ঘটনা ঘটার পরে, সবার টনক নড়ে!

মে ৫, ২০১৩

Savar-pic-BG-72520130425011858মোহাম্মদ হানিফ,ঢাকা জার্নাল: সাভার ট্রাজিডি, রানা প্লাজা ধ্বস। নির্মাণ কৌশল, অনুমোদনসহ যাবতীয় পর্যায়ে অনিয়ম। আলোচনা উঠছে সাভার ট্রাজিডির প্রধান ঘাতক সোহেল রানার উত্থান ও আয়ের উৎস নিয়েও। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যস্ত রানার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব নিয়ে। বিরোধী দল  ব্যস্ত রানার পেছনের মদদ দাতা গড ফাদার খোঁজার কাজে। সরকার দল ব্যস্ত রানাকে কিভাবে রানাকে নিজেদের দলের বাইরে রাখা যায়। আর গণমাধ্যম ব্যস্ত সাভার ট্রাজিডির ময়না তদন্তে। সুশিল সমাজ, শ্রমিক সংঠন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্যস্ত শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার দাবি দাওয়া নিয়ে এবং দেশের অন্যতম রফতানি খাত গার্মেন্টস শিল্পের এক হাত নিতে। আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ব্যস্ত সাভার ট্রাজিডির সঙ্গে সম্পৃক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা ব্যস্ত বিভিন্ন এই ট্রাজিডির পেছনের ঘটনা উদঘাটনে।

সবাই নতুন করে। এ যেন নতুন গোয়ালে পুরাতন গরু রাখার মতো, নতুন বোতলে পুরাতন মদ।

সবারই যেন টনক নড়ে, ঘটনা ঘটার পরে।স্পেকট্রাম বা ফিনিক্স ইতিহাসে যাচ্ছি না। বাংলাদেশের ইতিহাসে জগন্নাথ হল ট্রাজিডির মতোও ঘটনা রয়েছে। বেশি পুরাতন কাসুন্দি না ঘেটে সম্প্রতি সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। পুরাতন বিষয়ে স্মৃতিচারণ না করে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতগুলোর দিকে একটু নজর দেয়াটায় ভালো। অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধ্বসের মতো মানুষ্য ‍সৃষ্ট দূর্যোগের সঙ্গে বাঙালিকে পরিচিত করার কিছু নেই। অনেক ক্ষেত্রেই এসব দূর্যোগ জাতীয় জীবনে সিডর, আইলা কিংবা সুনামির মতো বয়ে এনেছে শোকের বার্তা।

২০১১ সাল রাজধানীর হাতিলঝিল সংলগ্ন বেগুনবাড়ি বস্তিতে অননুমোদিত ৮ তলা ভবন ধ্বসে অকালে প্রাণ হারায় ২২ জন নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ। এই ঘটনার উদ্ধার কাজ শেষ হতে না হতেই পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক দ্রব্যের গোডাউনের আগুনে অঙ্গার হয় ১১৯টি তাজা প্রাণ। পরপর ঘটে যাওয়া এই দুটি ঘটনায় গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। খুজে পাওয়া যায় বিভিন্ন অনিয়ম এবং অপরিকল্পিত কার্মকাণ্ড। তৎক্ষনাৎ বিভিন্ন কর্ম ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)।

রাজউক ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন অনুমোদনহীন ও ঝুকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদের কর্মকাণ্ডে। অন্য দিকে বিএসটিআই ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে পুরান ঢাকার জনবহুল এলাকায় উচ্ছেদ করা হয় বিভিন্ন ক্যামিক্যালের গোডাউন ও কারখানা। সিলগালাও করা হয় এসব ঝূকিপূর্ণ শিল্প। কিন্তু কর্তৃপক্ষ দুটির এমন কার্যক্রম ধীরে ধীরে দূর্বল থেকে দূর্বলতর হতে থাকে। একসময় গণমাধ্যমের প্রচারণা থেকে হারিয়ে যেতে থাকে এসব ঘটনা। পরে দেখা যায় নিমতলী আবারো গড়ে উঠেছে ক্যামিক্যালের গোডাউন, প্লাস্টিক কারখানাসহ ঝুকিপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেগুলোর কোন অনুমোদনই নেই কোন কর্তৃপক্ষের। অন্যদিকে হাজারো রানা গড়ে তুলছেন হাজারো রানা প্লাজা।

নাসের খান বলেন,রাজধানীতে নিচু, জলাধার ভরাট করে গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্প। আর এগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে রাজউক। পক্ষান্তরে অনুমোদন দিয়ে এসব অবৈধ ও ঝূঁকিপূর্ণ প্রকল্পকে বৈধতা দিচ্ছে রাজউক।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জনবলের অভাব,আবাসন কোম্পানিগুলোর সততা ও দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করছে রাজউক।

এব্যাপারে রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন) প্রকৌশলী শেখ আবদুল মান্নান লেখনীকে বলেন, নির্মাণাধিন ভবন তদারকি ও পরিদর্শনের জন্য মাত্র চার জন অথরাউজ অফিসার রয়েছে রাজউকের। অন্যদিকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য পর্যাপ্ত ম্যাজিস্টেট নেই রাজউকের। ফলে দীর্ঘ দিনে জঞ্জাল পরিস্কার করতে সময় লাগছে।

এরপর রাজধানীর কাঠাল বাগানে নির্মাণাধিন রাজউক অনুমোদিত ভবন ধ্বসের ঘটনা ঘটে। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও কাঠাল বাগানের ভবন ধ্বস রাজউকের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। একই সঙ্গে প্রকাশ পায় কর্তৃপক্ষটির দায়িত্বহীনতাও। এঘটনাও তদন্ত কমিটি হয়। গণমাধ্যমেও স্থান পায় ঘটনাটি। ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ি করে মামলাও করা হয়। এরপরের গল্প সবার জানা। এরপর ছোট খাট ঘটনা ঘটতে থাকলেও সরকার ও বিভিন্ন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতায় প্রকাশ পেয়েছে।

স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধ্বংস লীলাটা রচিত হয় গতবছর ডিসেম্বরে। এসময় দেশের ইতিহাসে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সর্বাধিক প্রাণহানির ঘটনাটি ঘটে। সাভারের আশুলিয়ায় তাজরিন ফ্যাশানের আগুনে প্রাণ হারান ১৪৭ শ্রমিক। ঘটনাটি শুধুমাত্র জাতীয় ভাবেই নয়, আন্তর্জাতিক ভাবেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এঘটনার পর বিজিএমইএ ও সরকারের স্বররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিভিন্ন অনিয়মের খোজও পায় কমিটি দুটো কিন্তু এসব তদন্তের ফলাফল বড় আকারে প্রকাশ পেল সাভারের রানা প্লাজায়। বুজে-শুনেই মৃত্যু কূপে ছেড়ে দেয়া হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। অনেকে প্রাণে বেচে গেলেও এখন পর্যন্ত মৃতের তালিকা চুড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। এযেন লাশের মিছিল। আন্তর্জাতিক ভাবে নিন্দানীয় এই ঘটনার প্রতিবাদ আসলেও কতখানি টনক নড়বে সরকারও সংশ্লিষ্ট্যদের তা পূর্বেকার ঘটনা থেকে কিছুটা নয় পুরোটায় অনুমাণ করা যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একের পর এক ট্রাজিডি সরকার বা সংশ্লিষ্ট্যদের কোন শিক্ষায় দিতে পারছে না। সচেতন হচ্ছে না তারা। নিচ্ছে না কোন কর্ম পরিকল্পনা এসব ঘটনা রোধ করতে। ঘটনা ঘটার পরই দেখা যায় সরকারের ব্যস্ততা। কিছু দিন যেতে না যেতে আবার পূর্বের অবস্থা। আবার কোন নতুন ট্রাজিডি।

প্রশাসনিক অনিয়ম, রাজনৈতিক দূর্বিত্তায়ন, আর্থিক দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার না থাকাকে এসব ঘটনার পেছনে দায়ি করছেন সবাই।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.