শহীদ কাদরীর স্মৃতিতে- কবি শামসুর রাহমান

আগস্ট ১৭, ২০১৩

arts-bg20130817065415ঢাকা জার্নাল: [কবি শহীদ কাদরী দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে তাঁর ছিল দীর্ঘদিনের আন্তরিক সম্পর্ক। সঙ্গতকারণেই কবি শামসুর রাহমানের প্রয়াণের খবর শুনে শহীদ কাদরী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। শামসুর রাহমানের প্রয়াণের পরপরই ২০০৬ সালের ২০ আগষ্ট নিউইয়র্কে কবি শামসুর রাহমান স্মরণসন্ধ্যা উদযাপন করা হয়েছিল প্রবাসী বাঙালি কবি-লেখকদের আয়োজনে। ওই স্মরণসন্ধ্যায় কবি শহীদ কাদরী অসুস্থ শরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন কবিবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে। উল্লেখ্য, আদনান সৈয়দ শহীদ কাদরীর সেই স্মৃতিচারণটি রেকর্ড করে ধারণ করেছিলেন। আদনান সৈয়দের সৌজন্যে শামসুর রাহমানের ৭ম প্রয়াণ দিবসে কবি শহীদ কাদরীর সেই স্মৃতিচারণটি ঢাকা জার্নালের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।]

শহীদ কাদরীর স্মৃতিতে- কবি শামসুর রাহমান
আমি সত্যি এখনও শামসুর রাহমানের এই প্রয়াণ মেনে নিতে পারছি না। বছর দুয়েক আগে আমার সাথে শামসুর রাহমানের শেষ কথা হয় টেলিফোনে। তখন আমি অসুস্থ এবং শামসুর রাহমান নিজেও অসুস্থ ছিলেন। তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন I sincerely wish your speedy recovery। তারপর আর শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার কথা হয়নি। কিন্তু আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শামসুর রাহমানকে সেই কৈশরকাল থেকে চেনা। কবিতাপাঠ এবং কবিতা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর…

আমাদের কলকাতার এক বন্ধু ছিলেন যাঁর মাধ্যমেই কবি শামসুর রাহমানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। আমরা ৫২ সালে ঢাকায় এসেছিলাম। ৫৪ সালে আমাদের এক বন্ধু- নাম খোকন কলকাতায় যার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল, হঠাৎ তিনি ঢাকায় আমাদের বাসায় এসে হাজির হলেন। তিনি আবার আমার বড় ভাইয়ের ক্লাশমেটও ছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, এই তোরা এসেছিস কবে?

তখন আমি সুকান্তের কবিতার একজন নিমজ্জিত পাঠক। সুকান্তের মতোই লেখার চেষ্টা করছি। তা আমার বড় ভাই খোকনকে বললেন, শহীদতো আজকাল কবিতা-টবিতা লেখার চেষ্টা করছে, জানিস নাকি? তখন তিনি আমাকে বললেন, দেখাতো তোর কবিতা? তিনি আমার কবিতা দেখলেন-টেখলেন কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না। তখন আমাকে খোকন বললেন, তুই শামসুর রাহমানের নাম শুনেছিস?
আমি বললাম, নাতো?
কী বলিস? শামসুর রাহমানের কবিতা প্রত্যেক সপ্তাহে ‘দেশ’-এ ছাপা হচ্ছে!

তখন পর্যন্ত আমি শামসুর রাহমানের নাম শুনিনি। সদরঘাটের উল্টোদিকে একটা খান মজলিসের বুক স্টল ছিল এবং সেখানে পরিচয়, নতুন সাহিত্য, দেশ, পূর্বাশা সহ সবরকম পত্রিকাই আসতো। এরমধ্যে আমার একটি কি দুটি কবিতা হয়তো ছাপাও হয়েছে। তখন মহিউদ্দিন আহমেদ সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন নাম ছিল স্পন্দন। স্পন্দন-এ আমার একটা কবিতা প্রকাশিত হয়।

কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই নিজেকে লেখক-টেখক ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম। ঐ কবিতাটি ছিল টিপিক্যাল মার্কসিস্ট ধরনের, কিছুটা মঙ্গলাচরণ ভাবধারায় লেখা। তারপর পূর্বাশা আর চতুরঙ্গ পড়তে শুরু করলাম এবং আমার চিন্তা-ভাবনা ধীরে ধীরে রোমান্টিক কবিতার দিকে মোড় নিল। তখন আমি ‘জলকন্যার জন্যে’ কবিতাটি লিখি। কবিতাটি খুবই আনাড়ি ছিল তবে এই কবিতাটির শরীর জুড়ে ছিল এক ধরনের বিষণ্ণ রোমান্টিকতা। এর মধ্যে একদিন খোকন আমাকে বললেন যে তোর কথা আমি শামসুর রাহমানকে বলব এবং তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।

‘জলকন্যার জন্যে’ কবিতাটি ছাপা হবার পর থেকে আমি প্রায়ই পত্রিকার স্টলে দাঁড়িয়ে আমার কবিতাটি বারবার পড়তাম এবং আঁড় চোখে দেখতাম যে তা অন্য কেউ পড়ছে কিনা? তো রোজই আমাকে এ কাজ করতে হতো। একদিন প্রায় দুপুর বেলা স্টলে দাঁড়িয়ে আছি এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কবিতাটি পড়ছি। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমাকে যে একজন ভদ্রলোক লক্ষ্য করছিলেন তা আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি খুব ফর্সামতো মানে সর্ব অর্থে সুন্দর একজন সুপুরুষ স্পন্দন খুলে আমার কবিতাটি পড়ছে। তখন আমাদের চোখাচোখি হলো। শামসুর রাহমান তখন আমাকে বললেন, আচ্ছা আপনি কী শহীদ কাদরী?
আমি বললাম, হ্যাঁ, কী করে বুঝলেন?
আপনার কথা আমাকে খোকন বলেছে।

আমি খুব অভিভূত হয়ে গেলাম শামসুর রাহমানের সাথে পরিচিত হয়ে। তখন সদরঘাটে একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো নাম রিভার ভিউ। সেখানেই চা খেতে খেতে শামসুর রাহমানকে বললাম, আপনার  কবিতাতো ‘দেশ’-এ পড়ছি। তখন শামসুর রাহমান তাঁর পকেট থেকে বের করে অনেকগুলো কবিতা আমাকে পাঠ করে শোনালেন। তখন আমাদের সবার পকেটেই কবিতা থাকতো। তা আমি বললাম যে আমার পকেটেও একটা কবিতা আছে, শুনবেন? তখন আমি কবিতাটি পড়ে শুনালাম। সেটাও ছিল গতানুগতিক রোমান্টিক ধারার একটা কবিতা। তা ঐ কবিতায় একটা লাইনে ‘ভুল’ শব্দটির দিকে ইঙ্গিত করে শামসুর রাহমান বললেন যে ভুল শব্দটার বানান ভুল হয়েছে।

সেখান থেকে শামসুর রাহমানের বাসায় গেলাম। শামসুর রাহমান আমাকে বললেন, কালের পুতুল পড়তে। সেই থেকে আমরা বহুদিন মধ্যরাত পর্যন্ত একসাথে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, চা খেয়েছি, সিগারেট খেয়েছি। আমাদের আড্ডায় ফজল শাহাবুদ্দিন থাকতো আর মাঝে মাঝে আল মাহমুদ যোগ দিতো।

শামসুর রাহমানের উপর এতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে আমি এ মুহূর্তে বুঝতে পারছি না যে, আমি কোনটা ছোঁব আর কোনটা ছোঁব না। এখনও আমার মনে হচ্ছে শামসুর রাহমান আছেন এবং আমি সুস্থ হয়ে যখন ঢাকায় যাব তখন শামসুর রাহমানের সাথে আমার আবার দেখা হবে। তাই প্রেস সত্ত্বেও, টিভি সত্ত্বেও শামসুর রাহমানের প্রয়াণের খবর আমার কাছে ভয়াবহভাবে অপ্রত্যাশিত। আমি পুরোপুরিভাবে এখনও এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি…

আমার মতে, আমি বিশ্বাস করি যে ১৯৪৭ সাল পার হওয়ার পর এই মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম ফসল কবি শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমান আমাদের এই দেশে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সুচারু, যা কিছু সংবেদনশীল, যা কিছু মহৎ, যা কিছু শ্রেষ্ঠ তার সবকিছুর এক অসমান্য সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। শামসুর রাহমান সারা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

আদনান সৈয়দ: লেখক, প্রাবন্ধিক

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ১৭, ২০১৩

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.