অর্থনৈতিক কৌশল সাফল্যমণ্ডিত বললেন অর্থমন্ত্রী
ঢাকা জার্নাল : রাজনৈতিক মতানৈক্যসহ বিগত চার বছরে অনিশ্চয়তা ও প্রতিকূলতার পরেও অর্থনীতি মোটামোটি স্থিতিশীল বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তিনি বলেন, ২০১৩-২০১৪ বাজেটের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর)প্রথম প্রান্তিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) ২৭ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বুধবার জাতীয় সংসদের ‘বাজেট ২০১৩-১৪ : প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লষণ সংক্রান্ত্র প্রতিবেদন’ উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন।
অর্থমন্ত্রীবলেন, প্রথম প্রান্তিকে ব্যয় বাড়ার পাশপাশি রাজস্ব আহরণ গত প্রান্তিকের চেয়ে বেশি। ধারাবাহিক অগ্রগতি ধরে রাখতে পারলে বহুমূখী সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে মধ্য মেয়াদে রাজস্ব অর্জন কাঙ্খিত হারে বৃদ্ধি পাবে।তিনি জানান, এ সময়ে আমদানি ও রপ্তানি ব্যয় এবং কৃষি, শিল্প ও ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে।
অপরদিকে রাজনৈতিক সহিংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে মূল্যস্ফিতি বেড়েছে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে আমদনীর বিপরীতে ব্যয় বেড়েছে। প্রবাসীদের আয়ের বড় অর্থ পাসপোর্ট-ভিসা ও বৈধকরণের কারণে প্রবাস আয় কমেছে বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজনৈতিক মতানৈক্য ও সমস্যা জাতীয় সংসদে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের সংস্কৃতি গড়ে তুলে গণন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার বড় প্রতিবন্ধক হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচির ছত্রছায়ায় সহিংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে দেশের অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ করে দেওয়ার আত্মঘাতি কৌশল। আমাদের এ আত্মবিনাশী কৌশল প্রয়োগ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে অর্থনৈতিক নীতি কৌশলের ধারাবাহিক বাস্তবায়নেই সফল হবে দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন আর অসাম্প্রদায়িক মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ বিনির্মাণ।
অর্থমন্ত্রী বলেন, গত সাড়ে চার বছরে নানা অনিশ্চয়তা এবং প্রতিকূলতা সত্তেও দেশে মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এতে আমাদের অর্থনৈতিক কৌশল বিশেষভাবে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক নীতি কৌশলের সফল বাস্তবায়ন বিগত ২০০৯ থেকে ২০১৩ মেয়াদে গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ৬০৮ মার্কিন ডলার থেকে ২০১৩ সালে এক হাজার ৪৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
তিনি জানান, উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ও সুষম বণ্টনের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার হার ২০০৫ সালের ৪০ শতাংশ থেকে কমে ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। আর ২০১৩ সালে তা ২৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ও দারিদ্র্যহ্রাসের হারের এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশকে মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত করা যাবে। তবে আমাদের এ অর্জনের ধারাবাহিকতা রক্ষার সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছ অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রেখে উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডের গতি বেগবান করা।
আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আওতাধীন কর-রাজস্ব আদায় বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, একই সময়ের তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে ২৭ শতাংশ, রফতানি আয় ২১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমদানি ব্যয় সাড়ে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমদানি ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির প্রবৃদ্ধি যথাত্রক্রমে ৯ দশমিক ৮ এবং ৮ দশমিক ৯ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রবাস আয় হ্রাস পেয়েছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে ছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। কৃষিখাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ২৬ দশমিক ০২ শতাংশ। ১২ মাসে গড় মহৃল্যম্ফীতি সেপ্টেম্বর ২০১২- এ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৩- এ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
তিনি জানান, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে মোট রাজস্ব আহরিত হয়েছে ৩৬ হাজার ২০৯ কোটি টাকা, আগের অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী ।
অন্যদিকে রাজস্ব আহরণের বিপরীতে প্রাক্কলন ও ব্যয়ও বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, চলতি ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে মোট বাজেটে ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে মোট ব্যয় হয়েছে ৩১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
মুহিত বলেন, সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় মোট ব্যয় ১১ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ২০ দশমিক ২ শতাংশ এবং অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে অর্থমন্ত্রী ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি সন্তোষজনক বললেও ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই অর্থবছরে মূল্যম্ফীতি বেড়েছে। বৈদেশিক আমদানি খাতেও ব্যয় বেড়েছে। এই সময়ে মহৃল্যম্ফীতি বেড়েছে দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যে মূল্যম্ফীতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে রেমিটেন্স কমেছে ৮ দশমিক ১১ শতাংশ।
প্রতিবেদনের শুরুতে অর্থমন্ত্রী বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে মূলতঃ দেশের সড়ক ও রেল পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধারণের ফলে প্রথম প্রান্তিকের তিন মাসে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতি বাধাগ্রস্থ হয়েছে। ফলে এক দিকে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ সীমিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে তারা পণ্যের যথাযথ মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। শিল্প ও ভোগ্য পণ্য পরিবহনে ঝুঁকির কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ে।বৈদেশিক সম্পদ ব্যবহারের গতিও শ্লথ হয়ে পড়ে। এমনি উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসের বাজেট বাস্তবায়ন কর্মকান্ডের তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ উত্থাপন করছি।
ঢাকা জার্নাল, মার্চ ১২, ২০১৪।