শাঁখারিকাঠি বাজারে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় ওই তিনজনসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। গত বছরের ১০ জুন তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ১১ জুন আব্দুল লতিফ তালুকদার, ১৯ জুন আকরাম হোসেন খাঁন ও ২১ জুলাই সিরাজ মাস্টারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৫ নভেম্বর তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ৩২ জন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী তাদের বিরুদ্ধে এবং ৫ জন সাফাই সাক্ষী পক্ষে সাক্ষ্য দেন।

পাঁচ গণহত্যায় সিরাজের ফাঁসি
শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে প্রমাণিত ও মৃত্যুদণ্ড পাওয়া পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম চারটিতে একা অভিযুক্ত করা হয় তাকে। পঞ্চমটিতে তিনজনই অভিযুক্ত হন।

প্রমাণিত প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৩ মে বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা বাগেরহাটের সদর থানার রনজিৎপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়ি-ঘর লুণ্ঠন করে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় নিরস্ত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৪০/৫০ জনকে হত্যা করা হয়।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২১ মে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২/৩ হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাগেরহাটের রামপাল থানার ডাকরার কালীমন্দিরে  জড়ো হন। সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এ হামলা চালিয়ে সেদিন ৬/৭শ’ জনকে হত্যা করা হয়।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৮ জুন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগেরহাটের সদর থানার বেসরগাতী, কান্দাপাড়া ও কান্দাপাড়া বাজার এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ, নিরস্ত্র ২০ জনকে অপহরণের পর তাদেরকে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। পরে তাদের মধ্য থেকে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়। একজন ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান।

চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বাগেরহাটের সদর থানার চুলকাঠিতে হামলা চালিয়ে ৫০টি বাড়ি লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওইদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭ জন নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা।

তিনজনকেই অভিযুক্ত করে পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগেরহাটের কচুয়া থানার শাখারিকাঠি হাটে হামলা চালিয়ে অভিযুক্তরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৪২ জন নিরীহ, নিরস্ত্র লোককে আটক করেন। পরে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করেন। এছাড়া তাদের বাড়ির মালামাল লুণ্ঠনের পর অগ্মিসংযোগ করেন। এসব অপরাধ সংঘটিত করেন আসামিরা।

আকরামের সাজা যে অভিযোগে
খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারকে অভিযুক্ত করে সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের তেলিগাতীতে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদারকে আটক করার পর তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেন আসামিরা।

প্রমাণিত হয়নি যে অভিযোগ
তিনজনকেই অভিযুক্ত করে ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাগেরহাটের কচুয়া থানার বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরস্ত্র ৫ জনকে অপহরণ ও আটক করে সিরাজসহ তিনজনের নেতৃত্বে রাজাকাররা। পরে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ১১, ২০১৫

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.