ধলেশ্বরী ও সত্তরোর্ধ্ব কুলদা রাজবংশী
মার্চ ২১, ২০১৪ এস এম আববাস, ঢাকা জার্নাল : ধলেশ্বরী পাড়ের সত্তরোর্ধ্ব কুলদা রাজবংশীর জীবন কেটেছে স্বামীর জাল বুনন আর মাছ বিক্রির অর্থ দিয়ে। অভাব বুঝতে হয়নি তাকে। স্বামী-সন্তান নিয়ে মাত্র একযুগ আগেও তার জীবন কেটেছে আনন্দে। কিন্তু এখন কুলদা রাজবংশীকে অন্যের কাছে হাত পেতেই সংসার চালাতে হচ্ছে। ধলেশ্বরীর মতো শুকিয়ে গেছে তার জীবন-সংসার।
নদীর পানিও গেছে, স্বামী বলাই রাজবংশীও গেছেন ওপারে। তবে বলায় রাজবংশী স্বর্গে যাওয়ার আগে ধলেশ্বরীর মৃত্যু দেখেছেন। ধলেশ্বরী অপমুত্যুর কারণে কষ্টের দিন শুরু হয় বলাইয়ের। তবে বেশি দিন তা সহ্য করতে হয়নি। কদিন যেতে না যেতেই ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন বলাই।
রেখে গেছেন স্ত্রী কুলদা রাজবংশীসহ তিন পুত্র রামপদ রাজবংশী, খোকন রাজবংশী, টোকন রাজবংশীকে। এখন পুরো পরিবারটিই ছিন্নভিন্ন। কুলদার জীবন-জীবীকার মতোই রাজবংশী সম্প্রদায়ের ছিন্নভিন্ন অবস্থা এখানে।
কুলদা রাজবংশী সাভারের তেঁতুল ঝরা ইউনিয়নের পানপাড়া গ্রামে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে অন্যের জমিতে থাকেন। একটি ছোট্ট ঘরে তার জীবন-যাপন। স্বামীর জীবীকা নির্বাহের পথ হারিয়ে গেছে নদী শুকাবার পর থেকেই। সন্তানরাও যখন যে কাজ পায় তা করেই নিজের স্ত্রী-সন্তানের জন্য খাবার সংগ্রহ করে। মা কুলদা রাজবংশীকে দেখার মতো আয় হয় না তাদের। তাই তাকে অন্যের কাজ করে অথবা হাত পেতেই জীবন চালাতে হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার নদী পাড়ের ছোট্ট ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে তার জীবন-বাস্তবতা ও ধলেশ্বরী নদীর কথা প্রাণ খুলে বলেন কুলদা রাজবংশী।
শুধু কুলদা নয়, ধ্বলেশ্বরী পাড়ের প্রায় ১ হাজার পরিবারের একই অবস্থা। নেই তাদের আদি পেশা জাল বুনন আর মাছ ধরে বিক্রি করা। আর সে কারণেই ছিন্নভিন্ন এই মানুষগুলো নদীপাড় আঁকড়ে পড়ে আছে জীবন বাঁচাতে। পেশা নেই, পেশার নিশ্চয়তাও নেই। আর সে কারণে কোনো আনন্দ নেই জেলে পাড়ায়। তবে তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, লেখাপড়ার আগ্রহ সৃষ্টিসহ নারী-পূরুষের সমতা এবং পানি ব্যবহারের সুবিধা আদায়ে এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর এক প্রয়াস শুরু করেছে এনজিও ফোরাম।
কুলদা রাজবংশীর মতোই ছিল ধলেশ্বরীর যৌবন। যে নদীটি ঘিরে কুলদার দূরন্ত শৈশব কেটেছে। নদীর ভরা যৌবনে স্বামীর জাল বুনন আর মাছ ধরার আয় দিয়ে তাদের জীবনের মোক্ষম সময়গুলো স্বচ্ছলভাবে কেটেছে। নদীর জলে সাঁতরে নিজেকে পবিত্র করেছেন। আজ সেই নদীর যত সামান্য জল যা আছে তা আর ছুঁয়েও দেখেন না কুলদা। পানিতে হাত-পা ধুলেও অসুস্থ হতে হয়।
নদীর পাড়ের জীবন নিয়ে কথা বলেন, কুলদার মতো সত্য রাজবংশী, ধীরেন্দ রাজবংশী, অবিরাম রাজবংশীসহ অনেকেই। প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের জীবন-জীবীকা একমাত্র সেই নদী আজ আর কোনো কাজেই আসে না। যেটুকু পানি থাকে তাও এ.কে.এইচ নিটিং অ্যান্ড ডায়িং নামের প্রতিষ্ঠানসহ অন্যদের দূষণের মহোৎসবের কারণে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, পয়ঃবর্জ্যসহ কারখানার যতো রঙ ও বর্জ্য সরসরি নদীতে ছাড়ছে তারা। যেনো দেখার কেউ নেই।
বিশ্ব পানি দিবসেও চলবে দূষণের মহোৎসব শনিবার বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব যখন পানির সঠিক ব্যবহার ও পানিকে শক্তি হিসেবে উপস্থপন করতে ব্যস্ত থাকবে। তখন রাজধানীর বাইরে সাভার ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামসহ সারা দেশেই পানি দূষণের মহাৎসব চলবে। দেখার কেউ থাকবে না রাজবংশী সম্প্রদায়ের দুঃখকষ্ট কিংবা বংশী নদী, কালীগঙ্গা নদীসহ অংসখ্য নদীর পানি দূষণের সেই উৎসব।
মানিকগঞ্জের তরা ব্রিজের নিচে নদীতে সামান্য পানিও অবশিষ্ট রয়েছে। সেই পানিতেও চলছে দূষণের মহোৎসব। আকিজ পার্টিকেল এবং মন্নু ডায়িং আবাধে চালাচ্ছে পানি দূষণ। কারখানার বর্জ্য ছাড়াও পয়ঃবর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে তারা।
এনজি ফোরামের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ইনফরমেশন প্রধান জোসেফ হালদার জানান, ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে রাজধানী ও রাজধানীর আশেপাশের চার নদীর দূষণ ছড়িয়ে যাবে এই এলাকায় প্রায় ডজনখানেক নদীতে। এলাকার সব মানুষের দাবি বাঁচাতে হবে নদী গুলোকে।
লেখক- এস এম আববাস, সাংবাদিক, এটিএন টাইমস।
ঢাকা জার্নাল, মার্চ ২১, ২০১৪।