জিএসপি সুবিধা স্থগিত

জুন ২৮, ২০১৩

521717_156328214534797_2120396650_n-300x300ঢাকা জার্নাল: বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একটি প্রক্লেইমেশন ইস্যু করে বৃহস্পতিবার দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে একথা জানিয়েছেন।

দেশটির ১৯৭৪ সালে গৃহীত আইনের ৫০২ (ডি) (২) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ বাণিজ্য ক্ষেত্রে জেনেরালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) পাওয়ার উপযোগী নয় বলে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে এই ঘোষণায়। ঘোষণার একটি কপি বাংলানিউজের হাতে পৌঁছায় স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে তিনটায়। ঘোষণাটি এর কিছুক্ষণের মধ্যেই হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটে দেওয়ার কথা জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। হোয়াইট হাউজের প্রেস অফিসের একজন কর্মকর্তাও বাংলানিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এছাড়াও ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) এর ওয়েব সাইটেও এই ঘোষণা বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরা হবে বলে জানায় অপর একটি সূত্র।

ঘোষণায় বারাক ওবামা স্পষ্টই বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত সম্পূর্ণ একটি সঠিক কাজ। কারণ এই উন্নয়নশীল দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়নি এবং নিচ্ছেও না। আর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আমি যুক্তরাষ্ট্রের হার্মোনাইজড টেরিফ শিডিউল (এইচটিএস) এর ৪(এ) এবং ৪(বি)(ক) মডিফাই করাকেও যথার্থ মনে করছি।

হোয়াইট হাউজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য এই ট্রেড সুবিধা ফিরে পেতে আন্তর্জাতিক শ্রম মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রেসিডেন্ট সে অবস্থা ফিরে এসেছে দেখলে ফের এই সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র লরা ডি লুকাস বাংলানিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকারের বিষয়গুলো সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতার কারণেই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জিএসপি সুবিধা স্থগিত করলেন।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে যেসব ট্রাজেডি ঘটে গেছে তাতে গ্রামেন্টস খাতসহ বিভিন্ন খাতে অনেক শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। এই সুবিধাটি যাতে আবারও বাংলাদেশকে দেওয়া যেতে পারে সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শ্রমমান বৃদ্ধিতে কাজ করবে বলেও জানান লরা ডি লুকাস। তিনি জানান, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরেই আরেকবার বাংলাদেশে শ্রম মান ও শ্রমিক অধিকার পর্যালোচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র। তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সুবিধাটি ফের বাংলাদেশকে দেওয়া যায় কি না।

তবে বৃহস্পতিবারের ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, বাংলাদেশ তার শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারির কার্যালয় থেকে পাঠানো ওই ঘোষণার ২ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে এই কথাগুলো বলেন বারাক ওবামা।

ঘোষণার এক নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো দেশ জেনেরালাইজ সিস্টেম প্রিফারেন্সেস (জিএসপি)ভূক্ত হলে যদি সেই দেশ (দেশটির কোন নির্ধারিত জোনসহ) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকার না মানে কিংবা মানার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ না নেয় তাহলে অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর (১৯ ইউএসসি ২৪৬২ (ডি)(২) মোতাবেক আইনটির ৫০২ (এফ) (২) এর আবশ্যকিতার বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট দেশটির জন্য ওই সুবিধা বাতিল অথবা স্থগিত করবেন। তবে কোনো দেশের জন্য সুবিধাটি স্থায়ীভাবে বাতিল করতে প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসকে এবং সংশ্লিষ্ট দেশকে সিদ্ধান্তের অন্তত ৬০ দিন আগে তা জানাবেন। এরপর দুই নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশকে আইনের ৫০২ (ডি) ধারায় এই সুবিধার অযোগ্য বিবেচনা করে তার স্থগিতের ঘোষণা দেন বারাক ওবামা। তবে ১৪ অনুচ্ছেদবিশিষ্ট এই ঘোষণার ৭ম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর (১৯ ইউএসসি ২৪৬৩ (ডি)(১) এর ৫০৩ (ডি)(১) অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্ধারিত কিছু শর্ত মানা হলে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে পারবেন। তবে তা একমাত্র তখনই করা হবে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড ট্রেড কমিশন এই প্রত্যাহারকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করবে বলে মত দেবে।

আইনের বিভিন্ন ধারা এবং ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন, ২০১২ সালের ১৪ মে এবং ২৯ জুনের প্রেসিডেন্ট প্রক্লেইমশনের সূত্র ধরে এগুলোর মধ্যে কিংছু সংযোজন বিয়োজন এনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার এই সবশেষ প্রক্লেইমেশনে বলেন- আমি বারাক ওবামা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশের সংবিধানের ও ১৯৭৪ সালের আইনের ৬০৪ ধারায় দেওয়া ক্ষমতা বলে ঘোষণা করছি যে- জিএসপি’র একটি সুবিধাভোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সুবিধাটি স্থগিত করা হলো; এর সাথে সাথে জিএসপি সুবিধার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের করা স্বল্প-উন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হলো।

ফেডারেল রেজিস্ট্রারে এই ঘোষণা প্রকাশিত হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে এই উভয় সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

গত এক বছর ধরে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ওবামা প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত নিলো বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস সূত্র।

আমিনুল হত্যার ক্লু খুঁজে না পাওয়া, তাজরীনে আগুন, সবশেষ রানা প্লাজা ধরে সহস্রাধিক শ্রমিকের প্রাণহানি এই সিদ্ধান্তে পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে বলে জানায় সূত্রটি।

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘোষণার পরপরই ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) এর ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয় এর প্রধান মাইকেল ফরম্যানের একটি বিবৃতি। এতে তিনে বলেন, আমাদের জিএসপি সুবিধার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট শ্রমিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও সুবিধাটি পাওয়ার যোগ্যতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। মৌলিক শ্রমমানগুলো নিশ্চিত করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। কিন্তু আমাদের এই উৎসাহ ও বিভিন্ন সময়ে জানানো উদ্বেগ সত্ত্বেও আমরা যথাযথ অগ্রগতি দেখি নি। সাম্প্রতিক কিছু ট্রাজেডিতে ১২শ’র বেশি শ্রমিকের প্রাণহানি আমাদের কাছে বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের মানের বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। তবে আজ বাংলাদেশের বিষয়ে এমন একটি ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি কিভাবে শ্রমিক অধিকারের পরিবেশ ভালো করা যায় সেই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেশটির সরকারের সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় বসারও উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানান মাইকেল ফরম্যান। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে যাতে জিএসপি সুবিধা আবারও দেওয়া যায় এবং রানা প্লাজা ধস, তাজরিন ফ্যাক্টরিতে আগুনের মতো ঘটনা যাতে প্রতিহত করা যায় সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে। মাইকেল ফরম্যান আরও বলেন, সারা বিশ্বে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব বাণিজ্য নীতিতে গৃহীত মূল্যবোধ অক্ষুণœ রাখবে বারাক ওবামা প্রশাসন।

তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা এই সিদ্ধান্তে দেশের অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করছেন। তারা বলছেন, এই বিশেষ বাণিজ্য সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিনা শুল্কে প্রায় পাঁচ হাজার পণ্য রফতানি করতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু ওই সব পণ্যের বেশিরভাগই বাংলাদেশ তৈরি করে না। বাংলাদেশে বেশি পরিমাণে যে পণ্য তৈরি করে সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে কোন বাণিজ্য সুবিধা পায় না। ফলে কার্যত এই জিএসপি সুবিধা বাতিলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের ওপর কোন প্রভাব পড়বে না। তবে এতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়তে পারে।

উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের ৯৭ ভাগ পণ্য এই সুবিধা পেলেও তৈরি পোশাকে এই সুবিধা নেই। আর তৈরি পোশাকই হলো যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য। তাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রফতানি আয়ের মাত্র শতকরা শূন্য দশমিক ৫৪ ভাগ আসে জিএসপি সুবিধা থেকে, যার পরিমাণ ২০১২ সালে ছিল ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর মোট রফতানি আয় ছিল ৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিএসপি সুবিধা স্থগিত হলে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে এসব পণ্যকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হবে।

বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, জিএসপি সুবিধায় রফতানি আয়ের পরিমাণ সামান্য হলেও ভয়ের বিষয় অন্য জায়গায়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা সাময়িকভাবে স্থগিত করায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে খারাপ ইঙ্গিত যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি ছড়িয়ে পড়বে। প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার নেই। তাহলে এর প্রভাব পড়বে সবখানে।

গত এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসে ১১২৯ শ্রমিক নিহত হন। এরপরই বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা পাওয়া নিয়ে নতুন করে আলোচন শুরু হয়। ওই ঘটনার প্রায় দুই মাস পর নয় ডেমোক্র্যাট সিনেটর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ যেসব বাণিজ্যসুবিধা পেয়ে থাকে, তা স্থগিত রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রতি আহ্বান জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতরে এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠানের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশের অগ্রগতি হওয়ার আগ পর্যন্ত এ সুবিধা স্থগিত রাখার আহ্বান জানানো হয়।

এ প্রসঙ্গে সিনেটররা বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করতে এবং সে দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বিধান করাসহ শ্রম আইন সংশোধনের জন্য রোডম্যাপ তৈরি ও এর জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে আমরা ওবামা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।

২০০৭ সালে আমেরিকার শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এএফএল-সিআইওর অভিযোগের ভিত্তিতে ওবামা প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। শ্রমিক অধিকার ইস্যুতে ছয় বছর আগে এএফএল-সিআইও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিষয়ক সিনেট কমিটিতে অভিযোগ দায়ের করে। এ অভিযোগ ইস্যুতে ইতোপূর্বে একাধিকবার শুনানি অনুষ্ঠিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সম্প্রতি তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক নিহত এবং সর্বশেষ রানা প্লাজা ধসের কারণে ১১২৯ শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এএফএল-সিআইও আবার নতুন করে অভিযোগ দায়ের করে। গত ৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিষয়ক সিনেট কমিটিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত শুনানি হয়।

ঢাকা জার্নাল, জুন ২৮, ২০১৩

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.