চন্দ্রমূখী তোমার জন্যে

সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩

pic-bg20130916215156সুমি খান, ঢাকা জার্নাল: ছোট্ট চন্দ্রমুখী তার নামের মতোই ফুটফুটে। চলে গেলো সবাইকে কাঁদিয়ে। তার শোকে বিহবল মা নাজনীন আকতার তন্বী!

চন্দ্রমুখীকে আমি কখনো দেখিনি, আমার দুর্ভাগ্য! তবে তার অসাধারণ বাবা-মা দু`জন আমার খুব চেনা। ফেসবুকের কল্যাণে তিনজনই আমার অনেক চেনা। একুশে টেলিভিশনে মুকুল আমার সহকর্মী ছিলেন অল্প ক`দিন।তার আগে থেকেই তন্বীকে চিনতাম। অ্যাসাইনমেন্টে দেখা হতো।

খুব লক্ষ্মী, শান্ত একটা মেয়ে। অনেক গল্প, অনেক স্মৃতি ভিড় করছে আজ মনে। মনটা এতো ভারাক্রান্ত, গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে রাতের অন্ধকার! অপলক চেয়ে আছি শূন্যতায়!! কায়মনোবাক্যে তন্বীর সম্পূর্ণ সুস্থতা কামনা করছি। শারীরিক- মানসিক সবদিকে যেন সুস্থ হয়ে ওঠে আমাদের ছোটবোন তন্বী।

১৪ সেপ্টেম্বর, মুকুল তার ফেসবুকে পোস্ট করেন, “এই পৃথিবীতে যাকে সবচে’ বেশি ভালবাসি সেই চন্দ্রমুখী এখন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্ট এ .. ওর প্রত্যেকটা কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসছে আমার বুকে .. আমি যে বাবা .. সবার কাছে মন থেকে দোআ ভিক্ষা চাই, আল্লাহ যেন চন্দ্রমুখীকে আমার কোলে ফিরিয়ে দেন….” কন্যা-পিতার বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা অনন্য! আমার মনের ভেতর বেদনার ঝড় কাটাতে শরণাপন্ন হলাম রবীন্দ্রনাথের। যাকে স্বজন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার। এগারো বছরের শমীন্দ্রনাথ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ মারা যাওয়ার পর তাকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,” আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে”।

রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুর মালা’য় যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷ অকালে চলে গেলেন তিনি৷ বয়স তখন তাঁর মাত্র ঊনত্রিশ৷ স্ত্রীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ছাদে চলে গেলেন, নিষেধ করে গেলেন যেন কেউ তাঁর কাছে না যায়৷ মৃণালিনীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রচিত হলো ‘স্মরণ` কবিতাগুচ্ছ৷ ভাষায় আড়ম্বর নেই, উপমা অলংকারের আয়োজন নেই, জীবনের টুকরো টুকরো ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে কবি তাঁর প্রিয়াকে মৃত্যুর পর উপলব্ধি করার যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘স্মরণ`-এর অনেকগুলো কবিতায়৷ ‘যুগল মিলন` কবিতায় লিখেছেন, ‘‘মিলন সম্পূর্ণ হল তোমা সনে, এ বিচ্ছেদ বেদনার নিবিড় বন্ধনে৷“

রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে, তিন মেয়ে – মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ৷ মাধুরীলতার ডাক নাম বেলা, রেনুকার ডাক নাম রাণী৷ স্ত্রী বেঁচে থাকতেই তিনি মাধুরীলতা ও রেনুকার বিয়ে দেন, তাদের অল্প বয়সে৷ বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই রেণুকা গুরুতর অসুস্থ হলো। ডাক্তাররা রোগ পরীক্ষা করে রায় দিলেন – যক্ষ্মা৷

ডাক্তারদের পরামর্শে রবীন্দ্রনাথ রেণুকাকে নিয়ে হাওয়াবদল করলেন দু`বার৷ অসুস্থ রেণুকাকে শোনানোর জন্য লিখলেন ‘শিশু` কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ৷ অবশেষে চলে গেলো রেণুকা মাত্র বারো বছর বয়সে, মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর দশ মাসের মধ্যে৷ ১৯০৫-এ পরিণত বয়সে মৃত্যু হলো পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের৷ এর মাত্র দু`বছর পর রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র এগারো বছর বয়সি শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুত্যুবরণ করলো৷ মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হলো শমীন্দ্রনাথ৷ খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে মুঙ্গেরে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলো শমীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তখনো পথে। বলে দিলেন দাহ করে ফেলতে। আদরের ছেলেকে শেষ দেখাও দেখতে পারলেন না কবিগুরু।৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘‘…শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই৷ মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে৷ আমিও তার মধ্যে৷”

বড়ো মেয়ে মাধুরীলতার সংসার জীবন শেষ পর্যন্ত সুখের ছিলো না৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনে এটাও এক বেদনাত্মক অধ্যায়৷ জামাতা শরতের অন্যায় গর্হিত আচরণ আর মাধুরীলতার প্রতি চরম নির্যাতন সইতে না পারলেও অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথ কিছুই করতে পারেন নি। জামাতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছেছিলো৷ মেয়ের বাড়িতে তাঁর যাওয়া আসাও তেমন ছিলো না৷ কন্যার কষ্ট সইতে না পেরে বলতেন..” ছোটকালে মাধুরীলতার কঠিন অসুখ হয়েছিলো, সেদিন সে মরে যেতো যদি, আমাকে তার এমন কঠিন সময় দেখতে হতো না।

একদিন হঠাৎ খবর এলো মাধুরীলতা অসুস্থ৷ রাজরোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত মাধুরীলতা। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথ প্রায় রোজই মেয়েকে দেখতে যান৷ লেখিকা হেমলতা দেবী জানাচ্ছেন, ‘‘অতি আদরের মেয়ে বেলা মৃত্যুশয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন৷ শরৎ তখন টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত৷ পা নাবাত না পর্যন্ত – এমনি করে অপমান করত৷ উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন,…৷“
মাধুরীলতার মৃত্যু হলো বত্রিশ বছর বয়সে৷ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের `পিতৃস্মৃতি` গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘‘সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ – যখন তিনি শ্রীরামপুরের বাড়িতে পৌঁছলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যা হবার তা হয়ে গেছে৷ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বিচিত্রার বৈঠক ছিল৷ বাবা সকলের সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প যেমন করেন, সেদিনও তাই করলেন৷ তাঁর কথাবার্তা থেকে একজনও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, মনের কী অবস্থা নিয়ে বাবা তাদের সঙ্গে সদালাপ করছেন৷“

১৯২৩-এ মৃত্যু হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ১৯২৫-এ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের, ১৯২৬-এ দ্বিজেন্দ্রনাথের, ১৯৩২-এ দিদি স্বর্ণকুমারীর৷১৯৩২-এ একাত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ হারালেন কন্যা মীরার পুত্র কুড়ি বছর বয়সি আদরের নাতি নীতিন্দ্রনাথকে। উচ্চতর শিক্ষার জন্য নীতিন্দ্রনাথ গিয়েছিলো জার্মানিতে। টেলিগ্রামে নীতুর মৃত্যু সংবাদ এলো৷ শান্তিনিকেতনে তখন `বর্ষা মঙ্গল` উৎসবের আয়োজন চলছে৷

আয়োজন বন্ধ হলো না৷ রবীন্দ্রনাথ মীরাকে দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘নীতুকে খুব ভালবাসতুম, … অনেকে বললে, এবার বর্ষামঙ্গল বন্ধ থাক আমার শোকের খাতিরে৷ আমি বললুম, সে হতেই পারে না৷ আমার শোকের দায় আমিই নেব৷“

শোকের দায় আবার নিতে হলো রবীন্দ্রনাথকে মৃত্যুর এক বছর আগে৷ আরেক প্রিয় ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুর সংবাদ পেলেন মংপু-তে বসে৷ জন্মদিনের আয়োজন চলছিলো তখন৷

ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখলেন, ‘‘তোরা বোধহয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি বেশি ভালোবেসেছিলুম৷“

কবিতা লিখলেন সুরেনের স্মৃতিতে, ‘‘আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি/ প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ…“

রবীন্দ্রনাথ একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷“

রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এ ভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না৷“
সুমি খান: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, Sumikhan29bdj@gmail.com

ঢাকা জার্নাল, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.