আজ বিশ্বকবির জন্মদিন

মে ৮, ২০১৩

robi

ঢাকা জার্নালঃ আজ ২৫ শে বৈশাখ বুধবার। বাঙালীর আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের মূল নায়ক, কাব্যগীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা, দ্রষ্টা ও ঋষি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২তম জন্মদিন। নতুনের আহ্বানে সারা জীবন কবিগুরু গেয়েছেন জয়গান-

কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবো খেলা এই-আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।’

নিজের বাণীর মতোই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির জীবনে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। তার সৃষ্টিতে ঠাঁই পেয়েছে প্রেম-বিরহ-প্রকৃতি-সংগ্রাম-মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও। তাই বাঙালির মন-মনন, চিন্তা-অভিব্যক্তিজুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। হয়ে উঠেছেন বাঙালির প্রাণের মানুষ। ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে তার সৃষ্টি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব দরবারে। পেয়েছেন বিশ্বকবির মর্যাদা। রবীন্দ্রনাথ এমনই এক নাম যার তুলনা কেবলই তিনি। তাই গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজার মতো তার রচনাতেই বাঙালি শ্রদ্ধা জানান তাকে। তার বহুমাত্রিক প্রতিভার আলো বিচ্ছুরণ ঘটাবে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত।
মহাকালের বিস্তীর্ণ পটভূমিতে ব্যতিক্রমী এ রবির কিরণে উজ্জ্বল হওয়া দিনটি এবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে জাতীয়ভাবে উদযাপিত হবে। এ উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সকাল ১০টায় কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ি, নওগাঁর পতিসর এবং খুলনার দক্ষিণডিহিতে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত জেলাগুলো ছাড়াও সারাদেশেই কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন আলোচনা সভাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এসব অনুষ্ঠানে স্থানীয় রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, শিল্পী, সাহিত্যিক ও গুণীজন উপস্থিত থাকবেন। পক্ষান্তরে রাজধানী ঢাকায় বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, ছায়ানট, চ্যানেল আই জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
যার লেখা, দর্শন, চিন্তা, চেতনা তথা বহুমাত্রিক আলোকচ্ছটার ঔজ্জ্বল্যে ও মহিমায় বাঙালী জাতিসত্তা হয়েছে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত, সেই বিশ্বখ্যাত কবি ১৫২ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে জোড়াসাঁেকার ঠাকুর পরিবারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই শুধু দুই বাংলার বাঙালীই নয়, পুরো ভারতবাসী এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষী কবির এই জন্মবার্ষিকীর দিবসটি পালন করবে হৃদয় উৎসারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার তখন মান মর্যাদায় এবং বুদ্ধি ও কলাচর্চায় খ্যাতির মধ্যগগনে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সারদা দেবী দম্পতির চতুর্দশ সন্তান। আভিজাত্যের সঙ্গে উদারতা মিলেছিল তাদের পরিবারের ঐতিহ্যে। এ পরিবেশ শৈশবেই মুক্ত করে দিয়েছিল তার মন। পরে বিশেষত বাংলায় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ইছামতিতে নৌকা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলার নিসর্গ ও নদীবর্তী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তার ভেতরে জাগিয়ে তুলেছিল প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি অপার ভালোবাসা।
বিচিত্র দেশ ভ্রমণ, সমকালীন ঘটনাবলির পর্যবেক্ষণ এবং বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শ তার চিন্তা চেতনাকে জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে এক সর্বমানবিকতার পথে নিয়ে গিয়েছিল। রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাকে বিশ্বকবি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ১২৮১ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত অভিলাষ তার প্রথম মুদ্রিত কবিতা। এরপর থেকে কবিতা, গল্প, সাহিত্য, উপন্যাস, সমালোচনা, চিঠিপত্র, প্রবন্ধ, সংগীত, চিত্রকলা যেখানেই তিনি হাত দিয়েছেন পেয়েছেন সফলতার শীর্ষস্থান। প্রায় একক চেষ্টায় তিনি বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতায় উজ্জ্বল করে বিশ্বসাহিত্যের সারিতে জায়গা করে দিয়েছিলেন।
তার বিপুল সৃষ্টির মতোই তার চিন্তাধারার মধ্যেও ছিল বিশালতা। সাংগঠনিক কর্ম, সামাজিক উদ্যোগের দিকেও তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী। ভেবেছেন শিক্ষা নিয়ে। প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী। কৃষক ও পল্লী উন্নয়নের কথা ভেবে চালু করেছিলেন কৃষিঋণ ব্যবস্থা। জালিয়ানওয়ালাবাদে দেশবাসীর ওপর চালানো ব্রিটিশ সেনাদের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নাইটহুড উপাধী। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি। নোবেল ফাউন্ডেশন তার এ কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ রূপে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এডভোকেট এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা আলাদা বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথের বিশালতা এবং তার সৃষ্টির অপূর্ব মাধুর্ষকে অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে হলে রবীন্দ্র চর্চার বিকল্প নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন জগৎ সংসারকে জানতে নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্র সাহিত্যে অবগাহন করবে, রবীন্দ্র চর্চায় থাকবে ব্যাপৃত। তিনি বলেন, রবীন্দ্র চেতনার আলোকে ন্যায়ভিত্তিক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে এবং মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ ক্ষণজন্মা কবির স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিস্ময়কর প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ। তার ক্ষুরধার লেখনী থেকে বেরিয়ে এসেছে বৈচিত্র্যময় ও বহুত্ববাদী চিন্তা চেতনা। রবীন্দ্রনাথ একাধারে কবি, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। আসন পেয়েছে বিশ্ব দরবারে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, রবীন্দ্রনাথের অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ছিল সুতীক্ষ্ণ। সেই তীব্র বোধে ধরা পড়েছে সমাজ, সংসার, রাজনীতি, সমাজনীতির নানা চিত্র। প্রেম, বিরহ, আনন্দ, বেদনাসহ মানব মনের অবগুন্ঠিত অনুভূতির শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে তার লেখনীতে। তার সৃষ্টিশীল কর্ম সর্বকালের, সব মানুষের। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা এবং প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের জ্যোতি হিসেবে। জীবন, মৃত্যু ও জগৎ সংসার তার নিকট প্রতিভাত হয় এক ও অখন্ডরূপে। তাই তার গানে জীবন ও জগতের সুর বাজে এভাবে- ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ-দহন লাগে/ তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষায় বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখতে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও দর্শন উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা। তিনি বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন বিশ্ব কবির ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতি শোষণ, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধে বাঙালির অগ্রযাত্রাকে চিরকাল অব্যাহত রাখবে। বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেন, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তির কবি, মানবতার কবি ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বৈচিত্র্যের সাধক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কালজয়ী এ কবি জীবন ও জগৎকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন। সাহিত্যের সকল শাখায় তার অনন্য সাধারণ প্রতিভার স্বক্ষর রেখেছেন। জীবন সম্পর্কে তার দুরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তার সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ২৪ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের লেখনী আমাদেরকে উজ্জীবিত করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তার (রবীন্দ্র নাথ) জাতীয়তাবোধ বাঙালির অন্তরে প্রেরণার উৎস। জীবনের প্রতিটি সমস্যা, সংকট, আনন্দ, বেদনা এবং আশা নিরাশার সন্ধিক্ষণে তার সৃষ্টি আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কালোত্তীর্ণ এ কবির সৃষ্টিকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই তিনি কবিগুরুর অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা কবিগুরুর ১৫২তম জন্মবার্ষিকীর সূচনালগ্নে শান্তিময় পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.