‘জ্বলে পুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়’

আগস্ট ৬, ২০১৩

New Imageঢাকা জার্নাল: বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখানো এক আদর্শ মানুষ মজিদ মিয়া। ব্যর্থতা, হতাশা মানুষকে গ্রাস করে। কিন্তু সেসব অতিক্রম করে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন এই মানুষটি।

ব্যর্থতার রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে কীভাবে নতুন করে জীবনের স্বপ্ন দেখা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মজিদ মিয়া। এলাকার সবাই ভালোবাসেন তাকে। চাঁদাবাজরাও তার কাছে চাঁদা চায় না। পুলিশও কোনো কমিশন নেয়না। আগারগাঁও করম আলী বস্তির সবাই তাকে দেখেন আদর্শ স্বপ্ন পুরুষ হিসেবেই।

সংসারে সুখী হওয়ার জন্য তিল তিল করে জমানো অর্থ, স্ত্রীর সোনার গহনা আর শেষ সম্বল নগদ ৫০ হাজার টাকাসহ স্ত্রীকে হারিয়ে পথে বসার কথা তার। কিন্তু সে ব্যর্থতা এবং হতাশা তাকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। ছোট দুই সন্তান, ১৩ বছরের ছেলে তুহিন ও ৭ বছরের মেয়ে সুমীকে নিয়ে আবার গড়ে তুলেছেন সুখের সংসার। এখন সন্তানের বাবা-মা দু’য়ের ভূমিকাতেই মজিদ মিয়া।

জন্ম থেকেই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মজিদ মিয়া। আদি বাড়ি সাভারে। ১৯৯৯ সালে বিয়ের পর আগারগাঁও করম আলী বস্তিতে স্ত্রী নাসিমাকে নিয়ে ঘর সাজান তিনি। ক্যারাম বোর্ডের আসর বসিয়ে শুরু করেন জীবন জীবিকা। তাতে সুখেই কাটে জীবন।

শুধু কষ্ট একটাই। যত্ন করে তৈরি করা করা একটি স্বপ্নের সংসার ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিই। লোকে বলে, বোবার নাকি শত্রু নেই। কিন্তু সে কথাটি মিথ্যে হয়ে গেছে মজিদ মিয়ার বেলায়।

বিয়ের পর দুই সন্তানের জন্ম দিয়ে স্বামীর ঘাড়েই সন্তানদের ফেলে রেখে সংসার ছেড়েছেন স্ত্রী নাসিমা। স্বামীর বন্ধু বরিশালের কামালের সঙ্গে চলে গেছেন দেড় বছর আগে।

যাওয়ার সময় বাসায় নগদ একটি টাকাও রেখে যায়নি। তার সন্ধান করতে করতে সারা দিন পার হয়ে যায় মজিদের। তাকে না পেয়ে সন্তান দু’টির মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই চাল ডাল সিদ্ধ করে তাদের মুখে তুলে দেন। পরে জানতে পেরেছেন তার বন্ধু কামালের সঙ্গে চলে গেছে নাসিমা। পিছন ফিরে তাকাননি মজিদ। আবার নতুন করে জীবন শুরু করে।

জমানো টাকা থেকে স্ত্রীর বায়না মেটাতে একের পর এক সোনার গহনা কেনেন। এক এক করে হাতের চুড়ি, নাকের নথ, কানের দুল ও গলার চেনও কেনেন তিনি। স্ত্রীর চাহিদা মেটাতে কোনো কিছুই যেন বাদ রাখেননি মজিদ। স্ত্রীর আবদার মেটতে একটি মোবাইল ফোনও কিনে দিয়েছেন। আর সেটাই তার জীবনে কাল হলো। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরকীয়া করে স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গেছে নাসিমা।

মজিদ কথা বলতে পারেন না। ইশারা ছাড়া কারো কথা শুনতেও পাননা। এটিই ছিল তার অপরাধ। সব বুঝে শুনেই তো বিয়ে করেন নাসিমা। তাহলে বিয়ের সাড়ে ১২ বছর পর এভাবে চলে গেলেন কেন? কোনো হিসাব মেলাতে পারেননি মজিদ মিয়া। তার এ কষ্টের কথা কাগজে লিখে জানান বাংলানিউজকে। ওই সময় যন্ত্রণায় শব্দ করে কাঁদতেও পারেননি। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁফিয়ে চোখের জল ফেলেছেন।

পুরোনো কষ্ট হঠাৎ করে জেগে ওঠায় হাতে লিখে জানানোর ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। একটু থামার পর বাংলানিউজের ফটো করেসপন্ডেন্ট মুজিবুর রহমান ইশরায় কথা বলেন মজিদ মিয়ার সঙ্গে।

মজিদ মিয়া নিজেকে যোগ্য করে তুলতে লেখাপড়াও শিখেছিলেন মিরপুর প্রতিবন্ধী স্কুলে। কিন্তু স্ত্রী তার মূল্য দেয়নি। স্বামীর কাছে মোবাইল ফোনের বায়না থাকলেও লেখাপড়ার ধারের কাছেও যায়নি নাসিমা।

স্ত্রীর কাছে তার লেখাপড়ার কোন মূল্য না থাকুক, কিন্তু লেখাপড়া শিখে মজিদ নিজেকে এগিয়ে নিয়েছে। মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ লিখে ভাব বিনিময় করেন। দিনভর পত্রিকা পড়ে দেশ বিদেশের ভালো-মন্দ সব খবর রাখেন। সময়ও কেটে যায় তার। কাস্টমাররা ক্যারাম খেলেন, আর মজিদ মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা পড়েন। রাতে সন্তান দু’টিকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার পর পত্রিকার জগতে মনোযোগ দেন মজিদ।

New Image 2সকাল হলেই আবার সংগ্রাম শুরু তার। সকাল ১০টায় বস্তির দোকান খুলে আসর বসান। এক গেম ১০টাকা। তার এই ব্যবসা মাত্র দুই টাকা দিয়ে শুরু হলেও এখন তা বেড়ে ১০ টাকা হয়েছে। তাতেই সংসার চলে যায় তার।

মজিদ জানান, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনটি বোর্ডে চলে এই খেলা। আয় হয় প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকা।

প্রিয় মানুষের প্রতারণায় সব হারালেও কারো করুণা বা দয়ায় বেঁচে থাকতে চাননা মজিদ। যন্ত্রণা বুকে চেপে আবার শুরু করেছেন জীবন সংগ্রাম। যেন ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়’।

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ৬, ২০১৩।
লেখক: এস এম আববাস, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.