জোছনার হাহাকারের উ‍ৎস সন্ধানে জীবন পার করলাম

জুলাই ২১, ২০১৩


Humayoun Ahmedএস এম আববাস: 
মেঘের দেশে বাড়ি এখন হুময়ায়ূন আহমেদের। তার কথায় বলতে হয় ‘মেঘের ওপর বাড়ি’। ওপারে যাওয়ার প্রস্তুতি ছিলো তাঁর। তবে শেষ প্রস্তুতি কি নিতে পেরেছিলেন? ক্যান্সারে মৃত্যু হয়নি তার। অবহেলার কারণে ‘ইনফেকশনে’ মারা গেছেন। তবে যেভাবেই মৃত্যু হোক না কেনো, মৃত্যু যে তাঁর পিছু ছাড়ছে না, সে বিষয়টি নিশ্চিত ছিলেন হুমায়ূন।

অবহেলায় যদি তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকে, তাহলে শেষ প্রস্তুতি নেয়ার আগেই তাঁকে মেঘের ওপারে চলে যেতে হয়েছে। নুহাশপল্লী ট্রাস্ট করতে চেয়েছিলেন, তা হয়নি। ক্যান্সার হাসপাতাল করার প্রস্তুতিও তিনি নিতে পারেননি। এমনকি তার প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোনার স্কুলটিরও শেষ গতি হয়নি।

এভাবে হুমায়ূন চলে যাবেন তা হতে পারে না। তাঁর শুভাকাঙ্খী, ভক্তরা কেউ মেনে নিতে পারছেন না প্রিয় বান্ধবের এই অসময় প্রস্থান। তাঁর প্রিয় সন্তানরা বাবার মৃত্যুতে কতটা শুন্য হয়ে পড়েছে তা তাদের অসহায় কান্না দেখে বুঝেছে মানুষ।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু শুধু একজন বাবার মৃত্যু নয়, কিংবা আয়েশা ফয়েজের সন্তানের মৃত্যু নয়। একটি নক্ষত্রের পতন। তাঁর সংসারের প্রিয়জন ছাড়াও সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তাঁর শুন্যতা উপলদ্ধি করে। আমরা তা করছি বাংলা সাহিত্যের নতুন দিকপাল এক নক্ষত্রকে হারিয়ে।

মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় সে নিজেই। আর সে যখন বুঝতে পারে তার চলে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। তখন তার নিজের কাছে যে শুন্যতা সৃষ্টি হয়, তাতে নিজেকে সমৃদ্ধ করে; সমাজের মানুষকেও সমৃদ্ধ করতে পারে তার প্রতিভা দিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ তা করেছেন।

ক্যান্সার সনাক্ত হওয়ার আগেই হুমায়ূন বুঝতে পেরেছিলেন তার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। তার অবচেতন মন তাকে তার উপলদ্ধির জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছিলো। লেখক নিজে তা স্পষ্টভাবে লিখে গেছেন।

‘মেঘের ওপর বাড়ি’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে ভূমিকায় সূচনা পর্বের ‘অন্যকথা’য় লিখেছেন, “যখন আমি এই উপন্যাসটি লিখি, তখন ক্যান্সার নামক জটিল ব্যাধি আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে। এই খবরটা আমি জানি না। ক্যান্সার সংসার পেতেছে আমার কোলনে, সেখান থেকে রক্তের ভেতর দিয়ে সারা শরীরে ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার অবচেতন মন কি এই খবরটা পেয়েছে? আমার ধারণা পেয়েছে। সে কারণে আমি উপন্যাস ফেঁদেছি একজন মৃত মানুষের জবানবন্দিতে। উপন্যাসে এক মহিলার কথা আছে, যার হয়েছে কোলন ক্যান্সার। সেই ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে।”

উপন্যাস লেখার পর লেখক জানলেন তার ক্যান্সার হয়েছে। তাঁর নিজের কাছে যে শুন্যতা, তা প্রিয়জন হারানোর শুন্যতার চেয়েও বেশি নিশ্চয়। হুমায়ূন আহমেদ মেঘের ওপর বাড়ি উপন্যাসটির কাভার পেইজের ভেতরে লিখেছেন- মৃত্যু ও লাশ কাটা ঘরে কিভাবে পলিথিন বিছানো টেবিলে শুয়ে আছেন তার বর্ণনা।

হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, “লাশকাটা ঘরের পলিথিন বিছানো নোংরা টেবিলে আমার শরীর চিৎ হয়ে আছে। গায়ে কোনো কাপড় নেই। টেবিল থেকে ফিনাইলের কঠিন গন্ধ আসছে। ঘরের জানালা আছে। জানালায় হলুদ রঙের পর্দা ঝুলছে। পর্দা নোংরা। সেখানে বড় বড় নীল রঙের মাছি বসে আছে। মাছিগুলো কিছুক্ষণ বসে থাকে আবার ওড়াউড়ি করে পর্দার ওপর বসে। ঘরের চারটা দেয়ালের একটায় চুনকাম করা হয়েছে, সেখানে কেউ নোংরা কথা লিখেছে।”

Humayoun ah 3লেখকের নিজের মৃত্যুর পর তার অবস্থা কেমন হবে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এই লেখায়। এখানে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করার মত। তাঁর মৃত্যু কাছাকাছি সময়ে এবং মৃত্যুটি আর পাঁচজনের মত স্বাভাবিক নয়, তা তুলে ধরেছেন। অস্বাভাবিক ক্ষেত্রে যা হয় তাই। তবে হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর পর তার ভাবনার চেয়ে একটু বেশিই ঘটেছে বলে মনে করেন সবাই।

তাঁর লেখায় দেশি লাশকাটা ঘরের বর্নণা ফুটে উঠেছে। দেশের মাটিতে মৃত্যু কামনা এটি তার দেশপ্রেম ও বাস্তবতা। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে লাশকাটা ঘরের জরাজীর্ণতা। আর আমাদের কুরুচির বহিঃপ্রকাশ সেখানেও কেউ লিখে প্রকাশ করতে পারেন, এমন বাস্তবতা রয়েছে ছোট্ট এই লেখাটির মধ্যে। লেখাটিতে হিমুর পোশাকের রঙ ব্যবহার করা হয়েছে লাশকাটা ঘরের জানালার পর্দায়।

সেক্সপিয়ারের নাটকে মৃত্যু কোনো ট্রাজেডি নয়। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে বা নাটকে মৃত্যু একটি বড় ট্রাজেডি। এইসব দিন রাত্রি নাটকে ছোট্ট টুনির ক্যান্সারে মৃত্যু কতটা বেদনাদায়ক কাহিনী, তার উপস্থাপন দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। অবশ্য হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা আরো বেশি ট্রাজিডি হয়ে দেখা দিয়েছে।

‘মেঘের ওপরে বাড়ি’ বইটি তাঁর নিজের চলে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বের লেখা। এই বইটির কাভার পেইজের শেষাংশে তার নিজের শেষ জীবনের কিছু অংশের দিন-রাতের কথা তুলে ধরেছেন।

লিখেছেন, “মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। চল্লিশ বছর লেখালেখি করে আমি আনন্দিত, ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি। জ্যোৎন্সা আমার প্রিয় বিষয়। প্রতি পূর্ণিমাতেই নুহাশপল্লীতে যাই জোছনা দেখতে। প্রবল জোছনা আমার মধ্যে এক ধরণের হাহাকার তৈরি করে। সেই হাহাকারের উৎস অনুসন্ধান করে জীবন পার করে দিলাম।”

এই লেখাতে বোঝা যায়, মৃত্যুর আগাম সংকেত পেয়ে নিজেকে গোছাতে চেষ্টা করেছেন হুমায়ূন। সবটুকু পারেননি। মৃত্যু তাকে সে সময় দেয়নি। আরো কিছু করার ইঙ্গিত রয়েছে তাঁর লেখায়। ‘প্রবল জোছনা’র তৈরি করা হাহাকারের উৎস হুমায়ূন আহমেদ খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা আমরা জানি না। তবে মৃত্যু ও সৃষ্টি রহস্য তাকে তাড়া করেছে তাঁর চেতনায়, তা সত্যি। ঋদ্ধ পাঠক মাত্রেই তা বুঝবেন।

হুমায়ূন মৃত্যুর আগাম সংকেতে পেয়ে তার দায়বোধ থেকে শিশু সন্তানদের উদ্দেশ্যে বই উৎসর্গ করেছেন। ‘বল পয়েন্ট’ উৎসর্গের লেখায় উল্লেখ করেছেন “আমাকে খুব বেশি দিন কাছে পাবে না বলে মনে হচ্ছে।”

নিউইয়র্কের ‘নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ’ বইটির শুরুতে তাঁর দায়বোধ কতটা সুক্ষ্ম তা সুন্দরভাবে লিখেছেন। তাঁর লেখার মধ্যে তরুণী স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের কথা রয়েছে। “কেমোথেরাপি হলো দীর্ঘ বেদনাদায়ক নিঃসঙ্গ ভ্রমণ। যে তরুণী আমার এই ভ্রমণে আছে, তার নাম শাওন। আমার দুই পুত্র নিনিত ও নিষাদের মমতাময়ী মা। ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ বইটি এই তরুণীর জন্য। যে করুণা, মমতা এবং ভালোবাসা সে আমাকে দেখিয়েছে, পরম করুণাময় যেন তা বহুগুণে তাকে ফেরত দেন, এই শুভ কামনা।”

হুমায়ূন আহমেদ মহৎ ব্যক্তি হিসেবে সে মহত্ম দেখিয়েছেন। শাওনের দায়িত্বটাকে করুণা হিসেবে দেখে শাওনের জন্য করুণা, মমতা এবং ভালোবাসা চেয়েছেন পরম করুণাময়ের কাছে।

Humayoun Ah 2লেখক তার মহৎ মনের পরিচয় দিয়েছেন। নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছেন। জানি না কতটুকু প্রস্তুতি তিনি নিতে পেরেছিলেন। তবে আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না, তার মৃত্যুর জন্য।

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকীন ও তার সন্তান এবং ভাই জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব মহানুভবতা দেখিয়েছেন। তার কিছু দেখতে পাই হিমঘরে যেন লাশ রাখা না হয়, সেই সিদ্ধান্ত জানানোর মধ্য দিয়ে।

হুমায়ূন আহমেদ লাশকাটা ঘরে তার কি অবস্থা হতে পারে তা নিশ্চিত করেছিলেন তার লেখায়। তবে নিশ্চয় এটুকু নিশ্চিত ছিলেন না প্রিয় একজনের জন্য হয়তো তাকে হিমঘরে দীর্ঘ সময় থাকতে হতে পারে।

যে শাওনের জন্য পরম করুণাময়ের কাছে করুণা, মমতা এবং ভালোবাসা চেয়ে মেঘের দেশে চলে গেছেন হুমায়ূন। সেই বোধটুকু যেনো ভবিষ্যতেও দেখতে পাই শাওনের মধ্যে। জীবনের শেষ চাওয়াটুকু পূরণে যেন শাওন সহযোগিতা করেন। তাহলে মেঘের ওপারের মানুষটি সেখানকার জ্যোৎস্নায়ও শাওনকে খুঁজে পাবেন বারবার।

Posted 31st July 2012 by Unknown
Labels: এস এম আববাস বাংলানিউজ সাহিত্য

ঢাকা জার্নাল, জুলাই ২১, ২০১৩।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.