‘উই মিসড মুজিব এক্সপ্রেস’

আগস্ট ১৬, ২০২৩

মাসকাওয়াথ আহসান: ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাস যেভাবে প্রতীক ও সংকেত অনুসরণ করে ইতিহাসের সত্যের কাছে পৌঁছে যায়; ঠিক তেমনি একটি ভ্রমণ ছিল যেন পাকিস্তানে ‘দ্য মুজিব কোডে’র প্রতীক ও সংকেত মিলিয়ে মিলিয়ে সত্যান্বেষণের এক ভ্রমণ। যে পাকিস্তানের সরকারি মিডিয়ার মুজিববিরোধী প্রচারণা চালিয়ে সত্যকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তিটি মুজিব, যিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জিতেছিলেন; অথচ তাকে দেশটির শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্ব না দিয়ে গ্রেপ্তার করেছিল ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়ার সেনাদল। ইয়াহিয়াকে প্ররোচিত করেছিল, মুজিবের কাছে ভোটে যাওয়া রাজনীতিক ভুট্টো।

আমি ইচ্ছে করেই জুলফিকার আলী ভুট্টো ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে মিডিয়া স্টাডিজ পড়ানোর কাজটা শুরু করি পাকিস্তান ভ্রমণের শুরুতেই। ছাত্রদের কাছ থেকেই বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, ১৯৭১ সাল আর মুজিব সম্পর্কে কতটুকু জানে ওরা! উমর চান্না নামে এক ছেলে ক্লাসরুমে কনভারসেশন শুরু করল, ডন পত্রিকায় আমরা হামদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট পড়েছি। দ্য ক্যাট ইজ আউট অব দ্য ব্যাগ স্যার!

আলী গুল পীর বলল, পাকিস্তানের রাজনীতি তো ভাডেরো (জমিদার) কা বেটার তালুক। আপনারা বেঁচে গেছেন স্যার। আমরা সেখানেই রয়ে গেছি। ভুট্টোর নামে গড়া ইউনিভার্সিটিতে বসে ছাত্রছাত্রীরা ভুট্টোকে ভাডেরার ছেলে বলে উপহাস করে মুজিবকে ‘যো জিতা ওহি সিকান্দার’ অভিধায় ভূষিত করলে বুঝলাম; ইন্টারনেট যুগের আলো যুগ যুগ ধরে পাঠ্যপুস্তকে ১৯৭১-এর বিকৃত ইতিহাস লেখার অন্ধকার সরাতে শুরু করেছে।

পাকিস্তানের মানুষ ১৯৭১ সালের পর থেকে রয়ে গেছে ঘাতক সেনাবাহিনীর ভূতের নাচনের মাঝে। মিলিটারি ও মস্কের ভীতিতে সমাজ বিকাশকে স্তব্ধ করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ছদ্ম ইসলামাইজেশনের নামে সন্ত্রাসবাদের মার্সিনারি ঘাতক তৈরির অভয়ারণ্য করে তোলা হয়েছে। মিলিটারির সঙ্গে জামায়াতের যোগসাজশে চলা এই হননযজ্ঞে শহীদ হয়েছে পাকিস্তানের অসংখ্য মানুষ। এমনকি শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে শিশু হত্যা করেছে এই ঘাতকেরা। চলচ্চিত্রকার শোয়েব মনসুর ‘খুদা কে লিয়ে’ চলচ্চিত্রে ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ধর্মের শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই এ কথাটি বলতে চেষ্টা করেছেন।

ফলে বাংলাদেশে যখন একাত্তরের মানবাধিকারবিষয়ক অপরাধীদের বিচার চলছিল; তখন পাকিস্তানের জনমানুষকে উচ্ছ্বসিত দেখা গেছে। এখানে জনপ্রিয়তম চ্যানেল মাস্ত এফ এম ওয়ান ও থ্রিতে সে সময় আমি ‘বাংলা বৈঠক’ নামে একটি ফোন ইন শো করতাম। সেখানে ফোনে প্রতিটি শোতে পাওয়া বিশটি টেলিফোন কলের মধ্যে আঠারোটিতেই থাকত বাংলাদেশ সরকারের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা। কাকতালীয়ভাবে মুজিব নামে একজন শ্রোতা ফোন করে বলেন, মুজিবের বেটি মুজিবের মতোই সাহসী; জামায়াতের অপরাধীগুলোকে ঝুলিয়ে দিলেন তিনি। আহা! পাকিস্তানে যদি কেউ এদের এভাবে শাস্তি দিত; আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারতাম।

প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট কবি ফাজিল জামিলি একদিন বললেন, আফঘান কার্পেটের মালিক ইফতেখার সাব আপনাকে দাওয়াত দিয়েছেন। উনি কী যেন জানাতে চান আপনাকে। করাচির গিজরি এলাকায় ইফতেখার সাবের বাগানওয়ালা বাড়ি। তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা। ইফতেখার সাহেব মুজিব-ভক্ত একজন মানুষ। মুজিব যখন করাচিতে আসতেন, তখন উনি ক্লাস এইট-নাইনের ছাত্র। আফঘান কার্পেটের ওপরতলায় প্রাচীন এক দালানে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অফিস ছিল। ইফতেখার সাব বললেন, আমি এয়ারপোর্টে যেতাম মুজিব আসার আনন্দে। কমপক্ষে এক লাখ লোক মুজিবকে স্বাগত জানাতে যেত। তারপর তারা মিছিল করে নেতাকে পার্টি অফিসে নিয়ে আসতেন। অফিসের উল্টো দিকে করাচির প্রাচীনতম হোটেল মেট্রোপলে মুজিবের কক্ষে দর্শনার্থী উপচে পড়ত। বয়স কম বলে ইফতেখার একটু প্রশ্রয় পেতেন সেখানে।

তিনি কেবল নিবিষ্টমনে মুজিবের কথা শুনতেন। এই যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আর সিন্ধু-পাঞ্জাবের জমিদারদের কতিপয়তন্ত্রে ধূসর যে অবরুদ্ধ পাকিস্তান; সেখানে মুজিব যেন ছিলেন তাদের মুক্তির প্রমিথিউস। ইফতেখার সাহেবের চোখে জল আসে। উনি অশ্রু সংবরণ করে বলেন, ১৯৭১ সালে সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে আমার।

এরপরও তিনি তার দায়িত্ব থেকে সরেননি। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের জাতীয় সনদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি সার্বক্ষণিক চেষ্টা তদবির করেছেন। এই দায়িত্ব কেউ দেয়নি তাকে। মুজিব-ভক্ত হিসেবে; এটাকে তিনি তার কর্তব্য বলে মনে করেছেন। আমি সেখানে থাকতে থাকতেই কজন বাঙালি এলেন তার সঙ্গে দেখা করতে।

এ রকম আরেকজন মানুষের দেখা পেয়েছি যিনি করাচির বাঙালিদের কল্যাণে জীবনের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের আগে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল এলাকার জেলেরা পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছিলেন। কারণ সমুদ্রে মাছ ধরার যে দুঃসাহসী শিল্প সেখানে বাঙালি যেন শিল্পী এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের পেশিবহুল মানুষ। ফিশারিজ ইন্ডাস্ট্রির চিফ প্যাট্রন সারোয়ার সিদ্দিকী এই বাঙালিদের নিয়ে কাজ করেন। তাদের ভোটার আইডি বানানো, তাদের নিরাপত্তা, তাদের সন্তানদের পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টি; এসব কাজে নিবেদিত তিনি। এর কারণ হচ্ছে তার দাদা সেই এলাহাবাদ হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করার সময় থেকে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে আমৃত্যু সেই বন্ধুত্বে থেকেছেন অবিভক্ত ভারত ও পাকিস্তান পর্বে। সারোয়ারের বাবা ইজাজউল্লাহ সিদ্দিকী সোহরাওয়ার্দীর কাছে আইন পেশার তালিম নিতেন করাচিতে। সেখানে শেখ মুজিব আসতেন রাজনীতির তালিম নিতে। একই গুরুর শিষ্য হিসেবে তাদের স্বাভাবিক সখ্য ছিল। পরে ইজাজ কাজ শুরু করেন ইনস্যুরেন্স কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান দুই জায়গাতেই কাজ ছিল তার। শেখ মুজিবও রাজনীতির পাশাপাশি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির একটি কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। সারোয়ার সিদ্দিকী তার গম্ভীর ও আবেগ প্রকাশে পরিমিত বাবাকে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ আর ‘মুজিবের’ গ্রেপ্তারের খবরে কাঁদতে দেখেছেন; ঘরের দরজা বন্ধ করে। জীবনে ওই একবারই। এরপর পাকিস্তানে জেলে মুজিবকে আটকে রাখার অন্ধকার সময়ে মুজিবের যে বন্ধুরা তাকে বাঁচাতে সার্বক্ষণিক সক্রিয় থেকেছেন, ইজাজ তাদের একজন। ফলে পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিদের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করার ক্ষেত্রে সারোয়ার সিদ্দিকীর মাঝে তার দাদার সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীর বন্ধুত্ব আর তার বাবার সঙ্গে মুজিবের বন্ধুত্ব এক অমোঘ বন্ধন হয়ে রয়ে গেছে।

অনেকে ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে শত্রু ভুট্টোর সঙ্গে মুজিবের গলাগলির ছবি দেখে সমালোচনা করেন। সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই পাকিস্তান পিপলস পার্টির সাবেক আইনমন্ত্রী ইকবাল হায়দারের সঙ্গে দেখা হওয়ায়। ডন পত্রিকার দালানেই তার অফিস কক্ষে শেখ হাসিনার করাচি সফরের ছবি দেখে আমি বেশ অবাক হই। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের আগে লাখ লাখ আওয়ামী লীগ কর্মী ছিল পাকিস্তানে। মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ‘গাদ্দার’ বলে তকমা দেয় জামায়াতের লোকেরা। সেই আওয়ামী লীগ কর্মীদের ভুট্টোর পিপলস পার্টিতে আত্তীকৃত করে তাদের প্রাণ বাঁচান ভুট্টো। মুজিবের এই অনুরোধ রক্ষা করায় ভুট্টোর সঙ্গে মুজিবের ওই গলাগলির ছবি দেখা যায়। মুজিব তো ছিলেন মানুষের নেতা। এই মানুষ নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়। সংকীর্ণ কোনো জাতীয়তাবাদের মানুষ মুজিব ছিলেন না। তিনি জীবনে কোনো মুহূর্তেই নিজের দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে সরেননি।

পাকিস্তানের সাবেক ওই আইনমন্ত্রী ছিলেন মুজিব-ভক্ত। তাই তো বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচারের সময় এর সপক্ষে পাকিস্তানে প্রচারণা চালাতে ঋজু ভূমিকা রাখেন তিনি। পাকিস্তানের সংসদে জামায়াতের চাপাচাপিতে বাংলাদেশে তাদের সহকর্মীর মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে শোক প্রস্তাব আনলে, পিপলস পার্টির সাংসদরা সংসদ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পিপলস পার্টি সেক্যুলারিজম চর্চায় কোনো ফাঁকফোকর নেই। ভোট ব্যাংক বাড়াতে কখনোই তারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেনি।

করাচির ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্টে মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট পড়াতে গেলে এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সাবিনা মোহসীন আমাকে চায়ের আমন্ত্রণ জানান। সেই সময় উনি মুজিবের সেক্যুলার আদর্শের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। আমাকে বলেন, আমি আশা করছি আমাদের ছেলেমেয়েরা আপনার কাছ থেকে সেক্যুলারিজম সম্পর্কে নিয়মিত জানতে পারবে।

আমি অবাক হই দ্বিতীয়বার যখন এসএমআই ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া স্টাডিজ ও ফিল্ম পড়ানোর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের বৈঠকে বসলে, ভিসি প্রফেসর শেখ স্মিত হেসে বলেন, বাংলাদেশে মুজিব যে সেক্যুলারিজমের চর্চা করেছেন; তা উদাহরণীয়। আমি খুবই খুশি যে আমাদের ক্যাম্পাসে আপনি সেক্যুলার ডিসকোর্সটাকে জোরেশোরে নিয়ে আসবেন। মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ড. আজফার শুধু হাসলেন। এই আজফারের বাবা ঢাকা নটর ডেম কলেজের ফিজিকসের শিক্ষক ছিলেন। মুজিব সম্পর্কে বাবার কাছ থেকে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন তিনি।

আসলে ষাটের দশকের পশ্চিম পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিকরা মুজিবের সমর্থক ছিলেন। এর কারণ হচ্ছে মুজিব ছিলেন অকুতোভয় এক গণতন্ত্রপ্রেমী। তিনি ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড় করিয়ে গোটা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচারণা চালিয়েছেন। সেই সময় প্রয়াত বুদ্ধিজীবী আসমা জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক হামিদ মীরের বাবা কিংবা ডন পত্রিকা পরিবার মুজিবের মধ্যে গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখে। ডন পরিবারে মুজিব ছিলেন সন্তানের মতো। তাই তো হোটেল মেট্রোপলে মুজিবের জন্য কক্ষ নির্ধারিত থাকলেও; ডনের হারুন পরিবারের মা মুজিবকে নিজের সন্তান স্নেহে বরণ করেছিলেন। বিদ্যানুরাগ, শিল্প-সাহিত্যে ঝোঁক, উর্দু ও ইংরেজিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়ার ক্ষমতায় মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন। বিলেতে পড়ালেখা করে এসেও ভুট্টো নিজ সমাজে মুজিবের মতো গ্রহণযোগ্যতা পাননি। ভুট্টো একবার বলেছিলেন, খ্যাতি সব সময় আমার খুব পাশ দিয়ে এসে মিছিল করে মুজিবের দিকে চলে যায়।

ঢাকায় ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিব-ভুট্টো বৈঠকের অফিসার অন ওয়েটিং ছিলেন ক্যাপ্টেন কায়সার। করাচিতে এসে তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি নিজেই বলতে থাকেন ওই বৈঠকের রসায়ন। ওই বৈঠকে মুজিব ছিলেন ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের মতো যৌক্তিক স্থিতধী সৌম্য; আর ভুট্টো ছিলেন অনেক ডিফারেন্সে সেকেন্ড হয়ে হতাশায় উত্তেজিত একজন। থ্রি ইডিয়টস মুভির চতুর চরিত্রটির মতো যেন। আর মুজিব সেই আমির খানের মতো প্লেস্যান্ট প্রাণবন্ত মানুষ। চেয়ার ঘুরিয়ে ইয়াহিয়া ও মুজিবের দিকে পেছন করে বসে থাকত; বিচার মানি না, তালগাছ আমার। ভুট্টো হয়তো জানালা দিয়ে তালগাছ খুঁজতেন। ক্যাপ্টেন কায়সার মুজিবের গ্রেপ্তারের পর তার বাসার জিনিসপত্রের তালিকা করতে গিয়ে মুগ্ধ হন বইয়ের কালেকশন দেখে। আর মুজিবের যে ‘পাইপের কালেকশন’, কায়সার বলেন, ওই একটাই তো শখ ছিল তার; এত সুন্দর একটা সংগ্রহ।

এই ক্যাপ্টেন কায়সার মুজিবের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির এতই ভক্ত হয়ে যান যে নিজের ছেলের বিয়ে দিয়েছেন এক বাঙালি পরিবারে। যে পরিবারে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের সুর রাজত্ব করে দূরদেশে; ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ আর হাবিব জালিবের কবিতার পাশাপাশি।

সেই সময়ের পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ফয়েজ কাজির ছেলে জাফর কাজি কিংবা কবি নওয়াব যার চাচা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কিংবা ইউনিভার্সিটিতে প্রশাসনে কাজ করা তরুণ যার বাবা আওয়ামী লীগ করতেন; যার বাড়িতে এখনো মুজিবের ছবি ঝোলে; এভাবে তাদের স্মরণে আজকের এই মানবাধিকার ও গণতন্ত্রহীন পাকিস্তানে মুজিব আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন; জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানকে জেলে পাঠিয়ে গণতন্ত্র হত্যার ধূসর পা-ুলিপিতে ফেসবুকে যখন ট্রেন্ড করে; ‘ডোন্ট রিপিট সেভেনটি ওয়ান’। মুজিবের আওয়ামী লীগের সঙ্গে অতীতে সম্পর্কিত খায়বার পাখতুন খাওয়ার আওয়ামী ন্যাশনালিস্ট পার্টির বর্ষীয়ান নেতারা আলোচনা করেন টিভি টক শোতে, ইমরান তার অসহযোগ আন্দোলনে, রাজনীতির পথ হাঁটায় মুজিবকে অনুসরণ করেন বলেই সাফল্য পেয়েছেন।

মুজিব কত বড় যুদ্ধ জিতলেন, রাষ্ট্রপতি কি প্রধানমন্ত্রী হলেন; তার চেয়ে বড় হচ্ছে তার জনমানুষের হৃদয় জয় করার ক্ষমতা। সেই আমলে করাচি গ্রামারে পড়া ইংলিশ মিডিয়ামের মেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের দশ বছর বয়স ছিল তারা যখন আড্ডায় বলে, ভারতের মানুষ যেমন নেহরু এক্সপ্রেসে চড়েছিল; আমাদেরও তেমনি মুজিব এক্সপ্রেস ছিল; বাট উই মিসড দ্য ট্রেন! তাদেরই একজন আমেনা বলেন, একজন প্যাট্রিয়টকে ওই ফ্যাসিস্টরা গাদ্দারের তকমা দিয়েছিল; কিন্তু তাতে কী লাভ হয়েছে? আমি তো সুযোগ পেলে বাংলাদেশে গেলে ওনার সমাধিতে ফুল দেব। আমরা সবাই একসঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় যাব; যেখানে প্যাট্রিয়ট মুজিব ঘুমিয়ে আছেন।

মাসকাওয়াথ আহসান


লেখক: সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া