সহযোদ্ধাদের কাছে বিপুল যেমন ছিলেন বিপুল ভট্রাচার্য
সিয়াম আনোয়ার: শুক্রবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে না ফেরার দেশে চলে গেলেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী বিপুল ভট্টাচার্য। ধানমন্ডির আহমেদ মেডিক্যাল সেন্টারে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর। ২০১০ সাল থেকে এই শিল্পী ক্যান্সারে ভুগছিলেন। এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন তার দীর্ঘ সংগীত জীবেনর সঙ্গীরা। তেমনি কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হল এখানে।
ফকির আলমগীর
বিপুল ভট্রাচার্য শুধু স্বাধীন বাংলার শিল্পী বা লোক গানের শিল্পীই নন, একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ছিলেন। বিপুলের এই মৃত্যুক্ষণে আমার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ষাটের দশকের সেই উম্মাতাল সময়ে গাওয়া ওর গান কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তির গানে তার হিরো হয়ে যাওয়া। অসাধারণ গলা ছিল বিপুলের। সারা পৃথিবী তার চেতনাদৃপ্ত সেই গান গুলো স্মরণ করবে আজীবন।
বাংলার ইতিহাস লিখতে হলে বিপুলকে নিয়ে লিখতে হবে। এমন এক অনন্য জীবন সে রেখে গেছে। রবীন্দ্র-নজরুল-লোক-গণ সবধরণের সঙ্গীতে তার দখল ছিল। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে আমরা সাংস্কৃতিক দল নিয়ে জেলায় জেলায় সফর করেছিলাম। সেখানে আরো কাছ থেকে দেখলাম একজন অন্য বিপুল ভট্রাচার্যকে। ছায়ানট আজ তাকে বিদায় জানাল ‘আগুনের পরশমণি ছোয়াও প্রাণে’ দিয়ে। এই দেশের প্রাণে বিপুল যে পরশ বুলিয়ে গেছে, জ্বালিয়ে গেছে অসাম্প্রদায়িকতা আর সুস্থ সংস্কৃতির আলো সে আলোয় আলোকিত হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। প্রগতিশীল মানুষের মৃত্যু নেই। মৃত্যু নেই বিপুলেরও।
তিমির নন্দী
মুক্তিযুদ্ধে কণ্ঠযুদ্ধের বিপুল আমার সহযোদ্ধা। কিন্তু আমার একজন বন্ধুও। ১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান কম্পিটিশনে পল্পী গানে আমি হয়েছিলাম দ্বিতীয় আর বিপুল প্রথম। সেই থেকে আমাদের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব।
একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে দেশের জন্য তার অবদান সবাই জানেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠের বিপুলের মতো লোকগানও খুব কম মানুষই গেয়েছে। আবদুল আলীম ছিলেন একজন, আরেকজন আমাদের বিপুল ভট্রাচার্য।
বিপুলের মৃত্যুতে আমরা হারালাম এ দেশের ইতিহাসের একজন সাক্ষীকে।
খুব খারাপ লাগছে বিপুলের পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া এই সময়ে আমি ঢাকার বাইরে। গত রাতেও ফেসবুকে ওকে নিয়ে একজনের সাথে কথা হচ্ছিলো। অনেক আগে থেকেই অসুস্থ। অসুস্থ হওয়ার পরপরই ওকে নিয়ে বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। সবসময় চেষ্টা করেছি কিছু একটা করতে।
কল্যাণী ঘোষ
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বাইরে আমার একটা সংগঠন ছিল। ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠি’ নামের সেই গানের দলের অন্যতম সদস্য ছিল বিপুল। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মতবাদ তৈরীর জন্য কাজ করেছি বিপুল ছিল অগ্রগামীদের একজন। পরবর্তী সময়ে বিপুলকে দেখেছি একজন বিনয়ী আর আন্তরীক মানুষ হিসেবে।
দলের ৩০-৩৫ জনের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছিল যে বিপুল সে আজ আরো অনেকের আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। দেশকে আরো অনেক কিছু দেয়ার ছিল তার। আবদুল আলীমের পর আমরা লোকগানের সেরা দরাজ গলা পেয়েছি বিপুলের মাঝে। আমাকে মায়ের চেয়ে বেশি জানতো বিপুল। আমি বেঁচে আছি অথচ ও চলে গেল। খারাপ লাগছে আর বারবার ভেসে উঠছে এক কিশোর বিপুলের কথা আমাদের সাথে ঘুরে ঘুরে গান করেছে একাত্তরের ওই উত্তাল সময়ে।
খায়রুল আনাম শাকিল
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাকে আমরা মুক্তির গানের শিল্পী হিসেবে জানি। জীবনের পড়ন্ত সময়ে তাকে আমি পেয়েছি শিক্ষকতায় সহকর্মী হিসেবেও। ছায়ানটে শিক্ষকতা করেছেন এই শেষ সময় পর্যন্তও। গত কয়েক মাস প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিন বছর ধরে তিনি রোগে আক্রান্ত। অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী এই মানুষটির মৃত্যু একা আমাকে না, শোকাচ্ছন্ন করেছে পুরো জাতিকেই। হাসিমুখে কথা বলা, মার্জিত আচরণ, দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশে নেয়া – সবকিছু মিলিয়ে এক দারুণ মানুষ ছিলেন বিপুল ভট্রাচার্য। তার মৃত্যুতে দেশ হারাল একজন দেশপ্রেমিক, শিক্ষক আর বিশিষ্ট শিল্পীকে।
বাংলাদেশ সময় : ১৪১২ ঘণ্টা, ০৫ জুলাই, ২০১৩
ঢাকা জার্নাল, জুলাই ৫, ২০১৩।
সূত্র বাংলানিউজ