হান্নান কল্লোলের মায়ামরীচিকা

জুন ২৬, ২০১৩

252276_394148407368017_1899026088_nতুমি একটা অঘা, বলেই অধরা খিলখিল করে হেসে বের হয়ে যায়।
আদিত্যের কল্পনাপ্রবণ মনে সে অনুরাগের অনুভব সৃষ্টি করেনি, যন্ত্রণার ঝঙ্কার তুলেছে শুধু। তবু অধরার সান্নিধ্য কেন যে এত কাঙ্খিতা তা বুঝতে পারছে না সে।

 

 

মায়ামরীচিকা- হান্নান কল্লোল

জলযানের ভ্রমণক্লান্তি মুছে ফেলতে আদিত্য বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে ঘুমঘুম আবেশে। ধীরে ধীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অবচেতনার অতলে তলিয়ে যাবার আগে ছবির একটা থিম মাথায় আসে। সে ভাবতে থাকে ছবিটার চিত্রভাষা নিয়ে। কতিপয় মুষ্টিবদ্ধ কঙ্কালহাত…।

আদিত্যের কপালে তুষারশীতল স্পর্শ লাগে। চমকে ওঠে সে। নিদ্রাতুর চোখ মেলে তাকায়। শরবত হাতে অধরা দাঁড়িয়ে। মুখ টিপে হাসছে মিটিমিটি।

অধরা বিধবা ছোটমাসির পালিত মেয়ে। জন্মপরিচয়হীন সে। এমন এক মেয়ে সম্পর্কে আদিত্যের এতটুকু আগ্রহ বা কৌতুহল কোনোটাই আগে ছিল না। তার আকস্মিক আবির্ভাব আদিত্যের মধ্যে কিছুটা হলেও ভাবান্তর ঘটায়। তবে আচরণে তা প্রকাশ করতে রাজি নয় সে।

শরবতে চুমুক না দিয়েই আদিত্য অধরাকে কড়ামিষ্টি চা বানাতে বলে। সে চলে যাবার পর ঘরে ঢোকেন মা। নিচুস্বরে বলেন, বিকেলেই অধরার একটা ছবি এঁকে দিস তো। সেই কবে থেকে মেয়েটি ছবি আঁকানোর অপেক্ষায় আছে।

চুপচাপ শুয়ে আছে আদিত্য। মা টুকিটাকি কাজ করতে করতে ছেলের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, স্য-মিলটা তেমন চলছে না রে। তাড়াতাড়ি একটা চাকরির চেষ্টা র্ক। টাকাপয়সা লাগলে বলিস। পেনশনের ওয়ান-থার্ড আছে এখনও।

চায়ের পেয়ালা হাতে আসে অধরা। মা যেতে যেতে ফিরে এসে আলমিরাতে কী যেন খোঁজেন। কোনো কিছু না নিয়েই পা রাখেন চৌকাঠের বাইরে। অধরা আড়চোখে তাকায় আদিত্যের শুকনা মুখের দিকে। তাকায় আদিত্যও। চোখে চোখ পড়ে। হাসি হাসি মুখে অধরা চলে যায় পাকঘরে, পাকসাকে মাসিমাকে সাহায্য করবে বলে।

হাই তুলে বিছানা ছেড়ে আদিত্য উঠে দাঁড়ায়। অতিমিষ্ট চায়ে দুবার চুমুক দিয়ে মাটিতে ঢেলে ফেলে। উঠানে গিয়ে উঁকি মারে পাকঘরে। মা চিতুই পিঠা তৈরি করছেন। যাঁতাকলে মাসকলাই ভাঙছে অধরা। আদিত্যকে দেখে সে বক্রোক্তি করে, ডাল রাঁধব পুদিনা দিয়ে; খাবে তুমি নাক ডুবিয়ে।
মৃদু হেসে আদিত্য চলে আসে নিজের ঘরে। মন তার পড়ে থাকে অধরার আশপাশে।


বিকেলে আদিত্যের ভয়ানক ঘুম পায়। তবু ছবি আঁকার সরঞ্জাম সাজিয়ে অধরাকে ডাকে। সে আসে স্মিতমুখে। মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই আদিত্য বলে, ওই চেয়ারটায় বসুন, দেবী অরোরা! একটা জলছবি এঁকে দেই।

বুকের ওড়না নেড়েচেড়ে সে বসে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে। কাগজে রেখা টানতে টানতে আদিত্য জিগ্যেস করে, এসেছিস কবে?
এই তো মাসখানেক আগে। রেজাল্ট হবার পর মাসিমা নিয়ে এলেন।
কীসের রেজাল্ট রে?
অধরার মুখে কথার খই ফোটে।
তাও জান না বুঝি! এইস. এসসি. পরীক্ষার রেজাল্ট। এ প্লাস পেয়েছি। ফোন করে তোমাকে জানাবো ভেবেছিলাম। রাগে জানাইনি। তুমি তো আমার কোনো খবরই রাখো না। আচ্ছা, না রাখলে!
আদিত্য তাকে কথা থামানোর ইশারা দেয়। ইশারা কার্যকর হয়নি।
আমার ইচ্ছা ইউনিভার্সিটিতেতে পড়ার। মাসিমা বলেছেন, আমাকে ঢাকাতে পড়াবেন। তুমিও যখন ওইখানে আছ―
প্লিজ চুপ র্ক! ছবিটা শেষ করতে দে।
অধরা এবার স্থিরচিত্র হয়ে চেয়ারে বসা। আদিত্য এঁকে চলছে একাগ্রচিত্তে।
আঁকিবুঁকির পর কাগজে রঙমাখা তুলির আঁচড় টানছে আদিত্য। ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে এক মানবীর প্রতিরূপ। পেছন থেকে মা রঙের কারসাজি দেখছেন। আদিত্য খেয়াল করেনি। মা বলেন, ভারি সুন্দর হচ্ছে তো!
আঁকা শেষ করে শিল্পী তার শিল্পকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করে। ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি; চোখে বিষণœ দৃষ্টি। কেমন যেন মোনালিসা মোনালিসা লাগছে অধরাকে।
ছবিটা দেখতে দেখতে সন্ধ্যার আবছায়া নামে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে গুনগুনিয়ে গাওয়া অধরার অস্পষ্ট গান। আদিত্যের অন্তরে তা প্রতিধ্বনি হয়ে বেজে চলছে। মনে হচ্ছে তার জীবনেও যেন নেমে আসছে এ সন্ধ্যার কাঁই আঁধারের মতো মায়াবী এক অন্ধকার।


ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না আদিত্যের। মা’র কথামতো হিসাবটা দেখতে তাকে যেতেই হয় করাতকলে। কাঠচেরাইয়ের শব্দ তার মনটাকে খ–বিখ- করে ফেলছে যেন। সেখানে বেশিক্ষণ ঠিকতে পারে না সে।
শিশিরভেজা জোছনায় হাঁটতে হাঁটতে তার চিন্তায় ঘুরপাক খায় অধরার অতীত-ইতিহাস। জন্মের পরপরই কে বা কারা তাকে ফেলে রেখে গেল ছোটমাসির ঘরের দুয়ারে। নিঃসন্তান মাসির ঘরে সে সন্তানস্নেহে প্রতিপালিত হতে থাকল। কেউ জানল না, মেয়েটি হিন্দু কি মুসলমান, বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান; তার জন্ম কি বৈধ নাকি অবৈধ।
আমি তার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে ভাবছি কেন? মানুষের জাতধর্ম ও ধর্মকর্ম জানা না জানায় এমন কী আসে যায়! ভাবনায় বিরতি টেনে আদিত্য ঝোপঝাড়ের পাশে থামে। ছায়াচ্ছন্ন আলোয় একটা বনোফুল দেখে চোখ ও হৃদয় দিয়ে। ফুলটা ছেঁড়ার সময় একটা কাঁটা খচ করে তার আঙুলে ঢুকে পড়ে।
ফুল হাতে ঘরে ঢুকে আদিত্য দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। কারও পায়ের আওয়াজ পেয়ে বিছানায় বসে। অধরা এসে চাদরের একপ্রান্ত ধরে টানতে থাকে। উঠে দাঁড়ায় আদিত্য। চাদর ঝাড়ার শব্দে আদিত্যের লম্বা নিঃশ্বাস চাপা পড়ে। অধরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, কাল আমাদের বাড়ি যাই চলো, যাবে না?
আদিত্য নিরুত্তর। চোখে মুখে উদাসিতা। অসহ্য লাগে অধরার। সে বালিশ দুটো রাগে ছুড়ে মারে বিছানায়। বলে, সন্নাসী হবে নাকি?
এবারও আদিত্য নীরব। অধরার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে মনে মনে জবাব দেয়, বৈরাগ্য আমি চাই না জীবনে কিন্তু অসময়ে বাঁধা পড়ব না সংসারের মোহন শিকলে।
আদিত্যের না বলা কথা আঁচ করতে পারেনি অধরা। বেরিয়ে যাবার জন্য উদ্যত হয় সে। পিছু ডাকে আদিত্য।
অধরা, শোন্।
কী?
কিছু না।
ডাকলে কেন?
জানি না।
তাহলে যাই।
বোস্ না একটু।
বলবে কিছু?
কি বলবো?
তুমি একটা অঘা, বলেই অধরা খিলখিল করে হেসে বের হয়ে যায়।
আদিত্যের কল্পনাপ্রবণ মনে সে অনুরাগের অনুভব সৃষ্টি করেনি, যন্ত্রণার ঝঙ্কার তুলেছে শুধু। তবু অধরার সান্নিধ্য কেন যে এত কাঙ্খিতা তা বুঝতে পারছে না সে।
আচারের তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি নিয়ে আবারও আসে অধরা। বিছানায় বসে মাথা চুলকাতে থাকে। মুড়মুড়িয়ে মুড়ি খেতে খেতে আদিত্য অবলোকন করে, ষোলকলায় পূর্ণ অধরার যৌবন। তাকে একটু স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয় তার। সাহসে কুলায় না। বিবেকও সায় দেয় না।
তবু আদিত্য আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। চোখ বুজে নাম না জানা ফুলটা গুঁজে দেয় অধরার বেণি করা চুলে। কাঁটাবিদ্ধ আঙুলটা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। অধরা আহত আঙুলে ঠোঁট ছোঁয়ায়। কামোত্তেজনায় কেঁপে ওঠে আদিত্যের রক্তমাংসের শরীর।
ঠিক তখনি পাকঘর থেকে মা’র মুহুর্মুহু ডাক ভেসে আসে। আদিত্যের দিকে তরল চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় অধরা।


ফিনফিনে ঠা-ায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শোয় আদিত্য। ঘুম আসে দেরিতে। স্বপ্ন আসে ঘুমের সাথে সাথে।
বিশাল এক বিস্তৃতির স্রোতে আদিত্যের পালতোলা পানসি ভেসে চলছে। ছুটে চলছে অনিশ্চয়তার পথে। অনতিদূরে সহসা খুঁটির মতো কী একটা অচেনা জিনিস দেখতে পায় সে। পানসি ফেলে ধাবিত হতে থাকে সেদিকে। দৌড়তে দৌড়তে। উড়তে উড়তে। সাঁতরাতে সাঁতরাতে। খুঁটিমতো অবলম্বনটির নিকটবর্তী হতেই সেটি সরলরেখা হয়ে যায়। এরপর এঁকেবেঁকে নানান আকৃতি ধারণ করতে শুরু করে। হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেই তা দূরে সরে যেতে থাকে। কখনও বিন্দু হয়, কখনও বৃত্ত হয়। ঢেউ খেলে খেলে একসময় তা শূন্যতায় মিশে যায়। আদিত্যের ভিত্তি ধসে পড়ে। সে পতিত হয় এক অনন্তবিবরে।
স্বপ্ন টুটে যেতেই আলো জ্বালায় আদিত্য। দৃষ্টি চলে যায় অধরার ছবিতে। করুণ চোখগুলো ভালোবাসার মাদকতায় জড়ানো। আদিত্য অনুভব করে, অতিসাধারণ মেয়েটি ক্রমশ অনন্যসাধারণ হয়ে উঠছে। ছবিটায় হাত বুলাতেই কী একটা আতঙ্ক তার অন্তরাত্মায় কাঁপন ধরায়।
আলো নিভিয়ে অ্যাশট্রেটা বিছানায় নিয়ে সে বসে।
কাঠের দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে মিনমিনে কণ্ঠে জিগ্যেস করে, কে?
কোনো জবাব নেই। খিল খোলে আদিত্য আশপাশে তাকায়। কাউকে দেখা যায় না। ঘরে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে সে।
এবার দরজার কাছে রিনরিনে কণ্ঠস্বরে কে যেন বলে ওঠে, আদিত্য!
এই মেয়েলি ডাক আমার শ্রুতির বিভ্রম ছাড়া আর কিছইু নয়, ভাবে সে।
ভেজানো দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে ঢুকে এক ছায়ামূর্তি। ধাঁধা লাগে আদিত্যের চোখে।
এটা আমার দৃষ্টিবিভ্রম কিংবা বদখোয়াবও হতে পারে। চোখ কচলিয়ে সে চলিষ্ণু মূর্তিটার দিকে তাকায়। মূর্তিটা নারীতে রূপান্তরিত হয়ে সোজা বিছানায় উঠে যায়।
স্পর্শে স্পর্শে আদিত্য উপলব্ধি করে, এটা কোনো বিভ্রম কিংবা খোয়াব নয়। নিরেট বাস্তব। যে বাস্তবতার চাপে ও তাপে আদিত্যের আগ্নেয় লাভা উদ্গীরিত হয়ে ওঠে।
বমনক্লান্ত রোগীর মতো আদিত্য শয্যাশায়ী। পিপাসায় বুকের ছাতি ফাটে। জলপানের জন্য সে কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। ভয় পায় আলো জ্বালাতে। আঠালো আঁধার হাতড়ে জলের জগটা না পেয়ে আবার বিছানায় চলে আসে।
আদিত্য ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। এ ঘোর কীসের এবং কেন, জানে না সে। শুধু বুঝতে পারছে যে তার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে এক ইন্দ্রজাল। এ জাল ছিন্ন করতে চায় সে।
শেষরাতে হু হু বাতাস বইতে শুরু করে। চুপি চুপি পা ফেলে আদিত্য মিশে যায় ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশায়।


মেসে পৌঁছনোর পর অপরাধবোধ আদিত্যকে আহত করে। ছেলের রহস্যময় নিখোঁজ হওয়া নিয়ে মা নিশ্চয়ই দুঃশ্চিন্তায় আছেন। অবশ্য অধরাও তার হঠাৎ পাওয়া মানুষটার আকস্মিক প্রস্থান মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবেই।
মোবাইলটা পথে কোথাও ফেলে এসেছে আদিত্য। মা’র ফোন বন্ধ। চার্জ শেষ হয়তো। বাড়িতে যোগাযোগ করা যেতে পারে এমন কারও নাম্বার মুখস্থ নেই।
দ্রুত বাড়িমুখো জলযানে চড়ে বসে আদিত্য। পথের দূরত্বটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে যেন।
সন্ধ্যা সমাগত। স্তব্ধ জলে ছায়া ফেলে অস্তায়মান সূর্যের ম্রিয়মাণ আলো। আদিত্যের অস্থির মনে ভেসে চলছে সহজ কিছু ভাবনা।
বাড়িতে মাসতিনেক থাকলেই চলবে। নির্ভাবনায় ছবি আঁকা হয়ে যাবে বেশ কিছু। একক চিত্রপ্রদর্শনী করতে হবে ঢাকায় ফিরে গিয়ে। দুই রুমের একটা বাসা দরকার। আসবাব কিনতে হবে ছবি বিক্রির টাকায়।
সাইরেনের শব্দে খান খান হয়ে যাওয়া আদিত্যের ভাবনা দ্রুত জোড়া লাগে।
মাকে নিয়ে যেতে হবে। সঙ্গে অধরাকেও। …এভাবেই গড়ে উঠুক আমার শিল্পের সংসার।

ঢাকা জার্নাল, জুন ২৬, ২০১৩। 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.