শিক্ষকরা হয়তো ক্লাসে আর মন খুলে কথা বলতে সাহস পাবেন না

জুলাই ৭, ২০২২

মুহম্মদ জাফর ইকবাল:

শিক্ষাবিদ ও পদার্থবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন জনপ্রিয় লেখক। তিনি প্রায় আড়াই দশক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষকতার পর ২০১৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ থেকে ‘৯৪ সাল পর্যন্ত দেশে ফেরার আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চে (বেলকোর) গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে ১৯৮২ সালে পিএইচডি এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) ডক্টরেট-উত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন যথাক্রমে ১৯৭৩ ও ‘৭৪ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে লেখালেখি করা মুহম্মদ জাফর ইকবাল ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর জন্ম ১৯৫২ সালে।
শিক্ষক নিপীড়নের ধারাবাহিক ঘটনার পর সর্বশেষ ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যার ঘটনা ঘটল। বিষয়টি কীভাবে দেখেছেন?

বিষয়টি সহজভাবে দেখা কিংবা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। বলা যেতে পারে, এটি পুরো জাতির বিবেকের টুঁটি চেপে ধরার মতো একটি ঘটনা। এটি যে শুধু ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যার ঘটনা; তা নয়। খুবই ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে প্রকাশ্যে সবার সামনে ঘটানো একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। যেভাবেই হোক সেই দুর্বৃত্ত ছাত্রের ধারণা হয়েছিল- সে পার পেয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আগে সে নানা ধরনের দুর্বৃত্তপনা করে পার পেয়ে এসেছে। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার; দেশের আনাচে-কানাচে আরও অনেক জায়গায় হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়ে আছে, যেগুলো আমরা জানি না; ঘটে যাওয়ার পর জানব।

সাম্প্রতিক নিপীড়নের শিকার শিক্ষকদের নামগুলো যদি আমরা দেখি- স্বপন কুমার বিশ্বাস, হৃদয় কুমার মণ্ডল, আমোদিনী পাল, শ্যামল কান্তি ভক্ত- এগুলো বিশেষ কোনো ইঙ্গিতবহ?

এই নামগুলোর সঙ্গে আমরা প্রাণ হারানো উৎপল কুমার সরকারের নামটিও যুক্ত করতে পারি এবং মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, নিপীড়নের জন্য সব সময়ই হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের বেছে নেওয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার এই কুৎসিত রূপটি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আমরা সাম্প্রদায়িকতার এই দুরারোগ্য ক্যান্সার কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, সেটি দেখতে পাই। আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই যখন দেখি, এ দেশের ভিন্ন ধর্মের শিশুরা তাদের সমবয়সী অন্য শিশুদের কাছ থেকে কীভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। কীভাবে কীভাবে জানি এ দেশের শিশুদের বেশিরভাগ অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের সব ধর্মের জন্য শ্রদ্ধাবোধ শেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরিবার কিংবা সমাজ থেকে যদি আমরা সব ধর্মের জন্য সম্মানবোধ শিখতে না পারি, তখন সেটি শেখানোর শেষ জায়গা হিসেবে তাদের স্কুল কিংবা পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। অতীতে হেফাজতের হুমকিতে যেভাবে পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন করা হয়েছিল; যদি সেই লজ্জাজনক অবস্থান থেকে আমরা বের হতে না পারি তাহলে কোথায় যাব জানি না!
রাষ্ট্রকে সজ্ঞানে ভাবনা-চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আমরা দেশটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। শুধু বক্তব্য আর বক্তৃতায় বড় বড় কথা বলে এটি হবে না। অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা করে সবাই মিলে সুনির্দিষ্ট কাজ করতে হবে। ঠিক কী ধরনের কাজ করতে হবে, সেটাও আমরা মোটামুটি জানি। যত তাড়াতাড়ি আমরা সেই কাজ শুরু করতে পারব ততই ভালো।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে বড় ধরনের ফারাক কি শিক্ষক হত্যায় ভূমিকা রেখেছে? আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীদের অধিকার আন্দোলনে আপনি যেভাবে এগিয়ে আসেন; তাঁদের পাশে দাঁড়ান; অন্যরা কিংবা দায়িত্বশীল শিক্ষকরাও সেভাবে এগিয়ে আসেননি।

স্কুলের একজন কিশোর শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে হত্যা করে ফেলার মতো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ফারাক মোটেও হয়নি। পত্রপত্রিকায় যেটুকু দেখেছি, সেখান থেকে জেনেছি; উৎপল কুমার সরকার অত্যন্ত দায়িত্বশীল একজন শিক্ষকের মতো শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কাজ করছিলেন। নানাভাবে প্রশ্রয় পাওয়া উচ্ছৃঙ্খল এবং বেপরোয়া কোনো ছাত্রের যদি সেটি নিয়ে সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্ম নেয়; সেটি পুরোপুরি তার সমস্যা। মোটেও তা ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের সমস্যা নয়।
একজন কিশোরের বড় ধরনের অপরাধ করতে শিখে যাওয়া খুব যে নতুন একটি বিষয়, তাও নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুলি করে এক শিশু অন্যদের মেরে ফেলছে; এটি প্রায় নিয়মিত ঘটনা। সেই দেশে সমাজের অবহেলিত শিশু-কিশোররা গ্যাং কালচারে বড় হয়। আমাদের দেশেও এখন সেটি ফ্যাশন হিসেবে শুরু হয়েছে বলে খবর পাচ্ছি। এর পেছনে স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক একটা বড় ভূমিকা রেখেছে বলে আমার সন্দেহ হয়। একজন বড় অপরাধ করে যখন সেটি প্রচার করে তার মতো অন্য আরেকজনের বাহবা পায়, তখন সেটি থামানো মুশকিল। ইলেকট্রনিক সার্কিটে হুবহু এ বিষয়টি ঘটে। নিয়ন্ত্রণহীন এ অবস্থাকে পজিটিভ ফিডব্যাক বলে। পজিটিভ ফিডব্যাক নিজে নিজে নিয়ন্ত্রণে আসে না। এটাকে জোর করে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
‘শিক্ষার্থীদের অধিকার আন্দোলনে আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম’ বলে যদি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশনরত ছেলেমেয়েদের অনশন ভাঙানোর বিষয়টি বোঝানো হয়, তাহলে তার একটু ব্যাখ্যা দেওয়া ভালো। আমি (এবং আমার স্ত্রী) ছাত্রছাত্রীদের অনশন ভাঙিয়ে তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য গিয়েছিলাম। তাদের আন্দোলনের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে তারা সরাসরি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছে। সেই দাবি-দাওয়া পূরণ করে সরকার কীভাবে তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করবে, সেটি ভিন্ন একটি বিষয়।
কয়েক মাস আগে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির পর আপনি তাঁকে সসম্মানে মুক্তির আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি মুক্ত হলেও শিক্ষকের অপমান থেমে নেই। যার সর্বশেষ নজির নড়াইলের স্বপন কুমার বিশ্বাস। তাঁকেও শিক্ষার্থী-জনতা সবাই মিলে হেনস্তা করল। শিক্ষকের সম্মান দিতে আমরা কেন ব্যর্থ?

স্বপন কুমার বিশ্বাসের অসম্মান বিষয়টি বোঝানোর জন্য খুবই নিরীহ একটি শব্দ ‘হেনস্তা’ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণটি আমরা জানি, গলায় জুতার মালা ঝোলানোর মতো অবিশ্বাস্য রকম হৃদয়হীন ঘটনার কথাটি বলতে আমাদের সংকোচ হয়। এখানে অসম্মানিত মানুষটি একজন শিক্ষক না হয়ে একজন শ্রমিক বা কৃষক হলেই যে অসম্মান করার এই প্রক্রিয়াটি বেশি গ্রহণযোগ্য হতো; ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। সবার বেলাতেই এটি সমানভাবে অসম্মানজনক। তবে শিক্ষকদের আমরা সামাজিকভাবে আমাদের মা-বাবার সমান কিংবা তার ওপরে রেখে অভ্যস্ত। তাই কিছু শিক্ষার্থী এবং কিছু মানুষ মিলে অবলীলায় শুধু এ রকম একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে; তা নয়। তার ছবি তুলে প্রচার করতে পর্যন্ত দ্বিধা করছে না; সেটি আমাদের সবাইকে প্রবলভাবে আহত করেছে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার, বিষয়টি পুলিশের সামনে ঘটেছে। হৃদয় মণ্ডলকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজে দেখছি, এখন অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীকে মনে রাখতে হবে- এ ঘটনায় পুলিশও কিন্তু সমান অপরাধী।
শিক্ষকদের সম্মান দিতে আমরা কেন ব্যর্থ- এই প্রশ্নের উত্তর ঘটনাগুলোর মধ্যেই রয়েছে। এখানে প্রত্যেক শিক্ষকই হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং শিক্ষকদের অসম্মান করার জন্য প্রতিবারই তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো একভাবে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করা হয়েছে। কোনোবারই এই ধর্ম অবমাননার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারপরও বিনা অপরাধে তাঁদের চরমভাবে অপমান করা হয়েছে। শুধু যে সামাজিকভাবে অপমান করা হয়েছে, তা নয়। তাঁদের জেলহাজত পর্যন্ত খাটতে হয়েছে। এত সহজে যদি একজনকে হেনস্তা করে কোনো একটা মতলব বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে দুর্বৃত্তরা যে বারবার সেই সুযোগ নেবে, তাতে তো আর অবাক হওয়ার কিছু নেই।
স্বপন কুমার বিশ্বাসের ঘটনায় অভিযোগ রয়েছে, একটি চক্র তাঁর ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ চেয়ার দখল করতে চায়। সম্প্রতি দেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের অন্যান্য ঘটনায়ও এমনিভাবে ধর্ম অবমাননার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর ব্যাখ্যা কী?

শুধু যে স্বপন কুমার বিশ্বাসের বেলায় চেয়ার দখলের অভিযোগ আছে; তা নয়। হৃদয় মণ্ডলের বেলাতেও কোনো একজন শিক্ষকের কোচিং ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ ছিল। অন্যান্য শিক্ষকের বেলাতেও এ রকম স্বার্থ-অর্থ-ব্যবসা ইত্যাদির যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। এ কথাটিই আমি একটু আগে বলেছি, একটা হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে একজন নিরপরাধ হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকের ওপর ধর্ম অবমাননার অভিযোগ দেওয়া। এই অবিশ্বাস্য অমানবিক প্রক্রিয়াকে সফল করার জন্য শুধু যে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আছে; তা নয়। অনেক সময় দুর্বৃত্তদের পাশে প্রশাসন, পুলিশ এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও থাকেন।
শিক্ষক নিপীড়ন এবং হত্যার মতো ঘটনায় যেভাবে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেভাবে আমরা দেখছি না। এমনকি শিক্ষক সংগঠনগুলোও সে অর্থে সোচ্চার নয়। এমনটা কেন হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

আমি তো আপনাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করতে পারি- হৃদয় মণ্ডলের ঘটনাটি যথাসময়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে পৌঁছানো হয়েছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রগুলোর কাছে প্রথমে এ ঘটনা তাদের পত্রিকায় ছাপানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। সংবাদমাধ্যমই যদি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ওপর নিপীড়নকে কোনো গুরুত্ব না দেয়, তাহলে আমরা অন্যদের কাছে কী আশা করতে পারি? তারপরও আমি পুরোপুরি হতাশ নই। খবরগুলো জানাজানি হওয়ার পর দেশের মানুষকে এসব বিষয় নিয়ে সোচ্চার হতে দেখছি।
এখন শিক্ষক সুরক্ষা আইনের দাবি উঠেছে। আইন কতটা জরুরি? শিক্ষাগুরুর মর্যাদা আইন দিয়ে নিশ্চিত করা সম্ভব?না। নিজের সম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। তার জন্য একেবারে প্রাণ দিতে হবে- এতটা আমি কখনও কল্পনা করিনি।
শিক্ষকদের সম্মান বজায় রাখতে ‘শিক্ষকসুলভ’ ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে, তার ব্যাখ্যা কী?
যখন বেছে বেছে কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার দোহাই দিয়ে অপদস্থ করা হচ্ছে তখন ‘শিক্ষকসুলভ’ ভূমিকা নিয়ে হঠাৎ আলোচনা শুরু করা আমার কাছে এক ধরনের দুরভিসন্ধি মনে হচ্ছে। আমি যেহেতু কোনো ধরনের সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত নই, তাই এ আলোচনাটি আমার চোখে পড়েনি। সে জন্য আমি কোনো মন্তব্য করছি না। তবে শিক্ষকসুলভ আচরণ নিয়ে যদি আলোচনা করতেই হয়, সেটি ভিন্ন সময় ভিন্নভাবে করতে হবে। এই মুহূর্তে সেই আলোচনা শুরু করে সবার নজর অন্যদিকে সরানোর কোনো অর্থ হয় না।
এক্ষণে করণীয় কী এবং শিক্ষকদের সম্মান, মর্যাদা ও গৌরব বজায় রাখতে সার্বিকভাবে কার কী ভূমিকা হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

এই দেশে একজন আমলা, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক বা রাজনৈতিক নেতার মান-মর্যাদা কিংবা গৌরব রক্ষা করার জন্য কাউকেই আলাদাভাবে চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু শিক্ষকের মান-মর্যাদা আর গৌরব রক্ষা করার জন্য সবাইকে দুর্ভাবনা করতে হয়- এটি যে একটা খুব দুঃখের ব্যাপার, সেটি সবাই কি লক্ষ্য করছে? অথচ এ রকমটি হওয়ার কথা ছিল না। একজন শিক্ষক যদি তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই তাঁর মান-মর্যাদা রক্ষা হয়। এ মুহূর্তে যে ব্যাপারটি আতঙ্কের সেটা হচ্ছে, একজন শিক্ষক হয়তো তাঁর ক্লাসে ছেলেমেয়েদের সামনে আর মন খুলে কথা বলতে সাহস পাবেন না। কোনো কোনায় বসে কোনো ছাত্র বা ছাত্রীটি তাঁর কোনো কথা কখন রেকর্ড করে কী উদ্দেশ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ছেড়ে দিয়ে তাঁকে কী বিপদে ফেলবে, কে বলতে পারে! আমার মনে হয়, এটিই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। আমি আর একটি বিষয়ে একটু কথা বলে শেষ করে দিই। আমাদের অনেক শিক্ষক নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন। কিন্তু দিন শেষে তাঁরা আপনজনের কাছে ফিরে গিয়েছেন; যাঁরা তাঁকে শত অপমানের মাঝেও বুকে আগলে রেখে সান্ত্বনা দিয়েছেন। কিন্তু উৎপল কুমার সরকার আর কোনোদিন তাঁর আপনজনের কাছে ফিরে যাবেন না। শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য একজন দুর্বৃত্ত ছাত্র তাঁর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ৩০ জুন তাঁর বিয়ের তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আনন্দ-উৎসব এখন পালিত হবে এক গভীর বেদনার সঙ্গে।
অকালে স্বামীহারা তাঁর স্ত্রী এবং পরিবারের অন্য সবাইকে জানাতে চাই, তাঁর মৃত্যুটি এই দেশের বিশাল শিক্ষক পরিবারের সবার জন্য গভীর বেদনার একটি ঘটনা। আশা করি, আর কোনোদিন যেন এ দেশের মাটিতে এ রকম ঘটনা না ঘটে। আর কোনো পরিবারকে যেন এভাবে আপনজনকে হারানোর এই গভীর দুঃখ কোনোদিন বরণ করতে না হয়।