অশ্লীল বক্তব্যের লাগাম টানা যাচ্ছে না

জুন ২৪, ২০১৩

ParliamentSM2012030617590420130610083420ঢাকা জার্নাল: স্পিকার বার বার সাবধান করলেও তাতে কর্ণপাত না করে সংসদে অশ্লীল ও অসংসদীয় ভাষার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে যাচ্ছেন দু’দলের সদস্যরাই। টেবিল চাপড়িয়ে তাতে সমর্থনও জোগাচ্ছেন উভয় দলের জেষ্ঠ্য সদস্যরা।

রোববারও তার ব্যতয় ঘটেনি। এদিনও বিরোধী দলের নবীন সদস্য রেহানা আক্তার রানু বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, তার প্রয়াত স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অশালীন বক্তব্য দিলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সংসদ কক্ষ।

জবাবে ছেড়ে কথা বলেননি সরকারি দলের ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পিও। আর সংসদ কক্ষে এসব অশোভন কথার প্রতিবাদে ওয়াকআউট করে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সরকারি দলের সদস্য এম এ লতিফ।

এদিকে অসংসদীয় বক্তব্যের লাগাম টানতে স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী রানুর বরাদ্দকৃত ১৭ মিনিটে ছয় দফা এবং বাপ্পির দু’দফা মাইক বন্ধ করে দেন। কিন্তু এরপরেও তারা বাজেট আলোচনায় ফেরেননি। রানুর বক্তব্যের এক পর্যায়ে উত্তেজিত সরকার দলীয় কয়েক সদস্য তার দিকে আক্রমনাত্বক ভঙ্গিতে ছুটে আসার চেষ্টা করেন।

অপরদিকে রানুর মাইক বন্ধ করায় এবং জিয়াউর রহমানকে খুনি আখ্যায়িত করার পরও বাপ্পির মাইক বন্ধ করতে দেরি হওয়ায় মাগরিবের নামাজের বিরতীর পর প্রতিকীভাবে ওয়াকআউটও করেন বিরোধী দলের সদস্যরা। তারা স্পিকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। স্পিকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন সরকারি দলের সদস্যরা।

রানুর বক্তব্য চলাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ চেয়ারে বসে বিভিন্ন ফাইলে স্বাক্ষর করছিলেন। তবে বাপ্পির বক্তব্যের সময় তিনি কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না।

চলতি অধিবেশনে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্যের শুরু হয় গত ৫ জুন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দীকি এটি শুরু করেন। এরপর তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে বিরোধী দলের কয়েকজন সদস্য অসংসদীয় ও আপত্তিজনক বক্তব্য দেন। যা সারাদেশে বেশ আলোচিত হয়।

পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে গত রোববার সংসদ সদস্যদের সতর্ক করে রুলিং দেন স্পিকার। কিন্তু ওই রুলিং এ কেউই কর্ণপাত করছেন না। এরপরেও দু’দলের সদস্যরা বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্য করে অশালীন বক্তব্য দেন।

রোববার মাগরিবের নামাজের আগে বাজেট আলোচনার সুযোগ পেয়ে বিরোধী দলের রেহানা আক্তার রানু বক্তৃতা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রীকে কট্টাক্ষ করে। তিনি বলেন, আজ ঐতিহাসিক ২৩ জুন। আজ আমার ১৯৯৬ সালের ২৩ জুনের কথা মনে পড়ে গেলো। আওয়ামী লীগ নেত্রী কাতান শাড়ি পরে সেজেগুজে বসে আছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাবেন। শপথ নিতে যাচ্ছেন না। কিসের জন্য জানি অপেক্ষা করছেন। আমরা ছোট বেলায় পড়েছি আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই…। সেই সুরে সুরে উনি দলের নেতা-কর্মীদের ডেকে ডেকে বলছেন আয় সন্ত্রাসীরা আয় বাকশালীরা খুন করিতে যাই, লাশের মালা গলায় নিয়ে দেশ শাসনে যাই।

রানু বলেন, সরকারের দুর্নীতির কলিজা কাঁপানো অভিযোগ আছে আমার কাছে।

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের বড় শত্রু তাদের নেতা-নেত্রীদের জিহ্বা। সংখ্যা গরিষ্ট মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। এটা বাংলাদেশের পার্লামেন্ট। গত ২০ জুন এক হিন্দু সংসদ সদস্য ফেনসিডিল-ইয়াবা খেয়ে, আমাদের নেত্রীকে নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তা কুৎসিত, নোংরা।

অপু উকিলকে কটাক্ষ করে তিনি আরও বলেন, থুথু ছিটাই তার মুখে। তিনি সিদ্দিক সালিকের লেখা একটি বইয়ের কথা বলেছেন। আমি চ্যলেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি এ নামে কোন বই নেই। উনার স্বপ্ন দোষ আছে। স্বপ্নে উনি ওই বই পেয়েছেন। এই বইয়ের প্রকাশক, লেখক উনার নেত্রী।

এরপরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি কটাক্ষ করে বক্তব্য রাখেন রানু। বলেন, সরকারি দলের এক সদস্য আমাদেরকে শুয়োর বলেছেন, তাহলে আমাদের জাতির পিতা কি ?

জঙ্গী নেতা আব্দুর রহমান বাংলা ভাই আওয়ামী লীগের এক এমপির দুলা ভাই। মন্ত্রী সোহেল তাজ আওয়ামী লীগকে তালাক দিয়ে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে রানু বলেন, পুরুষ নির্যাতনের অনন্য উদাহরন ড. ওয়াজেদ মিয়া। ওয়াজেদ মিয়া একবার নেত্রীর (খালেদা জিয়া) কাছে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ঘরের মহিলার জ্বালায় আমি অতিষ্ঠ।’

আওয়ামী লীগ স্বপ্নভঙ্গকারি উল্লেখ করে রানু বলেন, ডেপুটি স্পিকারের স্বপ্ন ছিল স্পিকার হবেন। উনার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। উনার হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ চলছে। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে নরসিংদীর লোকমানের মায়েরও।

বিএনপির এই সদস্য আরও বলেন, যারা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তারা ব্লগার রাজিবের পেতাত্মা। তারেক রহমান যেদিন ফিরবেন সেদিন উনাদের থোতা মুখ ভোতা হয়ে যাবে।

রানু বলেন, আমার কাছে একটা বই আছে, মতিউর রহমান রিন্টুর লেখা- আমার ফাঁসি চাই, এই বই পড়লে উনারা (সরকারী দলের সদস্যরা) বান্দরের মতো লাফালাফি করবেন। মজার বিষয় ওয়াক আউট করতে পারবেন না।

রানুর এ বক্তব্যের সময় ছয় বার মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। উত্তেজিত হয়ে হৈচৈ, টেবিলের ওপর ফাইল চাপড়ে প্রতিবাদ করেন সরকারি দলের সদস্যরা। চীফ হুইপসহ সিনিয়র মন্ত্রীরা দাঁড়িয়ে মাইক বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ জানান।

ঢাকার সাংসদ আসলামুল হক আসলাম, মেহেরপুরের জয়নাল আবেদিনসহ কয়েকজন সদস্য চেয়ার ছেড়ে রানুর দিকে মারমুখী হয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় নিজ আসনে বসে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিসহ অন্য সদস্যরা। তারা টেবিল চাপড়িয়ে রানুর বক্তব্যে সমর্থন জোগান।

পরে মাগরিবের নামাজের বিরতী দিলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। বিরতীর সময় সরকারি দলের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে স্পীকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বাপ্পি বলেন, গত ২০ জুন বিরোধী দলীয় একজন সংসদ সদস্য বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন বিকৃত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তার ঐ বক্তব্যের ধিক্কার জানাই।

খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে বাপ্পী বলেন, উনি (খালেদা জিয়া) ৮৩ দিন পর সংসদে এসে হাজিরা দিয়ে চলে গেছেন। বেতন-ভাতা ঠিক রাখতেই তিনি এসেছিলেন। এসে হাজিরা দিয়ে চিকিৎসার নামে সিঙ্গাপুর গেছেন। উনি সিঙ্গাপুর গেলেই দেশের মানুষ আতঙ্কে থাকে। সেখানে গিয়ে না জানি দেশের বিরেুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র করে এলেন। এর আগে একবার সিঙ্গাপুর থেকে এসে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্ঠা করেছিলেন।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ওমরা করতে সৌদি আরব যান। উনি যখন ওমরা করতে যান তখন তার পেছন থেকে হুইল চেয়ার ঠেলেন কে ? যিনি চেয়ার ঠেলেন তিনি কি খালেদার পাহারাদার। ২০০৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে, এই ব্যাক্তির সঙ্গে খালেদার কাবিননামা প্রকাশ করা হয়েছিল।

তারেক রহমানের সমালোচনা করে বাপ্পী বলেন, তারেক একটি আতঙ্কের নাম। এদেশের মানুষ সেই আতঙ্ক থেকে মুক্তি চান। তারেক রহমান সিঙ্গাপুরে বাড়ীতে থাকেন সেই বাড়ির মালিক পাকিস্তানের এবং তারেকের গাড়ীর ড্রাইভারও পাকিস্তানী।

বাপ্পী বলেন তারেক রহমানের গৃহ পরিচারিকা নয়নতারাকে গুম করা হলো কেন? তারেকের সব কু-কীর্তি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে মা-ছেলে মিলে নয়ন তারাকে গুম করেছেন।
তারেক-কোকো দুই ভাই ও তার মামা সাইদ ইস্কেনদার মিলে দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবনে কতো মেয়ের ইজ্জত হনন করা হয়েছে তার হিসাব নেই।

মওদুদ আহমেদের লেখা একটি বই দেখিয়ে বাপ্পি বলেন, মওদুদ সাহেব তার বইতে লিখেছেন, বিএনপির জন্ম ভোগের রাজনীতি থেকে। খালেদা জিয়ার জন্মেরও ঠিক নেই। জিয়াউর রহমানকে খুনি আখ্যায়িত করে বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আফসারুল আমিনও।

এদিকে সংসদে একের পর এক অশালীল বক্তব্য দেওয়ার প্রতিবাদে নিজ বক্তব্য থেকে বিরত থেকে অধিবেশন থেকে ঘোষণা দিয়ে ওয়াকআউট করেন চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সরকারি দলের সদস্য এম এ লতিফ। তার ওয়াকআউটের সময় বিরোধী দলের সদস্যরা হৈচৈ শুরু করলে তিনি বলেন, আমি কোন দলের সদস্যকে উদ্দেশ্য করে এটা করছি না। যারাই সংসদে অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন সেসবের প্রতিবাদে এটা করেছি। এতে আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত। পরে সরকারি দলের নবীন সদস্য জুনায়েদ আহমেদ পলকও এসব ভাষার প্রতিবাদে বিভিন্ন কথা বলেন। তিনি বলেন, আপনারা যারা এসব বক্তব্য দিচ্ছেন তাদের সন্তানরাও তো লাইভ সংসদ দেখছে। তারা আপনাদের কাছ থেকে কি শিক্ষা নিচ্ছে।

ঢাকা জার্নাল, জুন ২৩, ২০১৩।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.