বসফোরাসে ভাসমান সন্ধ্যায় ঈদ আয়োজন

জুলাই ৩০, ২০১৪

ছবি : লেখক

ছবি : লেখক
ফারুক মঈনউদ্দীন :  সন্ধ্যার জন্য বিখ্যাত বসফোরাস ক্রুজের বুকিং দিয়েছিলাম হোটেলের কাউন্টারে। ওরা জানালো ঠিক সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে ট্যুর বাস এসে হোটেলের লবি থেকে তুলে নিয়ে যাবে। সুলতান হামেৎ-এর লা-লেলি অংশটাতে যে রকম ট্রাফিক-ব্যস্ততা দেখেছি, তাতে এ রকম কাঁটায় কাঁটায় সময় বেঁধে দেওয়া অবাক করা বিষয়ই বটে। আর আজ দুপুরে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে তুর্কিদের যা সময়ানুবর্তিতা দেখলাম, তাতে লা লেলির ভিড় না থাকলেও আমার সন্দেহ ঘুচত না। ইস্তাম্বুল যখন নামি তখন আমার পকেটে নগদ বিশ ডলার দিয়ে নেওয়া ই-ভিসা, যদিও অ্যারাইভাল ভিসা মেলে আমাদের জন্য, যদি পরবর্তী গন্তব্য ইউরোপ বা আমেরিকা হয়। ভাবি এই বিশ-ডলারি ভিসাটির জন্য আমাকে অ্যারাইভাল ভিসার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে না। কিন্তু যাকেই কাগজটি দেখাই সে-ই আমাকে দীর্ঘ সর্পিল এক মনুষ্যসারির দিকে পথ দেখায়। সারিটি হচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ার নাগরিকদের জন্য। অগত্যা লাইনের পেছনে দাঁড়ানোর প্রথম দিকে মোটামুটি গতি থাকলেও কিছুক্ষণ পর লাইন আর আগে বাড়ে না। মাথা উঁচিয়ে দেখি এতক্ষণ তিনটি ইমিগ্রেশন কাউন্টার চালু ছিল, এখন মাত্র একটি। সেখান দিয়ে হুইল চেয়ারের যাত্রী, ক্রন্দনরত শিশুকোলে মা এবং বৃদ্ধ দম্পতিসহ সবাই বিশেষ বিবেচনায় পার হয়ে যাচ্ছে, ফাঁকে ফাঁকে ডাক আসছে আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের। সেদিন ছিল শুক্রবার, ভাবলাম জুমার নামাজ পড়তে গেছেন বুঝি ইমিগ্রেশনের অফিসাররা, কিন্তু নামাজের সময় শেষ হওয়ার পরও দ্বিতীয় কোনো কাউন্টারে লোক আসে না। ভেতর দিক থেকে অফিসাররা গদাইলস্করি চালে এসে এদিক-সেদিক কোথাও যেন উধাও হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ শূন্য কাউন্টারগুলোর দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র করে না। তখন উপলব্ধি করতে পারি, মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্ককে ইউরোপের মতো আধুনিক করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের তুর্কি স্বভাব বদলাতে পারেননি। অথবা এশিয়া-আফ্রিকার নাগরিকদের জন্য এদের এমনই এ রকম হেলাফেলা অবস্থা।

শেষপর্যন্ত প্রায় আড়াই ঘণ্টার জিল্লতি পোহানোর পর ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলের রিসেপশনে এসে আরেকটা ঝামেলা বাঁধে। অ্যাগোডা নামের হোটেল বুকিং সাইটটির মাধ্যমে অগ্রিম ভাড়া মিটিয়ে এই হোটেলে রিজার্ভেশন করে এসেছি, অথচ কাউন্টারের লোকটি আমতা আমতা করে বলে, ইয়ে মানে, আমাদের এখানে সামান্য একটা সমস্যা হয়েছে, আপনাকে আমাদের ঠিক পাশের বিল্ডিংয়ে অন্য একটা রুম দেখাচ্ছি আরও বড়, দেখুন পছন্দ হয় কি-না।  একজন বেল বয় আমাকে পাশের বিল্ডিংয়ে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ির নিচে একটা বন্ধ রুম চাবি দিয়ে খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বলাবাহুল্য বেসমেন্ট ফ্লোরের ইঁদুরের অভয়ারণ্য বলে মনে হওয়া সেই বিকল্প আবাসনে রাজি না হয়ে আমি হোটেলের লবিতে ফিরে আসি। লোকটা আমার গনগনে চেহারা দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পারে বোধহয়। তার ধারণা সঠিক প্রমাণ করে একটা কঠিন ঝাড়ি দিলে আমাকে ঠিকই ভিজে বেড়ালের মতো এটা রুম দিয়ে দেওয়া হয়। বুঝতে পারি আমাকে অন্য জায়গায় পাঠাতে পারলে বুকিং কোম্পানির সস্তায় বুক করে রাখা রুমটি তারা হয়তো বেশি দামে কারও কাছে ভাড়া দেওয়ার ধান্দা করার কথা ভাবছিল। এখানেও তুর্কি স্বভাব নিয়ে আমার মনে আবারও একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে।

অতএব ঠিক সময়ে বাসটি এসে পৌঁছাবে সে ভরসা না থাকলেও ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ৭টা ৩৫ মিনিটে লবিতে নেমে দেখি দুপুরের সেই ছেলেটিই তখনও কাউন্টারে। চেক ইন করার সময় আমার সঙ্গে যে ঝামেলা করেছিল, ওর ভাব দেখে মনে হলো এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ওকে জিজ্ঞেস করলে জানায় যে কোনো সময় চলে আসবে বাস, বলে, আপনি বরং এখানেই অপেক্ষা করতে থাকুন। ইস্তাম্বুলে আসাটা এবার আমার ঘোড়ার জিন চাপিয়ে আসার মতো বলে লবিতে বসে না থেকে সামনের রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ইস্তাম্বুলের এই এলাকাটির চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টায় উঠে পড়ি আমি। ঘড়ির কাঁটা ৮টার ঘর ছুঁই ছুঁই করলে কাউন্টারে আবার খোঁজ নিতে যাই। রিসেপশনিস্টের সঙ্গে আমার কথাবার্তা শুনতে পেয়ে উলুক-ঝুলুক লং স্কার্ট পরা এক মধ্যবয়সী মহিলা এগিয়ে এসে বলে, ওহ, আমরাও তো অপেক্ষা করছি এই বসফোরাস ক্রুজের বাসের জন্য। ভালোই হলো, এই হোটেল থেকে পরিচিত একজন থাকবে আমাদের সঙ্গে। লবির কোনায় বসে শান্তশিষ্ট চেহারার এক লোক পত্রিকা পড়ছিলেন, মহিলা আমাকে সেদিকে নিয়ে গিয়ে বলে, ফাবলিস, ইনিও আমাদের মতো অপেক্ষা করছেন বাসের জন্য। ভদ্রলোক মুখের ওপর থেকে চশমা সরিয়ে আমাকে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ‘হাই’ বলেন। বোঝা যায় এই নৌবিহারে তার কোনো আগ্রহ নেই, কেবল বউয়ের কথায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হচ্ছে। পরিচয়পর্বে জানা গেল এই ফরাসি দম্পতি দু’জন দু’দিক থেকে এসে ইস্তাম্বুলে মিলিত হয়েছেন। ভদ্রলোক, ফাবলিস উজোলো, ব্যবসার কাজে দেশ-বিদেশ ঘোরেন, এবার সেই সুযোগে তার বউ সোফি ইস্তাম্বুলে এসে পাকড়াও করেছেন স্বামীকে। সোফি উজোলো একজন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট, তার মাধ্যম মূলত মেটাল, আর বিষয় ওয়াইল্ড লাইফ। ছোটবেলা থেকে আফ্রিকায় থাকার কারণেই বোধহয় ওয়াইল্ড লাইফ ওর প্রিয় বিষয়। ফ্রান্সের কানে বিভিন্ন গ্যালারিতে তার শিল্পকর্মের কয়েকটা প্রদর্শনীও হয়েছে। ভদ্রমহিলা ফোনের ক্যামেরায় তোলা তার কয়েকটা শিল্পকর্মের ছবি দেখিয়ে আমার মুখের দিকে নিবিড় মনোযোগে তাকালে আমি শিক্ষকের সামনে পড়া না শেখা ছাত্রের মতো ওর দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রবল  আগ্রহে ফোনের স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়ি। সেখানে মেটালের ওপর হাতি, বাঘ, পান্ডা— এসবের খোদাই করা ছবি। আমি শিল্পকর্মের কী বুঝি, তবুও সমঝদারের মতো প্রশংসাসূচক মাথা নাড়াতে হয়। কিছু একটা বলতে হয় বলেই বলি, বাহ, এ রকম কাজ তো আগে দেখিনি  কখনও। সোফি শিল্পের এই মাধ্যমটি সম্পর্কে আরও কিছু প্রসঙ্গ তুলে আমাকে চরম সঙ্কটে দিতে ফেলে দেওয়ার ভূমিকা শুরু করতেই হোটেলের ডোরম্যান জানায় বাস এসে গেছে।

বাস লা-লেলির ব্যস্ত ট্রাফিক পার হয়ে বসফোরাসের তীর ধরে ছুটতে থাকে। তারপর গোল্ডেন হর্ন নদীর ওপর গালাটা ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে এমিননে নামের একটা ঘাটের পাশে নামিয়ে দেয়। জেটির সঙ্গে বাঁধা বিভিন্ন আকারের ক্রুজ বোট ঝলমলে আলো জ্বেলে বসফোরাসের ছোট ছোট ঢেউয়ের তালে দুলছিল। ঘাটে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে কিছু দালাল শ্রেণির লোক আমাদেরকে তাদের বোটে ওঠার জন্য সাধাসাধি করতে থাকে। তবে সঙ্গে থাকা ট্যুর কোম্পানির লোকেরা আমাদের সরাসরি নির্দিষ্ট বোটে নিয়ে তুলতে শুরু করলে উমেদার গোছের লোকগুলো পিছু হটে যায়।

বোটে ওঠার পরপরই একজন এসে আমাদেরকে বিভিন্ন টেবিলে বসিয়ে দেয়। আমি একা বলে আমাকে একটা ছোট খালি টেবিল দেওয়া হয়। আমি ব্যাজার মুখে একাকী টেবিলটাতে বসে পড়ি। রেস্তোরাঁর  কায়দায় সাজানো মাঝারি হলঘরটার একমাথায় তুরস্কের ট্র্যাডিশনাল সাজে সজ্জিত তিনটা বিশালাকার গুম্ফধারী পুরুষমূর্তি দাঁড় করানো। সেই আলো-আঁধারির ভেতর থেকে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা একটি মূর্তির নীল চোখের তীব্র ঝলকে অস্বস্তি বোধ করলে আমি এদিক-সেদিক তাকাই। ঠিক তখনি অন্যপাশের একটা টেবিল থেকে সোফি হাত ইশারায় আমাকে ওদের টেবিলের একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে সেখানে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে আমার মুখোমুখি চেয়ারে এক গোমড়ামুখো ভদ্রলোক বসা, জানতে চাইলাম ওখানে বসতে পারি কি-না। লোকটি যেন অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সায় দেয়। আমার পাশের চেয়ারে বসা ফাবলিসের দিকে তাকিয়ে সোফি বলে, ভালোই হলো, ফারুক ওখানে বেচারার মতো একা একা বসে থাকত। ফাবলিস বলে, ও ইয়েস, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। বোটটা ঢেউয়ের দোলায় অল্প অল্প দুলছিল। সোফি স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে দুয়েকবার জিজ্ঞেস করে, তুমি ঠিক আছ তো? ফাবলিস যেন কথা এড়ানোর জন্য ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, ঠিক আছে। তারপর আমার দিকে ফিরে বলে, আসলে এ রকম ঢেউয়ের দোলায় আমার মাথা টলে, কিন্তু আজ এখনও অসুবিধা হচ্ছে না। তাহলে প্রথম দেখায় হোটেলের লবিতে বসে নৌবিহারে ভদ্রলোকের অনিচ্ছা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলাম। তাই তাকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য বলি, চিন্তা করবেন না। এখন জেটিতে থেমে আছে বলে দুলছে বোটটা, মাঝনদীতে চলার সময় এ রকম দুলবে না।

এ সময় বোটের এক কর্মচারী এসে জনে জনে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল, কে কোন দেশের নাগরিক। আমাকেও জিজ্ঞেস করার পর ‘বাংলাদেশ’ বললে লোকটা বলে ‘সালামালেকুম’। এবার আমার সামনের গোমড়ামুখোটির জাতীয়তা জানা গেল, ইন্ডিয়ান। বোটের লোকটি সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘নমস্তে।’ সোফি দম্পতির জাতীয়তা শুনে লোকটি ‘বঁ-সুয়া’ (গুড ইভনিং) বলে সম্ভাষণ জানায়। এভাবে সব টেবিল ঘুরে ঘুরে লোকটি বিভিন্ন ভাষায় সম্ভাষণ জানিয়ে যায় যাত্রীদের। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটি আমার সামনে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড দিয়ে স্থাপন করে যায় বাংলাদেশের পতাকা, উল্টোপাশে ভারতীয় পতাকা, সোফিদের সামনে ফরাসি পতাকা, এভাবে সব টেবিল ভরে ওঠে দেশ-বিদেশের পতাকায়। বসফোরাস ক্রুজে বাংলাদেশের পতাকা দেখতে পেয়ে আমার ভেতরটা আর্দ্র হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরে আমাদের সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে যে রকম মন ছোট করে রাখতে হয়, বসফোরাস প্রণালীর এই জলযানটিতে আমাদের লাল-সবুজের পতাকাটা আমার মাথাটা অনেক উঁচু করে দেয়। সব দেশের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশেরটাও যদি না থাকত বসফোরাসের জলে লাফিয়ে পড়েও কি সান্ত্বনা পাওয়া যেত? বিদেশে গেলে মানুষের এসব অনুভূতি বোধ হয় বেশি সংবেদনশীল হয়ে যায়। পতাকাটা পেয়ে আমার সাহসও বেড়ে যায়, তাই একটু প্রগলভ হয়ে সামনের গোমড়ামুখো লোকটিকে বলি, ভালোই হলো, দেখে মনে হচ্ছে আমি আর আপনি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ফ্ল্যাগ মিটিং করছি, বিএসএফ আর বিজিবির মধ্যে যেরকম প্রায়ই হয়ে থাকে। কথাটা শুনে লোকটির মুখ আর একটু গোমড়া হয়ে ওঠে, হয়তো ভাবে আমি এরপর সীমান্তে ফেলানী হত্যা কিংবা বিএসএফের আরও সব খুনখারাপির কথা তুলে বসব। আমার কথায় ব্যঙ্গের কোনো সুর ছিল কি-না জানি না, তাই প্রসঙ্গ থেকে সরানোর জন্যই বোধ হয় ফাবলিস বোটের জানালা দিয়ে দেখা যাওয়া একটা আলোকোজ্জ্বল প্রাসাদের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, ওটাই হচ্ছে দোলমা বাচে প্যালেস। কাল ওটা দেখতে আসতে হবে।

মেন্যু বই নিয়ে এবার আসে সোনালি পাগড়ি মাথায় উজ্জ্বল সোনালি কাজ করা লাল মখমলের জোব্বা গায়ে স্টুয়ার্ড। টেবিলে স্টার্টার সার্ভ করার ফাঁকে অবিকল আলফ্রেড হিচককের মতো একজন মাইক্রোফোন হাতে ফ্লোরে এসে বিভিন্ন ভাষায় অনর্গল সম্ভাষণ করে তুরস্ক সম্পর্কে একটা ছোট ভূমিকা দিয়ে অনুষ্ঠানসূচিতে কী কী থাকবে তার একটা কালোয়াতি বর্ণনা দেয়। তারপর ফ্লোরে আহ্বান করা হয় দুধসাদা আলখাল্লা পরা সুফি নাচের শিল্পীকে।

তার মাথায় খাড়া উঁচু তুর্কি টুপি, কোমরে লাল রঙের চওড়া কোমরবন্ধ। বাজনার তালে তালে নাচের বিশেষ কিছু মুদ্রার পর লোকটি অনর্গল পাক খেতে থাকে, তার চোখ বোজা, সাদা আলখাল্লার ঝুল বাতাসে উড়ে উড়ে তৈরি করে তরঙ্গায়িত বৃত্ত। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির এই দীর্ঘ ঘূর্ণিতে ফাবলিসের আবার মাথা ঘোরা শুরু হবে কি-না ভেবে সোফি খানিকটা উচাটন বুঝি। তাই নির্দিষ্ট বিরতিতে স্বামীর চেহারা পর্যবেক্ষণ করছিল ও। ফ্লোরে চলমান এই বিশেষ ঘূর্ণায়মান নৃত্যের ভঙ্গিমা ‘ড্যান্সিং দারবিশ’ নামে পরিচিত। এমনকি মঙ্গোলিয়ার উলানবাটোরের রাস্তার পাশে এমন একটা ভাস্কর্য শোভা পেতে দেখেছি। এই নাচকেও এক ধরনের ইবাদত বলে ধরা হয়, যার মাধ্যমে এই সুফি সাধকরা সঙ্গীতের সুরে ও তালে সব অহঙ্কার এবং লালসা ভুলে কেবল বিধাতার ধ্যানে এক ধরনের পূর্ণতায় পৌঁছে যেতে পারে। ঘূর্ণায়মান এই ছন্দ যেন সূর্যকে ঘিরে নক্ষত্রম-লীর আবর্তন, যার কেন্দ্রে থাকে কেবল বিধাতা।

সুফি নৃত্য শেষ হওয়ার পর হিচকক সাহেব ঘোষণা করেন এবার পরিবেশিত হবে তুর্কি কায়দায় একটা বিয়ের অনুষ্ঠান। বরের বন্ধুরা মিলে তার দাড়ি কামিয়ে দেওয়া, বান্ধবীদের কনে সাজানো তারপর নাচের তালে বর-কনের মিলন এবং শেষে কনের বান্ধবী ও বরের বন্ধুদের সম্মিলিত নাচের মধ্যে শেষ হয় বিয়ের অনুষ্ঠান। এরপর ফ্লোরে আসে এক স্বর্ণকেশী বেলি ড্যান্সার। তার নীল চোখ আর সেমেটিক সৌন্দর্যে হলের সমবেত মানুষের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা বয়ে যায়। নাচের ফ্লোরের ঠিক পাশের টেবিলে বোরকা পরা দুই মহিলা বসা, এ রকম উদোম বেলেল্লাপনার কারণেই বুঝি তাদেরকে করুণ, বিষণ্ন ও নির্বিকার দেখায়। এমন পরিবেশে স্বর্ণকেশী বেলি ড্যান্সারের সংক্ষিপ্ততম কাঁচুলির পাশ দিয়ে, কখনও উন্মুক্ত তুমুল দোলায়িত কটিতটের বাঁকের পেছনে দেখা যাওয়া দুই বিষণ্ন চেহারার অবগুণ্ঠিতাকে খুব বেমানান মনে হচ্ছিল। ওদের সামনের টেবিলের ফ্ল্যাগের দিকে চোখ যায়। সংযুক্ত আমির শাহীর পতাকা দেখে বুঝতে পারি এসব নাচ তো ওদের জন্য জলভাত। তাহলে দুই নারীর পাশে বসা ছোট করে ছাঁটা কাঁচা-পাকা দাড়িওয়ালা হুমদো চেহারার লোকটা বোধ হয় দু’জনেরই স্বামী। দু’জনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীটি মাঝে মাঝে তার ক্যামেরা দিয়ে বেলি নর্তকীর ছবিও তুলছিল। বেলি ড্যান্সের নৃত্যভঙ্গিমা খুব কাছ থেকে দেখে উপলব্ধি করা যায়, এদের পোশাক যতই খোলামেলা হোক না কেন, বলিউড সিনেমার অশ্লীল নাচের চেয়ে ঢের শালীন।

বেলি ড্যান্সের উৎপত্তি বা আদি ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় এটির উৎপত্তিস্থল মধ্যপ্রাচ্য। মিসরের ফারাওদের সময়কার প্রাচীন মন্দিরের দেয়ালে নৃত্যরতা নারীদের যে ম্যুরাল দেখা যায় সেগুলো বেলি নাচের ছবি বলে ধারণা করা হয়। বেলি ড্যান্স নামটার উৎপত্তি নিয়েও একাধিক মত রয়েছে। একদলের মতে, মিসরীয়রা তাদের দেশীয় নাচকে বলত ‘বেলেদি’, যার অর্থ আমাদের গ্রামের বা দেশের নাচ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই নাচ তাদের লোকনৃত্যেরই একটা শাখা। মতান্তরে পেট-কোমর দুলিয়ে বা কাঁপিয়ে নাচটি করা হয় বলেই তার নাম বেলি ড্যান্স। এই নাচের জনপ্রিয়তা যে কেবল মধ্যপ্রাচ্যে তা নয়, পশ্চিমা বিশ্বের মানুষও এই নাচের ভক্ত, আর সে কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের ট্যুরিস্ট কেন্দ্রগুলোতে বেলি ড্যান্স প্রায় অপরিহার্য একটা অংশ। মিসরে এই নাচের নাম রাকস শারকি বা প্রাচ্যের নাচ। তবে নাচটির আদি সম্পর্কে বেশি কিছু জানা না গেলেও আরব এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এই নাচের প্রচলন বহু প্রাচীন। রিচার্ড এটিংহাউসেন, ওলেগ গ্রাবার এবং মেরিলিন জেনকিনসের লেখা ইসলামিক আর্ট অ্যা- আর্কিটেকচার ৬৫০Ñ১২৫০ গ্রন্থে আরব অঞ্চলের প্রাসাদের দেয়ালে খোদিত নর্তকীদের ছবি দেখতে পাওয়া যায়, যেমনটি দেখা যায় প্রাচীন পারস্যের মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ে, অথচ ইসলামে মনুষ্যমূর্তির ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। অটোমান সাম্রাজ্যে  দেশ-বিদেশের বেলি নর্তকীরা তোপকাপি প্রাসাদের হারেমে সম্রাটের মনোরঞ্জন করত। ১৮৪৯ সালে ফরাসি ঔপন্যাসিক তরুণ গুস্তভ ফ্লবেয়ার বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক মাক্সি দু কাম্পকে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। সে সময়কার তার মিসর ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখায় মিসরীয় বেলি নর্তকীদের বিষয়ে খুব খোলামেলা বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের নৃত্যশৈলী তাকে এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল যে, তার বর্ণনার অনেক জায়গায় শালীনতার সীমাও বিস্মৃত হয়েছিলেন তিনি।

কয়েক দফা একক এবং সম্মিলিত বেলি নাচের পর হিচকক সায়েব ফ্লোর দেন ইরানি প্রেসিডেন্টের মতো ছোট করে ছাঁটা দাড়িওয়ালা এক যুবককে। তার তুর্কি গানের কাঁপা কাঁপা দীর্ঘ লয়ের ধ্বনিতে বসফোরাসের গাঙচিলগুলো ঘুম ভেঙে ডানা ঝটপট করে উড়ে যায় কি-না দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কয়েকটা তুর্কি গান গাওয়ার পর শিল্পী বিভিন্ন টেবিলে গিয়ে পতাকা দেখে দেখে সেই দেশের ভাষায় গান গেয়ে শোনান। ফ্লোর দেওয়ার আগে হিচকক সাহেব অবশ্য বলেছিলেন, লোকটি ৫৯টি ভাষায় গান গাইতে পারে। কয়েক টেবিল দূরত্বে এক মহিলার সামনে ভারতীয় পতাকা দেখে শিল্পী সেই টেবিলে গিয়ে নির্ভুল সুরে বলিউডের ‘দিল সে’ সিনেমার ‘চল ছাঁইয়া ছাঁইয়া’ গানটার কয়েক লাইন শুনিয়ে দেয়। পরিচিত সুরটা শোনার পর আমার বিশ্বাস হয়, লোকটি ভুল সুরে কোনো গান গাইছে না। আমি এক পর্যায়ে বাংলাদেশের পতাকাটা তুলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আমার কাছে এসে বলে,  সরি, বাংলাদেশের গান এখনও শিখতে পারিনি। নেক্সট টাইম এলে শোনাব।

একপর্যায়ে শিল্পী নিজের পারফরম্যান্স ছেড়ে বিভিন্ন টেবিল থেকে আলটপকা বাছাই করে কয়েকজন মহিলাকে ফ্লোরে ডেকে নিয়ে যান। পাশের টেবিল থেকে সোফিকেও বাছাই করা হয়। সেখানে সবাইকে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে বেলি ড্যান্স শেখানোর নামে সবাইকে নিয়ে কিছুক্ষণ হাসি-মশকরা করে এক সময় সিরিয়াস হওয়ার ভাব করে। তারপর বলে, আচ্ছা এবার একক নাচ হবে, প্রত্যেককে নাচতে হবে আলাদা করে। দুয়েকজন সহজাত কুণ্ঠায় পিছিয়ে গেলে তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে ফ্লোরের মাঝে নিয়ে আসা হচ্ছিল। এক জর্জিয়ান তরুণী নাচবে কি, হেসেই কুটিকুটি। শিল্পী খুব সিরিয়াস হয়ে নাচের মাস্টারের মতো তাকে ঠিকভাবে নাচতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলে, এরপর কিন্তু একটা সারপ্রাইজ আছে। সোফিকে ডাকার পর প্রাথমিক জড়তা কাটাতে ওর খুব বেশি সময় লাগে না। ওর লম্বা ঝুলের স্কার্ট আর হালকা সোনালি চুলের গুচ্ছ যখন ওর চারপাশের ঘূর্ণায়মান বাতাসে উড়তে শুরু করে তখন বোঝা যায় দেড় গ্লাস হোয়াইট ওয়াইনের  গুণে নয়, ওর ভেতর বাস করে সত্যিই নিঃসঙ্গ অচেনা এক  শিল্পী। কোনো হাস্য-কৌতুকবশে নয়, আত্মমগ্ন এক নৃত্যশিল্পী যেন নেচে যাচ্ছে ভুবনবিস্মৃত হয়ে। এমনকি পরিহাসপরায়ণ সেই তুর্কি উপস্থাপক নিজেও যেন এক ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এক সময় শেষ হয় সোফির দীর্ঘ নাচ। ফ্লোর থেকে সরে এলে ওর কপালে চিক চিক করে স্বেদবিন্দু, কালো টপসে ঢাকা বুকের শানিত যুগল উত্থানে দৃশ্যমান হয় তুমুল আলোড়ন।

পর্বটি শেষ হলে কিছুক্ষণ আগে নেচে যাওয়া তুর্কি তরুণদের দু’জন এসে মেঝের ওপর হাতখানেক লম্বা দুটো কাঠের তক্তা ফেলে ছুরির খেলা দেখাতে শুরু করে। ছুরির ডগাটাকে নাকের পাশে ঠেকিয়ে তারপর এক অদ্ভুত কায়দায় দু’জনই কাঠের তক্তার দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল ছুরি। একজনেরটা ঠিক ঠিক গেঁথে যাচ্ছিল তক্তার গায়ে, আরেকজনেরটা একবার-দু’বার গাঁথলেও বাকিগুলো পিছলে যাচ্ছিল, বোঝা যায় এটাও ইচ্ছাকৃত। কারণ পরক্ষণে আরেকজন এসে তক্তাটা বুকের ওপর নিয়ে শুয়ে পড়ে, আর যার সবগুলো ছুরি ঠিকভাবে গাঁথেনি, সে সেই শায়িত জনের বুকের ওপর রাখা তক্তার ওপর একই কায়দায় নির্ভুলভাবে ছুড়ে মারতে থাকে ছুরি, এবার আর সেগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে ঠিক ঠিক গাঁথতে থাকে। আমাদের সার্কাসেও এ রকম ছুরির আরও দুর্ধর্ষ খেলা দেখানো হয়, কিন্তু নাকের পাশে ঠেকিয়ে নিয়ে এদের ছুড়ে মারার কায়দাটা অভিনব।

ছুরির খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বহুভাষী শিল্পী ফ্লোরে ফিরে আসে, তার সঙ্গে ট্রে হাতে এক বেয়ারা, ট্রের ওপর রিবনে বাঁধা অনেকগুলো মেডেল। শিল্পী এবার ঘোষণা দেওয়ার মতো করে মিস জর্জিয়া, মিস ইংল্যান্ড, মিস ইন্ডিয়া এভাবে ডেকে ডেকে সবাইর গলায় সেই মেডেল পরিয়ে দিতে থাকে। এত নামের মাঝে সোফির নাম ডাকা হয় না, সে কারণেই  দেখি ওর মুখে ঈষৎ ছায়া পড়ে, ওর উজ্জ্বল বাদামি চোখের তারা হতাশায় কিছুটা ম্লান মনে হচ্ছিল সে সময়। আর ঠিক তখনই কান চলচ্চিত্র উৎসবের পুরস্কার ঘোষণার মতো ‘অ্যান্ড দ্য বেস্ট পারফরমার ইজ মিস ফ্রান্স’ বলে সোফিকে ডেকে পরিয়ে দেওয়া হয় মেডেল। ওটা গলায় পরে টেবিলে ফিরে এসে ওর খানিকটা চুপচাপ অন্যমনস্ক স্বামীকে মেডেলটা দেখিয়ে বলে, দেখো, আমার বেস্ট পারফরমার মেডেল। আমরা মেডেলটা হাতে নিয়ে দেখি, সবাই জানে খুব সাধারণ সস্তা মেডেল, রোজই কেউ না কেউ পাচ্ছে, তবুও ওর দুর্দান্ত নাচের পুরস্কার হিসেবে এই স্বীকৃতিটুকুই বুঝি ওর দরকার ছিল, যার জন্যই মূলত কাজ করে সৃষ্টিশীল মানুষেরা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, ব্যাংকার

সৌজন্যে, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.