সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের
ঢাকা জার্নাল : ‘অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/হৃদয়ে লাগিল দোলা,/ জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা—,/ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর/ অমর কবিতাখানি:/ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’
‘স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামের এ কবিতায় কবি নির্মলেন্দু গুণ যে কবির কথা বলেছেন তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর যে বিশেষ দিনের বঙ্গবন্ধুকে চিত্রায়িত করেছেন সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। আবার সেই দিনটি ফিরে এসেছে বাঙালির জাতীয় জীবনে।
শুক্রবার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ৭ মার্চ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো মানুষের সামনে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর সেই বজ্রকণ্ঠ আজও বাঙালির রক্ত শানিত করে। সেদিন ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগানে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিচ্ছেন। মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা।’
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ মার্চের ভাষণই একমাত্র প্রাণশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আর এ কারণে ৭ মর্চের নিকট অতীত জানা জরুরি। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের তখন বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়কে। বাঙালি হাজার বছর ধরেই অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ও আত্ম অধিকারের জন্য আপসহীন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন মনে না রেখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাঙালির অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও অনেক রক্তের পথ ধরে বাঙালি নেতৃত্বের কাছে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা আসছে—এমন এক মুহূর্তে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা স্তম্ভিত করে দেয় বাঙালিকে। বঙ্গবন্ধু বুঝেছেন বাঙালিকে তাদের অধিকার দেবে না শাসকরা। নির্বাচনে বিজয়ী হলেও ক্ষমতা দেয়নি আওয়ামী লীগকে।
ঘোর কাটতে দেরি হলো না। জ্বলে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান। মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলন ডেকে ২ মার্চ ঢাকা শহরে এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। ৬ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় অর্ধবেলা হরতাল চলে। একই সঙ্গে ৭ মার্চ সে সময়ের রেসকোর্স ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণেই মূলত মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু যার যা আছে তা-ই নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর সেই আহ্বানেই মূলত বেগবান হয় আন্দোলন, যারই ধারাবাহিকতায় অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের সেই ভাষণ এখনো উজ্জীবিত রাখে বাঙালিকে।
বাণী : দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঐতিহাসিক সেই ভাষণ এ দেশের গণমানুষকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে এবং তাঁদেরকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিপুলভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক। ঐতিহাসিক ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ মহান স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে তাই ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করা ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন। আমাদের মহান নেতার সে স্বপ্ন পূরণ করতে সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষাসহ নানা সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, ৭ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’।
ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার গণমানুষের প্রাণের দাবি ধ্বনিত হয়। গোটা জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। এ ভাষণে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র ফুটে ওঠে। শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অসন্তোষ ও সংক্ষুব্ধতা প্রকাশ পায়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আবশ্যকতা ও আকাঙ্ক্ষা এ ভাষণের পরতে পরতে ধ্বনিত হয়। শত্রু মোকাবিলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’। জাতির পিতার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা শুরু করে। জাতির পিতা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও বহু ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করি।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এ ঐতিহাসিক ভাষণ।
ঢাকা জার্নাল, মার্চ ৭, ২০১৪।