শিক্ষা-সংস্কৃতি

বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে আবারও সিন্ডিকেটের চেষ্টা

প্রাথমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ নিয়ে আবারও সিন্ডিকেট তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। বেশি দর নির্ধারণ করে দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ না পাওয়ার আশঙ্কায় এই সিন্ডিকেট তৈরির চেষ্টা করছেন মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। অন্যদিকে সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে সিন্ডিকেট করতে না দেওয়ার পক্ষে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এর ধারাবাহিকতায় এনসিটিবির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২২ জুন) প্রেস মালিকদের একটি বড় অংশ সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন– ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের দরপত্রে দুটি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান মেশিনের বিপরীতে বহুগুণ বেশি কার্যাদেশ দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। এনসিটিবি বলছে– মূল্যায়ন কমিটি এখনও মূল্যায়ন করছে। মূল্যায়ন শেষ করার আগেই কে কম আর কে বেশি কাজ পাবে তা বলার সুযোগ নেই। পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা) অনুযায়ী কাজ পাবেন প্রেস মালিকরা।

সিন্ডিকেট ভাঙতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২১ সালে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে নতুন একটি শর্ত যোগ করে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। শর্তে বলা ছিল– আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ওয়েব প্রিন্টিং মেশিনের সক্ষমতা বেশি থাকলে তাদের বেশি কাজ দিতে হবে।

২০২১ সালের ২০ মে দরপত্রের নির্ধারিত শর্ত বাতিল চেয়ে পুরাতন মেশিন পরিচালিত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠাগুলোর পক্ষে প্রিয়াংকা প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস হাইকোর্টে রিট করে। তবে হাইকোর্ট বিভাগ রিট আবেদনটি খারিজ করেন।

রিটের আদেশে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে একটি কাজে সরকারের ৫৪ কোটি ৪০ লাখ ৩ হাজার ৬১ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। অন্যদিকে, এনসিটিবি’র একটি সূত্র জানায়, সিন্ডিকেট ভেঙে যাওয়ায় চারটি কাজে গত তিন বছরে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এ বছর বেশি দরে দরপত্র আহ্বানে কাজ না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে নতুন করে সিন্ডিকেটের চেষ্টা করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রেস মালিকদের কিছু বলার থাকলে প্রথমে তারা বলবেন এনসিটিবি’র সদস্য, সচিব ও মূল্যায়ন কমিটিকে, যারা এসব কাজে জড়িত। কেনও চেয়ারম্যানের কথা বলা হচ্ছে? কারণ আমি সিন্ডিকেটে যেতে চাচ্ছি না। তারা সিন্ডিকেট করতে চাচ্ছেন কিন্তু আমি দেইনি। প্রয়োজনে উচ্চ তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করবো, মানহানির মামলা করবো। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বিষয়টি দেখবে। মূল্যায়ন কমিটি এখনও মূল্যায়ন শেষ করেনি, কাজ চলছে। মূল্যায়ন ঠিক না হলে তারা আপিল করতে পারবেন। তাছাড়া মূল্যায়ন ঠিক না হলে ক্রয় কমিটি রয়েছে। অথচ আগেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব করা হচ্ছে।’

সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেট করতে চাওয়া প্রেস মালিকরা বলতে চাচ্ছেন মেশিন বেশি দেখিয়ে কাজ দেওয়া হচ্ছে। দুই বছর আগেও একই অভিযোগ করেছিলেন তারা। তখন মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসহ ১০ জন একসঙ্গে মেশিন দেখতে গিয়েছিল। সবকিছু ঠিক থাকলেও বারবার তারা অযথা দাবি তোলে। মূল্যায়ন চলাকালে সংবাদ সম্মেলন একটি অপরাধ। মূল্যায়নকে প্রভাবিত করতে এটি করা হচ্ছে। তারা সক্ষম প্রেস মালিকদের ভয় পান। যাদের মেশিনের কোয়ালিটি ভালো, বেশি ছাপার সক্ষমতা রয়েছে তাদের ভয় পান। সে কারণে সিন্ডিকেট করতে চান অনেক প্রেস মালিক। তারাই হাইকোর্টে গিয়েছিলেন, হাইকোর্টের আদেশ রয়েছে যাদের মেশিনারিজের ক্ষমতা যেমন তারা সেরকম কাজ পাবেন। এখন আমি সিন্ডিকেটের কথা শুনে আদালত অবমাননার ঝামেলায় যাবো কেন? লোয়েস্টকে কাজ না দিয়ে আমি হাইয়েস্টকে কেন কাজ দিয়ে বিপদে পড়বো?’

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, সিন্ডিকেট প্রেস মালিকরা লিস্ট অনুযায়ী কাজ দেওয়ার দাবি জানিয়ে এনসিটিবিকে চাপ দিচ্ছেন। চেয়ারম্যান সম্মত না হওয়ায় সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। তবে চাপ দেওয়া হলেও পিপিআর অনুযায়ী কাজ দেওয়া হবে। সিন্ডিকেট করতে দেবে না এনসিটিবি।

প্রেস মালিকদের সংবাদ সম্মেলনে এনসিটিবি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে জানানো হয়, মুদ্রণ শিল্প সমিতির সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দরপত্র সংশোধন করেন চেয়ারম্যান। এতে মুদ্রণ সক্ষমতার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দুটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার বেশি কাজ দেওয়া হয়। অগ্রণী প্রিন্টার্স ও কচুয়া প্রিন্টার্সকে বেশি কাজ দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়।

অগ্রণী প্রিন্টিংয়ের সত্ত্বাধিকারী কাওসারুজ্জামান অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দরপত্র নিয়ে আমাকে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমি অনৈতিক পথে হাঁটিনি। গত তিন-চার বছর ধরে আমাকে একই ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। তা না মানায় আমাকে টার্গেট করা হয়েছে। এই খাতে কারা সিন্ডিকেট করে সরকারের অর্থ লুটে নেয়, তা গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা জানেন।’

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক স্তরের সব বইয়ের দরপত্র ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। আর মাধ্যমিক স্তরের কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।