পাঠ্যবইয়ে না থাক, আলোচনায় থাক

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩
এস এম আববাস: 

ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে বাংলাদেশে নতুন করে বিতর্ক জায়গা করে নিয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ে বিবর্তন তথ্যের কিছু অংশ যুক্ত করায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে দিয়েছেন কিছু মানুষ। প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি থেকে দায়িত্বশীল মানুষ এবং গণমাধ্যমও বাদ যায়নি। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড দুটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

এবার তাহলে বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক কি বাদ যাবে? আমার মনে হয় বিবর্তন নিয়ে আলোচনা আরও বাড়বে। তার কারণ কী? কারণ খুব সহজ। পাঠ্যবই থেকে বিবর্তনের অংশ বাদ দিলে যারা বিবর্তন সম্পর্কে জানেন না কিংবা ভুল ধারণায় রয়েছেন, তারা মনে করতে বাধ্য যে বিবর্তন নিশ্চয় নিষিদ্ধ কোনও জিনিস। আর সে কারণেই পাঠ্যবই থেকে বাদ যাচ্ছে। নিষিদ্ধ বস্তুকে মানুষের যেহেতু আসক্তি বেশি তাই, পাঠ্যবইয়ে বিবর্তন অংশ বাদ দিলেও বিবর্তন সম্পর্কে আরও বেশি করে মানুষ পড়বে।

প্রাণীর বিবর্তন সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা দীর্ঘদিনের। ভুল ধারণাটি হচ্ছে— ‘মানুষ বানর থেকে হয়েছে’। বস্তুত বানর থেকে মানুষের উদ্ভব বিবর্তন তত্ত্বে নেই। আর সে কারণে পাঠ্যবইয়ে বিষয়টি নিয়ে এসে ভুল ধারণাকে দূর করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছালো, তাতে সরকার বাধ্য হচ্ছে পাঠ্যবই থেকে বিবর্তন অংশ তুলে দিতে। এতে কার কতটা লাভ আর কার ক্ষতি সে বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে বিবর্তন নিয়ে পাঠ্যবইয়ে কী ছিল তা জানা জরুরি।

২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া নতুন পাঠ্যক্রমের ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের ২১ ও ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বিবর্তন নিয়ে একটি অংশ রয়েছে। বইটির ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?’ অধ্যায়ের ৮ নম্বর লাইনে বলা হয়েছে, ‘অনেকে বলেন, মানুষের উদ্ভব নাকি বানর থেকে। এ কথা ভুল।’ বইটির ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘প্রাইমেট জাতীয় প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে একদিকে শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাংওটাং, গিবনের মতো এপ-জাতীয় প্রাণীরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। অন্যদিকে বানর তৈরি হয়েছে। আর একটি ধারায় মানুষ ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে নানান পর্যায়ে। তোমাদের মনে রাখতে হবে, বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি।’

অর্থাৎ পাঠ্যবইয়ে বলা হয়নি, ‘বানর থেকে মানুষ হয়েছে’। আর সে কারণে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বারবার বলেছেন, ‘পাঠ্যবইয়ের কোথাও বলা হয়নি মানুষের উদ্ভব বানর থেকে। বরং বলা হয়েছে মানুষ বানর থেকে হয়নি।’ তাহলে কেন এত আলোচনা, সমালোচনা, অপপ্রচার? কারা সময় ব্যয় করে এই অপ্রচারে নামলেন? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বরাত দিয়ে কী কারণে একশ্রেণির গণমাধ্যম অপপ্রচারে নামলো? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একশ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিষোদগারকে গুরুত্ব দিয়ে যাচাই-বাছাই না করেই কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি অপপ্রচারে নামলেন। নাকি এটি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ অধিবেশনে সম্প্রতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন ময়মনসিংহ-৮ আসনের সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন সংসদ সদস্য। সংসদে দেওয়া তার বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে, এরইমধ্যে সংসদে দেওয়া নিজের ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ফখরুল ইমাম।

তারপরও পাঠ্যবই নিয়ে অপপ্রচার থামেনি। পাঠ্যবইয়ে ভুল রয়েছে তা সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। ইতোমধ্যে ভুল সংশোধনও হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে ভুল সংশোধনে একটি এবং পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে কারও ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা দেখতে দুটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। অপপ্রচার মোকাবিলা করতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘চিহ্নিত গোষ্ঠী, যাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিন্তু তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমাদের শিক্ষাক্রমের বইগুলো পড়ানো হয় না, তারা ব্যাপকভাবে এই বইগুলো নিয়ে অপপ্রচারে নামেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও অপপ্রচারের অংশ হয়ে যাচ্ছেন। দায়িত্বশীলরাও বইগুলো না পড়ে অপপ্রচারে নামছেন, মহান সংসদ দাঁড়িয়েও কেউ কেউ মিথ্যাচারের অংশ হয়ে যাচ্ছেন, এটি দুঃখজনক, লজ্জাজনক।’

এবার দেখা যাক গণমাধ্যম কীভাবে অপপ্রচারে নেমেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকা গত ১১ ফেব্রুয়ারি ‘পাঠ্যবই থেকে বাদ যাচ্ছে ডারউইনের তত্ত্ব!’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে। খবরে বলা হয়, ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’, যদিও পত্রিকাটি পরে ভুল স্বীকার করেছে।

অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৈনিকেও গত ২৬ জানুয়ারি ‘ষষ্ঠতে বিবর্তনবাদ বাদের চিন্তা’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছে। খবরটির একাংশে বলা হয়, ‘সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ডারউইনের তত্ত্ব শেখানো নিয়ে। এ তত্ত্ব ষষ্ঠ শ্রেণির ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। মূলত বোঝানো হয়েছে কালের বিবর্তনে বানর থেকে ধাপে ধাপে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে।’ রিপোর্টটির এই অংশটি খেয়াল করলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, ছবি সম্পর্কে কোনও বিশেষজ্ঞের অভিমত না নিয়েই রিপোর্টার তার নিজের অভিমত তুলে ধরেছেন, লিখেছেন— ‘…ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। মূলত বোঝানো হয়েছে কালের বিবর্তনে বানর থেকে ধাপে ধাপে মানুষ রূপান্তরিত হয়েছে।’

বিবর্তনবাদ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বরাত দিয়ে আরও একটি চিহ্নিত দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ‘স্কুলের নতুন পাঠ্যবই নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তুমুল বিতর্ক’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বিবর্তন সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছে পত্রিকাটি। পাঠ্যবইয়ে বিবর্তন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষোদগারের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। এই গণমাধ্যমটি এ বিষয়ে লিখেছে— ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল লিখেছেন, ৭ম শ্রেণি’র ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ের রচয়িতাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুল তথ্য দিয়ে হলেও ব্রিটিশ শাসনপূর্ব মুসলিম শাসকদের হেয় করা, অন্য ধর্মের শাসকদের তুলনায় তাদের নিচু করা। এটি সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িকতা। এই বইয়ের কন্টেন্ট সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি এবং যে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা এটি রচনা করেছে তাদের তীব্র নিন্দা করছি।’

আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি—১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলা আক্রমণ করে ক্ষমতা দখল করেন। এখানে আমার প্রশ্ন—দখল করলে ‘দখল’ বলা হলে মুসলিম শাসকদের হেয় করা হবে কেন? নিজ ধর্মের লোক দখল করলে ‘দখল’ বলা যাবে না? দখলকারীকে ‘দখলকারী’ বললে কি সাম্প্রদায়িকতা করা হয়? কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করতেই পারেন, তাই বলে গণমাধ্যম কি বিষয়টি তুলে এনে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করতে পারে?

একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মীয় মডারেট মানুষ বিবর্তনবাদকে বিতর্কিত করার জন্য যে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের অভিমতকে গুরুত্ব দিয়ে কতিপয় গণমাধ্যমে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ কতিপয় গণমাধ্যম যাচাই-বাছাই না করে ধর্মব্যবসায়ী ও মডারেটদের কথা বিশ্বাস করেই বিবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়িয়ে দিচ্ছেন নয় কি? ছড়াচ্ছেন, কারণ এদের মতাদর্শ হয়তো এক।

সরকার বিবর্তন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তুলে ধরার উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের কারণে পেরে উঠলো না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড জরুরি বৈঠক করে দুটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিবর্তন তত্ত্ব তুলে দিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানায় গণমাধ্যম।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, শিক্ষামন্ত্রী শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) তার নির্বাচনি এলাকায় উঠান বৈঠকের সময় বলেছেন, ‘বইয়ে ইসলামবিরোধী কিছুই নেই, তারপরও আমরা মানুষের কথা শুনি।’ এর আগেও তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছি তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যা যা বলা হয়েছে তার প্রত্যেকটির জবাব আছে। যারা মন্দ কাজ করছে তাদের উদ্দেশ্য মন্দ, পথ মন্দ। আমরা নিশ্চয় থেমে থাকবো না।’

কিন্তু সত্যিই থেমে যেতে হলো শিক্ষামন্ত্রীকে। এতে ‘চিহ্নিত গোষ্ঠী’ হয়তো আপাতত বিজয়ের আনন্দে রয়েছেন। ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’ পাঠ্যবইয়ে না থাকলেও বিবর্তন তত্ত্বটি নিয়ে বিতর্ক করার আলোচনায় থাকতে চেয়েছেন। আর যারা বিবর্তন তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য মতবাদ হিসেবে মেনে নিয়েছেন তারাও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে—পাঠ্যবইয়ে না থাক, বিবর্তনবাদ যেন আলোচনায় থাকে।

আমিও ব্যক্তিগতভাবে চাই—এটি নিয়ে আলোচনা হোক। নিষিদ্ধ জিনিসে যেহেতু মানুষের কৌতূহল, আগ্রহ বেশি, তাই বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে না থাকলেও মানুষ খুঁজে বের করে পড়বে। শিক্ষার্থীসহ নানা মত ও পথের মানুষ বিষয়টি ভালো করে জানতে পারবে। সত্য উদ্ঘাটন করতে এই আলোচনা সত্যিই জরুরি বলে মনে হচ্ছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক