শতাব্দীর সেরা জয় বাংলাদেশের

জুন ১৭, ২০২৩

টেস্ট ক্রিকেটে বলার মতো কিংবা স্মরণে রাখার মতো একটা নজির স্থাপন করলো বাংলাদেশ। যা হয়তো টিকে থাকবো অনেক বছর। একমাত্র টেস্টে আফগানিস্তানকে ৫৪৬ রানে হারিয়ে জিতে নিয়েছে শতাব্দীর সেরা ম্যাচ। যে জয় ১৪৬ বছরের টেস্ট ইতিহাসে রানের দিক থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চও। তাছাড়া ১৯৩৪ সালের পর রানের ব্যবধানে এখন পর্যন্ত এটিই টেস্টের সবচেয়ে বড় জয়।

২০০০ সালে টেস্ট খেলার যোগ্যতা অর্জন করা বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ১৩৮ টি ম্যাচ খেলেছে। তার মধ্যে কেবল ১৮টি ম্যাচ জিততে পেরেছে লাল-সবুজরা। হেরে যাওয়া ম্যাচগুলোর অধিকাংশই ছিল ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়। সেই বাংলাদেশ ৪ দিনে পাক্কা ১০টি সেশন আধিপত্য দেখিয়ে ক্রিকেট খেলেছে। তাতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫৪৬ রানের বিশাল জয়কে কেবলমাত্র ‘জয়’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটাকে টেস্ট ক্রিকেটের নতুন সূর্যোদয়ও বলা যেতে পারে।

মাত্র একটি টেস্ট প্রভাব বিস্তার করে জেতার পর এমন বিশ্লেষণ কতটা যৌক্তিক সেটি নিয়েও উঠতে পারে প্রশ্ন। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক টেস্টগুলো দেখলে দিন বদলের শুরু ধরতে হবে এখান থেকেই। মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে ওয়ানডে দলটি হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। মাশরাফির সেই দলটিই এখন স্বপ্ন দেখছে বিশ্বকাপ জয়ের। সাকিবের নেতৃত্বে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দল এগিয়ে যাওয়ার রসদ পেয়েছে। বাকি থাকা ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাট টেস্টেও সাফল্য পেতে অনেকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিল বিসিবি তথা টিম ম্যানেজমেন্ট। সেই ফল পেতে শুরু করেছে অবশেষে। যার একচেটিয়া আধিপত্যের উদাহরণ এই টেস্ট।

টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্য পেতে বোলারদের ২০ উইকেট নেওয়ার বিকল্প নেই। মুশফিকুর রহিম অধিনায়ক থাকা অবস্থায় বহুবার এই কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দল হিসেব বেশিরভাগ সময় ২০ উইকেট নিতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন বোলাররা। তুলনা করলে ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ প্রভাব বিস্তারী। যারা সাকিব-তামিমকে ছাড়া লিটনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের ব্যাটারদের নিয়ে ছেলেখেলা করেছে। প্রথম ইনিংসে তাদের ১৪৬ রানে রুখে দেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসেও ১১৫ রানের বেশি যেতে দেননি। যার মূল কৃতিত্ব তাসকিন, এবাদত, শরিফুলদের। আক্রমণের এই ত্রয়ী আফগানিস্তানের কঠিন পরীক্ষা নিয়েছেন। বোলারদের পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাটাররাও ত্রাস ছড়িয়েছেন রীতিমত। আফগান বোলারদের পাড়ার বোলার বানিয়ে ছেড়েছেন শান্ত-মুমিনুলরা। এভাবে ডমিনেট করা জয়ের পর টেস্ট ক্রিকেট এটাকে বাংলাদেশের নতুন শুরু বলা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি নয়!

অবশ্য এই নতুন শুরুর আগে ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ২২৪ রানে হারের পর কঠোর সমালোচনার মুখেও বাংলাদেশকে পড়তে হয়েছে। স্পিন বান্ধব উইকেট বানিয়ে ফাঁদ পাতা হলেও সেই ফাঁদে পা দিয়েছিল নিজেরাই। পরে রশিদ খানের ঘূর্ণিজাদুতে অসহায় আত্মসর্মপণ করে সাকিব আল হাসানের দল। এবার ঢাকা টেস্টে সবুজ ঘাসে পেস বান্ধব উইকেট বানানোর পরও সংশয় ছিল। নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাই আবার পা দেয় কিনা। পরে দেখা গেলো প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু।

তবে টস হারটাই বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। উইকেটে সবুজ ভাব থাকলেও ব্যাটিং করার জন্য অতটা কঠিন ছিল না কন্ডিশন। প্রথম দিনে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশ দল সেই সুযোগটাই নিয়েছে। আফগান বোলারদের নিয়ন্ত্রণহীন বোলিংয়ের সুযোগ নিয়ে ৩৮২ রান করেছে। প্রথম ইনিংসের তুলনায় দ্বিতীয় ইনিংসে আফগানরা ভালো বোলিং করলেও বাংলাদেশের ব্যাটারদের রুখতে পারেননি। বরং আফগানদের ফলোঅন না কারিয়ে ৪ উইকেটে ৪২৫ রানের পাহাড় গড়ে ঘোষণা করে দ্বিতীয় ইনিংস। তাতে ৬৬২ রানের পুঁজি পেয়ে যায় লিটন দাসের দল।

ব্যাটিং বিভাগে সবচেয়ে স্বস্তির বিষয়টি ছিল মুমিনুলের রানে ফেরা। গত ২৬ ইনিংসের মধ্যে এবারই তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পেরেছেন তিনি। মুমিনুলকে পাশে রেখে নাজমুল হোসেন শান্তও টানা দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করে মুমিনুলের কীর্তিতে ভাগ বসিয়েছেন। এক সময় যে শান্তকে নিয়ে সমালোচনা হতো, সেই শান্তই এখন রানের বন্যা বইয়ে নিয়মিত পারফর্মার।

তবে ব্যাটারদের ছাপিয়ে এই টেস্টে সবার নজর ছিল বোলারদের দিকে। বিশেষ করে সবুজ উইকেটে বাংলাদেশের পেসাররা কেমন করেন সেটাই ছিল দেখার। সেখানে একশতে একশ পেয়েছেন তিন পেসার। আফগানিস্তানের ১৯ উইকেটের মধ্যে ১৪টি শিকার করেছেন তাসকিন, শরিফুল, এবাদতরা। যা এক ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চও!

তাসকিন প্রথম ইনিংসে ভালো বোলিং করতে না পারলেও দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণ করেছেন। চতুর্থ দিন তাসকিনের গতিময় বোলিংয়েই অসহায় অবস্থায় পড়ে সফরকারী ব্যাটাররা। তৃতীয় দিনে তাসকিনের বাউন্সারে আফগানিস্তানের অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহীদীকে তো হাসপাতালেই যেতে হয়েছে। পরবর্তীতে তার কনকাশন বদলি হিসেবে ব্যাটিং করেছেন বাহির শাহ। শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার সেরা ৪ উইকেট নিয়েছেন। পেতে পারতেন ৫টিও!

অথচ ঘরের মাঠে লম্বা সময় ধরে বাংলাদেশের পেসাররা পাঁচ উইকেট নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেননি। ২০১০ সালে চট্টগ্রামে সর্বশেষ ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন শাহাদাত হোসেন রাজীব। ২০১৫ সালে মোস্তাফিজের সামনেও সুযোগ এসেছিল এই কীর্তি গড়ার। এই টেস্টে আবারও একই কীর্তির সামনে ছিলেন এবাদত-তাসকিন।

শুরুতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সুযোগ এসেছিল এবাদতের। কিন্তু শুক্রবার এবাদতকে চার উইকেট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। শনিবার তাসকিনের সামনেও সুযোগ ছিল ১৩ বছরের খরা কাটানোর। পরে হতে হতেও হয়নি। তাদের পাশাপাশি নিজের প্রতিভা দেখিয়েছেন শরিফুল ইসলামও।

এখন দেশে ও দেশের বাইরে পেসারদের এমন পারফরম্যান্স অব্যাহত রাখার পালা।