প্রমীলারা এভাবেই মরে

মে ৩, ২০১৩

savar-dead-body-bg20130501233042ঢাকা জার্নাল: সকাল সোয়া ছয়টা। তখনও মৃত্যুপুরীর জন্য দোয়া চলছিল মাইকে। নাম জানা গেল এবার, প্রমিলা। ঠিকানাও পাওয়া যাবে। এরপর জাহাঙ্গীর এবং সুমন। বাকিদের কোন নাম-ধাম জানা গেলো না।

শুক্রবার খুব সকালের আগেও অনেককেই উদ্ধার করা হয়েছে এভাবে। কারো নাম-ধাম জানা যায় নি। তবে এদের কেউই জীবিত নন। মৃত্যুপুরী থেকে এক এক করে বের করা হচ্ছে লাশ। আর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানেও যেন শ্মশ্মানের মতই অবস্থা।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে পরিতোষকে উদ্ধার করা হয়েছে। এক উদ্ধার কর্মী বললেন, খুব সহজে মরেনি পরিতোষ। দেহটাও সতেজ আর অক্ষত ছিল। আঘাতে না মরলেও বদ্ধ জায়গায় কাতরে মরেছে রংপুর থেকে আসা পরিতোষ। উদ্ধারের পর তাকে আর অধর চন্দ্রের ‘শ্মশ্মানে’ যেতে হয়নি। বাবা-মা তার লাশটি নিয়ে গেছে রংপুরে।

এর পর থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত লাশের অপেক্ষা। ভারী দানবগুলো দেওয়াল ভেঙ্গে কংক্রিট সরিয়ে ফেলছে যেন চেখের ইশারায়। মধ্য রাতে দানবের মত যন্ত্রটিও হঠাৎ থেমে যায়। সবার চোখ মুত্যুপুরীর দিকে। এরপর থেকে কাক ডাকা ভোর পর্যন্ত বড় হতে থাকে লাশের মিছিল।

লাশ আর লাশ। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সঙ্গে ঝুলে থাকা লাশ দেখে এই ট্রাজেডির জন্য দায়ীদের ভদ্রভাষায় গালি দিয়ে উঠলেন এক সেনা সদস্য। বলতে থাকেন ‘কলাসসিপল গেটটিও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যেন কেউ বেরুতে না পারে। পেছন গেট দিয়ে বেরুতে গিয়েই বেশিরভাগ এদিকে ছুটে এসেই মরেছে। মরার ফাঁদ তৈরি করতেই গেটটি যেন বন্ধ করে রাখা।

রাত একটার পর থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ২৯টি লাশ বের করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে ক্লান্ত তারা। ওই সেনা সদস্য বলতে থাকেন রাতভর এমন দৃশ্য দেখার মত দুর্ভাগ্য যেন কারো না হয়।

গভীর রাতে সাভারের রানা প্লাজায় ভারী যন্ত্রপাতি আর ক্রেন দিয়ে চলতে থাকে উদ্ধার অভিযান। রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত শরীরে গড়িয়ে পড়ছেন বার বার। আবার হঠাৎ হাক-ডাক। ছয়টি লাশ উদ্ধার হয়েছে একসঙ্গে। কে জানে কোন হতভাগ্য পিতার সন্তানকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে অধর চন্দ্র স্কুলের মাঠে পাঠাতে হবে। আর পরিচয় না জুটলে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে নিয়ে যাওয়া হবে তাদের। এভাবেই চলতে থাকে সারা রাত।

রাতভর মৃত্যুপুরীর জন্য দোয়া মাহফিলের সুর ভেসে এলেও ভারি যন্ত্রের শব্দে তা কখনও কখনও মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েকজন কর্মী সারা রাত গোলাপ জল আর সুগন্ধি ছিটিয়ে চলেছেন। সুগন্ধি ছিটিয়ে যাচ্ছেন আরো অনেকেই।

পচা লাশের গন্ধ আর সুগন্ধি মিলিয়ে আরও একটি প্রকট দুর্গন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকেই ইট মাথায় দিয়ে কিংবা কোন দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন বিচ্ছিন্ন ভাবে।

সকাল সাতটার দিকে সেনা বাহিনীর অপর একটি দল এসে গেল। চলে যাবে আগের দলটি। এমন সময় পাওয়া গেল প্রমিলাকে। পরপর আরো দু’জনসহ মোট ৮ জনের লাশ সকাল সাড়ে সাতটার আগেই উদ্ধার হলো।

প্রমিলাকে আইডি কার্ডসহ উদ্ধার করা হয়েছে। সুইং শেকশনে কাজ করতেন। জাহাঙ্গীরের পকেটে একটি মোবাইল পাওয়া গেছে। এক সেনা কর্মকর্তা মোবাইলটা থেকে সীম কার্ড বের করে নিয়ে নিজের মোবাইলে পুরে সেইভ করা নম্বরে ফোন দিতে থাকেন।

রাতেও একই ভাবে এক সেনা সদস্য রংপুরের পরিতোষের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলেন। তার লাশটি পরিবারের সদস্যদের কাছে দেওয়াও হয়েছে। এভাবে চলছে দিন রাত লাশ উদ্ধার আর পরিচয় খুঁজে বের করার প্রাণপণ চেষ্টা।

এদিকে শেষ রাতেও বাইরে অপেক্ষারত স্বজন হারানো লোকজন। অধর চন্দ্র বিদ্যালয় মাঠে শুয়ে বসে আছেন প্রিয় মানুষটির লাশের জন্য। রানা প্লাজা এলাকার আশপাশে অপেক্ষারত লোকজন আর অধর চন্দ্র বিদ্যালয় মাঠে যারা রয়েছেন স্বজনের লাশের অপেক্ষায়। তাদের চোখে কান্নার দাগ। নতুন করে আর চোখে যেন জল নেই বের হওয়ার মতো। সবারই চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।

সকাল পর্যন্ত উদ্ধার কর্মীদের কষ্ট আর ক্ষোভের কথা শোনা যাচ্ছিল। প্রমীলার লাশ উদ্ধারের পর আরো দুই নারীর লাশ ভবনের নিচে আছড়ে পড়লে উদ্ধার কর্মীরা কষ্টে ক্ষোভে বলতে থাকেন- প্রমীলারা এভাবেই মরে, দেখার কেউ থাকে না। বিচারও হয় না দোষীদের।

এস এম আববাস, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট,

বাংলানিউজটোয়েন্মেটিফোর.কম

সৌজনে বাংলা নিউজ। মে ০৩, ২০১২

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.