বিনম্র শ্রদ্ধায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করছে জাতি

ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪

শহিদমিনার-400x200বিনম্র শ্রদ্ধায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করছে জাতি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পমাল্য অর্পন করেছেন।

রাত ১২টা ১ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পনের মাধ্যমে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তারপরই প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তিনি দলীয় প্রধান হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়েও শ্রদ্ধা জানান।

এ সময় শহীদ মিনার এলাকায় মাইকে বাজতে থাকে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” সেই চিরাচরিত গান।

এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া। তাদের পর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংসদের চিফ হুইপ আ. স. ম ফিরোজ। এ সময় ১৪ দলের নেতারাও মো. নাসিমের নেতৃত্বে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

তারপর সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পন করেন শহীদ মিনারে। একে একে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি মিশনের রাষ্ট্রদূত ও কর্মকর্তা এবং  তিন বাহিনীর প্রধান ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসেসিয়েশন, গণজাগরণ মঞ্চসহ আরো অনেকে একুশের প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধা জানান শহীদ মিনারের পাদদেশে।

এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

শহীদ মিনার ৩অমর একুশে আজ শুধু আর বাঙালি জীবনে সীমাবদ্ধ নেই। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় একে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।

একুশের ভোর থেকেই সারাদেশে শুরু হয় প্রভাত ফেরি।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল বন্ধ করতে পুলিশ গুলি ছোঁড়া শুরু করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারী আব্দুল জব্বার ও রফিক উদ্দীন আহমেদ ঘটনাস্থলেই মারা যান। সেদিন আত্মাহুতি দেন আব্দুস সালাম, আবুল বরকত। মাত্র ৮/৯ বছর বয়সী কিশোর অহিউল্লাহও পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ২২ ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমানসহ অনেকেই জীবন উৎসর্গ করেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথভাবে উদযাপনের জন্য সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এদিন দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এ দিন সরকারি ছুটির দিন।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।

বাণীতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী মহান ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক ও অতীব তাৎপর্যপূর্ণ দিক তুলে ধরেন।

ভাষা আন্দোলন মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পাশাপাশি জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষারও আন্দোলন বলে অভিহিত করেন রাষ্ট্রপতি।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিটি বাঙালির শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে সব সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন, রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও ব্যাপক অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দ্বীপসমূহ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বর্ণমালা সম্বলিত ফেস্টুন দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে।

আজিমপুর কবরস্থান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত রাস্তায় অতিরিক্ত জনসমাগম ও ভীড় নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিচ্ছে।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি শহীদ মিনার, আজিমপুর কবরস্থান ও সংলগ্ন এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে।

বাংলা একাডেমীতে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মাসব্যাপী বইমেলা চলছে। শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট শহীদ দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, নান্দনিক হস্তাক্ষর লেখা প্রতিযোগিতা ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম চত্বরে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা শহীদ মিনার সংলগ্ন এলাকায় ১০টি পয়েন্টে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শহীদ মিনার এলাকায় ১০টি ভ্রাম্যমান টয়লেট স্থাপন করা হয়। জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে শহীদ মিনার এলাকায় এবং বাংলা একাডেমী বইমেলা চলাকালীন সময়ে ৩টি সার্বক্ষণিক চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাদ্রাসাসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করছে। দেশের সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।

দেশের সব জেলা ও উপজেলা সদরে দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করছে। বিদেশে অবস্থিত মিশনগুলোতেও শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে।

একুশের অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেশের সর্বত্র নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী

মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলা ভাষাভাষীসহ বিশ্বের সব ভাষা ও সংস্কৃতির জনগণকে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিটি বাঙালির শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক। ১৯৫২ সালে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দিন, সালামসহ আরও অনেকে।

আজকের এই দিনে আমি ভাষা শহিদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সকল ভাষা সৈনিকের প্রতি।

১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট ডাকে। এদিন সচিবালয়ের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। ১৫ মার্চ তাঁরা মুক্তি পান। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

এই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল আবারও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জুলাই মাসের শেষে তিনি মুক্তি পান। ১৪ অক্টোবর ঢাকায় বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে থেকেই তাঁর দিকনির্দেশনায় আন্দোলন বেগবান হয়। সেই দুর্বার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি শাসকগোষ্ঠীর জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে প্রাণ দেন ভাষা শহীদরা।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারির সেই রক্তস্নাত গৌরবের সুর বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মানুষের প্রাণে অনুরণিত হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কানাডা প্রবাসী সালাম ও রফিকসহ কয়েকজন বাঙালি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়ে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করে। যার ফলশ্রুতিতে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

আজ বিশ্বের সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

বিশ্বের ২৫ কোটির বেশি মানুষের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।

বিশ্বের সকল ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা এবং ভাষা সংরক্ষণের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি।

অমর একুশে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। একুশের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। গত পাঁচ বছরে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জন করেছি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ইতিহাস ২০০৯ থেকে ২০১৩ ছিল একটি স্বর্ণযুগ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.