মায়ের কোনো ছুটি নেই

জানুয়ারি ২৯, ২০১৪

OLYMPUS DIGITAL CAMERAউম্মে মুসলিমা: ছোটবেলার পুতুলখেলার দিনগুলি ছাড়া নারীর জীবনে বুঝি আর কোনো ছুটি নেই। আবার যে সকল মেয়েশিশু বড় বড় শহরের বস্তিতে বা রাস্তার ধারের খুপচিতে বেড়ে ওঠে তাদের পুতুলখেলার বয়সও নেই। তারা ঐ বয়সে হয় মানুষের বাসায় কাজে লেগে যায় নয় তো কোন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের জন্য নিয়োজিত হয়। তার পরেও নারীর ছুটি যে কদিনের তা ঐ শৈশবেই।

আগেকার দিনে নারীর কোন শৈশবও ছিল না। শুধু বাল্যবিয়েই নয় Ñ মায়ের পেটে থাকতেই অনেকের বিয়ে হয়ে যেত। বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ নায়িকাই এ যুগের বিবেচনায় শিশু ছিলেন। শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ নায়িকার বয়স আঠোরো থেকে ছাব্বিশের মধ্যে হলেও সেসময়কার সমালোচকদের চোখে এরা ছিলেন যৌবন উত্তীর্ণা।

রাষ্ট্রীয় আইনে আঠারো বছরের নিচে এ দেশে মেয়েদের বিয়ে আইনসিদ্ধ নয়। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে এ নিয়ম মানছে কে? গড়পড়তা মেয়েদের ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। এরকম বয়েসের মধ্যেই তাদের মা হবার হাতেখড়িও হয়ে যায়। বিয়ে হয়ে গেলেই একজন নারীর কাঁধে চলে আসে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব, সে বালিকাবধূই হোক আর যুবতীবধূ। কাজ করতে করতেই এসে যায় সন্তান। সন্তান জন্মানোর পর তো ফুরসতই মেলে না। সন্তান লালন-পালনে আবার পুরুষতান্ত্রিকতার নিয়ম মেনে চলতে গিয়ে কাজের বোঝা হয় দ্বিগুণ। সন্তান জন্মদানের আগে নারীকে সংসারের যেসকল কাজ করতে হয় জন্মদানের পরেও সেগুলো একই নিয়মে করা লাগে।

আগের দিনের বিবাহোপযুক্ত ছেলেরা টোপর-পাগড়ি পরে মাকে সালাম বা প্রণাম করে যাওয়ার সময় বলে যেত -‘মা চললুম তোমার জন্যে বাঁদি আনতে’।

সেই বাঁদির উদয়াস্ত পরিশ্রম শুরু হয়ে যেত শ্বশুরালয়ে পা দেবার প্রথম দিন থেকেই। তাহলে নারীর অবসর কবে? গ্রামের কৃষাণরা দিনশেষে মাঠ থেকে ফিরে দাওয়ায় বসে হুঁকো টানে বা যাত্রাপালা-টালাও দেখতে বেরোয়, কিন্তু কৃষাণী তখন কুঁপি জ্বালিয়ে র্ন্নাা করে, বাচ্চার দেখাশুনা করে, বীজতলা সামলায়। পহেলা বৈশাখ বা দেশীয় কোন উৎসবে গুণী আলোচকরা বিভিন্ন সংবাদ বা বিনোদন মাধ্যমে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন Ñ আগেকার দিনের গ্রামের নারীরা অবসরে নকশি কাঁথা সেলাই করতো, পাটি বুনতো, শিকা বুনতো, ঝুঁড়ি বানাতো। আজ সেগুলোই শ্রমবাজারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বয়ে আনছে। কিন্তু যা সত্যি তা হলো Ñ ঐসকল গ্রামীণশিল্প কোনদিনই নারীর অবসর কাটানোর বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে বেরিয়ে আসেনি। নারী কাঁথা বানিয়েছে প্রয়োজনে। শাড়ির আকৃতি ও প্রকৃতি কাঁথা বানানোর উপযোগী বলে নারীর উদ্ভাবনী ক্ষমতায় তা অন্যভাবে রিসাইকেলে পরিণত হয়েছে। হ্যাঁ, মানুষের মনে গোপনে শিল্পী বাস করে বলে সেসকল কাঁথা, শিকা বা ঝুঁড়িতে নান্দনিকতা ছাপ ফেলেছে কিন্তু তা নির্ভেজাল অবসরের উৎপাদন – তা ভাবার কোন কারণ নেই।

মায়ের কোন ছুটি নেই। সমাজে অনেক মায়েরা আছেন যাদের, ছেলে মেয়েরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বড় বড় শহরে থাকে। ওরা নিজেদের কাছে এসে মাকে থাকতে বললেও মা রাজি হন না। তার কাছে গ্রামই ভালো। তিনি ছেলে বউদের অসুবিধার কারণ হতে চান না। কিন্তু একা গ্রামে থাকেন বলেই কি তিনি রাতদিন বসে থাকেন? ঈদে-পার্বনে ছেলেমেয়েরা বউ জামাইসহ নাতি নাতনিদের নিয়ে আসে। তার প্রস্তুতিই চলে তিনমাস ধরে। তারপর চলে গেলে আবার গোছগাছ। নাতি নাতনিদের জন্য হরেক পদের আচার বানিয়ে রাখা, বউঝিদের পুরনো শাড়ি দিয়ে কাঁথা সেলাই করতে দেয়া, চালের গুড়ি, ডালের বড়ি, পিঠা, সরিষার তেল, গাছের ফলমূল জোগাড় করে শহরে ছেলেমেয়েদের বাসায় পাঠানোর আয়োজন করতেই বছর ঘুরে যায়। ছেলেরা বলে Ñ এসব করার জন্যে তোমাকে গ্রামে পড়ে থাকতে হবে না। আজকাল পয়সা দিলে শহরেও সব মেলে। কিন্তু মায়েরা কি কেবল দায়িত্ববোধ থেকেই এতোসব করেন? তার শরীরের প্রতিটি কোষে মিশে আছে সন্তান সন্ততিদের মঙ্গল কামনা। ভালো থাকা। আনন্দে থাকা। এই তাড়না থেকেই তো তারা দিনরাত ছুটে বেড়ান। এ যে মায়ের সহজাত বেদনা। মরে না যাওয়া পর্যন্ত এর থেকে ছুটি আছে? 

অথচ এই মায়ের কথা আমরা ব্যস্ততার জন্যে ভুলে যাই। যে মা নাড়ির মতো জড়িয়ে আছে সব সন্তানের ভালো মন্দে তার জন্যে একদিন মা দিবস করে আমরা তাদের ফুল পাঠাই। একা কোন গ্রামের কোন গৃহকোণে, বা পরিজনহীন একাঘরে বা বৃদ্ধাশ্রমে মা জপমালার মতো জপতে থাকে ‘খোদা, আমার সন্তানরা যেন ভালো থাকে, সন্তানরা যেন সুস্থ থাকে, নিরাপদ থাকে’। মায়ের এই আমৃত্যু শুভকামনার বদলে আমরা কজন মোবাইলে একবার মা দিবসে বলতে পারবো ‘মাগো তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, আমাদের অকৃতজ্ঞতা ক্ষমা করো’।

(শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.