বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব।। আনোয়ার পারভেজ হালিম

ডিসেম্বর ২০, ২০২১

কেবল লেখার কারণে ব্যক্তি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ায় দেশ ছাড়তে হয়েছিল দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরিনকে। তাঁরা দু’জনই কবি দু’জনেই গদ্য লেখেন। নির্বাসিত জীবনে দীর্ঘদিন ভারতে কাটিয়ে দাউদ হায়দার এখন জার্মানিতে স্থায়ী হয়েছেন। আর তসলিমা নাসরিন কয়েকবছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসের পর কলকাতায় থিতু হয়েছেন।

১৯৭৪ সালের ঘটনা। দাউদ হায়দার তখন দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক। ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে তাঁর একটি কবিতা ছাপা হয়। ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক কবির বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে মামলা ঠুকে দেন। এরপর একটি মহল প্রতিবাদ ও মিছিল করতে থাকলে পরিস্থিতি ঘোলা হতে থাকে। ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে কবিকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে ২০ মে রাতে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২১ মে সকালে সরকারের নির্দেশে তিনি বিমানে একমাত্র যাত্রী হয়ে কলকাতা চলে যান। এর ১৩ বছর পর নোবেল বিজয়ী লেখক গুন্টার গ্রাস কলকাতায় ঘুরতে আসেন। পরিচয়ের এক পর্যায়ে দাউদ হায়দার তাঁকে পুরো বিষয়টি খুলে বলেন। পরে গুন্টারের সহায়তায় ১৯৮৭ সালে দাউদ হায়দার জার্মানিতে চলে যান। ২০০৭ সালে ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর আত্মজৈবিক ‘সুতানটি সমাচার’। ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তৎকালীন সরকার এটিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে প্রথমবার নিষিদ্ধের সাত চল্লিশ বছর পর দেশে দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হন তিনি।

দেশ ছাড়ার আগে দাউদ হায়দার ঢাকা জেলের যে সেলে থাকতেন সেখানে রাতের বেলা একটি কালো বেড়ালের আনাগোনা ছিল। দাউদ বিড়ালটিকে ভীষণ ভয় পেতেন। একই সময়ে কবি আল মাহমুদও এই জেলে বন্দি ছিলেন। ওই বিড়ালটির সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছিল তাঁর। এ নিয়ে ‘কবি ও কালো বিড়ালিনী’ নামে একাধিক সনেট লিখেছেন তিনি।

কলকাতার জীবনে লেখক অন্নদাশংকর রায় ও লীলা রায়ের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থাকতেন দাউদ হায়দার। তাঁকে নাতির স্নেহে দেখতেন এই লেখক দম্পতি, দাউদের লেখায় এর উল্লেখ আছে।

কলকাতায় দাউদ হায়দারের একাধিক প্রেমের কথা শোনা যায়। তাঁর এক কবি প্রেমিকা ক্যান্সারে মারা গেলে তাঁকে উৎসর্গ করেন ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের এক প্রভাবশালী রাজনীতিকের ভাগ্নির সঙ্গেও গভীর প্রেম ছিল তাঁর। মেয়েটির মা-বাবা সেই প্রেমিকাকে জোর করে বিয়ে দেন। কানাডা প্রবাসী প্রেমিকার ছেলের ছবি দেখে চিরকুমার দাউদ হায়দার লিখেছেন, ‘পুত্রের চেহারা কেন হুবহু আমার মতো কূল পাই না রহস্যের…।’

বাংলাদেশে এই একটি মাত্র পরিবার, যে পরিবারে চার ভাই-ই কবি— জিয়া হায়দার, মাকিদ হায়দার, দাউদ হায়দার ও জাহিদ হায়দার। তবে ব্যতিক্রম তাদের আরেক ভাই রশীদ হায়দার, তিনি ছিলেন গদ্য লেখক।

তসলিমা নাসরিন এক সময় থাকতেন শান্তিবাগে। ওই বাসায় তাঁর বইয়ের আলমারিগুলো ছিল ড্রইংরুমে। শান্তিনগরে নিজের ফ্ল্যাটে উঠে বইয়ের জন্য তিনি আলাদা কক্ষ বরাদ্দ করেছিলেন। ছোট্ট সেই কক্ষজুড়ে ছিল বই আর বই। চার দেয়াল ঠেঁসে বইয়ের আলমারি। ফ্লোরে ম্যাট বিছানো, কোনও চেয়ার-টেবিল ছিল না। তাঁর এই ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে এনে আমি ‘বেদ’-এর চার খণ্ড পড়েছিলাম। একদিন তিনি জানালেন যে, আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। বললেন, ‘বেইলি রোডে যাচ্ছি, কলকাতার বন্ধুদের জন্য কিছু গিফট কিনতে হবে।’ এই ফাঁকে আমি কিছু প্রশ্ন তৈরি করে ফেললাম। তিনি বাসায় ফিরে এলে পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার নিই। সেটি বাংলার বাণীর সাহিত্য পাতায় ছেপেছিলেন সোহরাব ভাই (সোহরাব হাসান)।

তসলিমা নাসরিন তখন কলাম লিখতেন সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ এবং ‘বিচিন্তায়’। এরমধ্যে বিচিন্তার মালিকানা বদল হয়ে গেলে লিখতেন কেবল খবরের কাগজে। সে সময় কলামের জন্য তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়।

১৯৯২ সাল। আমি তখন কাজ করি সাপ্তাহিক সমীক্ষণে। আমার সম্পাদক মেসবাহ্ ভাই (মেসবাহ্‌উদ্দিন আহমেদ) একদিন বললেন, ‘নাসরিনের কলাম আনো।’ শীতের এক বিকালে ছুটে গেলাম মিটফোর্ডে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তিনি অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে বললেন, ‘সিজারের রোগী, অ্যানেস্থিশিয়ার ঘোর কাটার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।’ তারপর রিকশায় করে ফেরার পথে বললেন, সমীক্ষণে লিখবেন তবে প্রতিটি লেখার জন্য পাঁচশ’ টাকা দিতে হবে। যদ্দুর মনে পড়ে, সে সময় আমরা প্রতিটি লেখার জন্য শামসুর রাহমানকে চারশ’, আর আহমদ শরীফকে আড়াইশ’ টাকা করে সম্মানী দিতাম। বিনোদ দাশগুপ্ত, নাজিমউদ্দিন মোস্তান, মতিউর রহমান চৌধুরী, বিভুরঞ্জন সরকারসহ অন্য সবাই পেতেন দু’শো টাকা করে। কোনও চিন্তাভাবনা না করে মেসবাহ্ ভাইয়ের অনুমতি ছাড়াই আমি রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন পল্টনের কস্তুরি হোটেলে নাসরিন আমাদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেলেন এবং পরের সপ্তাহ থেকে সমীক্ষণে লেখা শুরু করলেন। কলামের নাম ‘যাবো না কেন যাবো।’ পরে সেসব লেখা নিয়ে এই নামেই বিদ্যা প্রকাশ থেকে বই বের হয়েছিল।

তিরানব্বইয়ের মার্চ-এপ্রিলে সমীক্ষণ বন্ধ হয়ে গেলে শফিক ভাইর (শফিক রেহমান) ইস্কাটনের বাড়িতে আমি প্রায়ই আড্ডা দিতে যেতাম। কথা প্রসঙ্গে একদিন তিনি বললেন, ‘সমীক্ষণ তো বন্ধ হয়ে গেছে। নাসরিন কি যায়যায়দিনে লিখবে? একদিন নিয়ে এসো।’ পরের শুক্রবার সকালের দিকে আমরা তাঁর বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি, কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীও উপস্থিত। তিনি তখন যায়যায়দিনে ‘প্রিয় ফারজানা’ নামে কলাম লিখছেন। ঘণ্টাখানেকের আড্ডায় নানা প্রসঙ্গে আলোচনা— তসলিমা নাসরিনকে ইতোমধ্যে টাঙ্গাইলের কোনও এক প্রত্যন্ত উপজেলায় বদলি করেছে সরকার। প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দেবেন, তবু তিনি সেখানে যাবেন না। ফারুক চৌধুরী তখন ব্র্যাক-ডেল্টার উপদেষ্টা। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে নাসরিনকে চাকরির অফার দিলেন। নাসরিন বললেন, ভেবে দেখবেন। ঠিক হলো নাসরিন যায়যায়দিনে কলাম লিখবেন। কিন্তু কলামের নাম কী হবে? নাসরিনই বললেন, ‘নষ্ট গদ্য’। শফিক ভাই এর সঙ্গে আরও দু’টো শব্দ জুড়ে দিয়ে করলেন, ‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’। তখন যায়যায়দিনের ঈর্ষণীয় প্রচার সংখ্যা। কলামটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল।
তসলিমা নাসরিনের গদ্যের চেয়ে তাঁর কবিতা আমার বেশি ভালো লাগে। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নির্বাসিত বাহিরে আন্তরে’ ছাড়াও ‘বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা’, ‘আয় কষ্ট ঝেঁপে জীবন দেব মেপে’, ‘বালিকার গোল্লাছুট’, ‘অতলে অন্তরীণ’, ‘নির্বাচিত নারী’, ‘নির্বাসিত নারীর কবিতা’, কিংবা ‘তসলিমা নাসরিনের প্রেমের কবিতা’ বইগুলো যারা পড়েছেন, হয়তো আমার মতো তারাও বলবেন— কবিতায় নাসরিন ছিলেন অনবদ্য। তিনি এখনও কবিতা লেখেন কিনা জানি না। তবে বাংলাদেশের দুই-একটি পত্রিকায় মাঝে মাঝে তাঁর কলাম ছাপা হয়, বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ি।

তসলিমা নাসরিনের দুই লাইনের একটি কবিতা—
তিরিশে নাকি কমতে থাকে ভালোবাসার শীত
আমার দেখি তিরিশোর্ধ্ব শরীর বিপরীত।
(কাঁপন ১/ বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৮ সালে বাংলা কবিতার একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন। ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’ নামে সেই বইটি বের হওয়ার পর সম্পাদক ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কারণ, তিনি যাদের কবিতা সংকলনভুক্ত করেছিলেন, তাদের করোরই অনুমতি নেননি। এই ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তিনি লিখেছেন, ‘‘অনুমতি ছাড়া কবিতা ছাপা হয়েছে বলে একজন তো চেয়ে বসলো এক হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ। একেবারে শেষ মুহূর্তে দু-চারজনের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল বলে জীবনময় রায় জানালেন, না। কবিতা ছাপানোর ব্যাপারে তাঁর সম্পূর্ণই আপত্তি। কিন্তু ছাপা তো হয়েই গেছে তখন। কী করবেন এবার রবীন্দ্রনাথ? ‘বই বাজারে প্রকাশিত হলেই আমাদের নামে উকিলের চিঠি’ আসতে পারে বলে রবীন্দ্রনাথকে খবর দিচ্ছেন বিশ্বভারতীর কর্মীরা। কী তবে করা যায়? জীবনময়ের বদলে দ্রুত তখন সংগৃহীত হলো নিরুপমা দেবীর একটি কবিতা, সেই পাতাটি ছাপিয়ে নেওয়া হলো সঙ্গে সঙ্গে, জীবনময়ের পাতা সরিয়ে সেখানে এঁটে দেওয়া হলো নিরুপমার কবিতা। স্বভাবতই পাল্টাতে হলো সূচিপত্রও, আর সূচনায় যুক্ত হলো নতুন একটা ‘নিবেদন’। সূচিপত্রের বিশেষ ওই পাতাটা অবশ্য পাল্টাতেই হতো, কেননা ওখানেই যতীন্দ্রমোহন বাগচীর নামটা ভুল ছাপা হয়েছে বলে তাঁর এক রুষ্ট চিরকুট নিয়ে এসেছে তাঁর দূত!’’

শঙ্খ ঘোষ আরও জানান, ‘আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া ওই নতুন পাতাগুলির জোড়চিহ্নগুলি এখনও বেশ দেখা যায় স্পষ্ট। কিন্তু না, এ-বইয়ের প্রথমেরও প্রথম আমার কাছে নেই, আছে কেবল নতুন-করা-আঠায়-জোড়া প্রথমখানা।’ (শঙ্খ ঘোষ: বইয়ের ঘর)

একই ধরনের ভুলের খেসারত দিতে হয়েছিল আবুল কালাম শামসুদ্দিন ও আবুদল গাফফার চৌধুরীকেও। ‘সেকালের একালের মুসলিম লেখকদের গল্প’ নামে দুই খণ্ডের গল্পসংকলন যৌথভাবে সম্পাদনা করেছিলেন তাঁরা। এই বইয়ে ছাপা হয়েছিল মাহবুব উল আলমের ‘কোরবানি’ নামের গল্পটি। তিনি আবুল কালাম শামসুদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, থাকেন চট্টগ্রামে। একশ’ টাকা সম্মানীও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাহবুব চিঠি লিখে পাঁচশ’ টাকা দাবি করে বসলেন। বন্ধুর এমন আচরণে অভিমান করে চুপ হয়ে যান আবুল কালম শামসুদ্দিন। অপর সম্পাদক গাফফার চৌধুরী এবং বইয়ের প্রকাশক কেউই বিষয়টিকে তেমন আমলে নেননি। পরে দেখা গেলো, চট্টগ্রামের এক আদালতে ক্রিমিনাল ল’য়ে মামলা দায়ের করেছেন মাহবুব-উল আলম। প্রকাশক এবার ঢাকা থেকে আইনজীবীসহ ছুটে যান চট্টগ্রামে। লেখককে আরও আড়াইশ’ টাকা দিয়ে মামলা মিটমাট করেন।

আজও একদল মানুষ অনর্থক আলোচনায় লিপ্ত হন, পুলকিত হন, তুলনা করে করেন— কে বড় কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি কাজী নজরুল ইসলাম? আবার মৃত্যুর পর নজরুলকে ‘মুসলমানের কবি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচারে নামেন আরেক দল। অথচ নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ করতেন না। মুসলমানের জন্য লিখেছেন হামদ, নাত ও গজল, হিন্দুর জন্য লিখেছেন শ্যামা সংগীত ও ভজন। তাঁর কাছে সবাই ছিল সমান। নজরুল যেমন রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করতেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনই নজরুলকে ভালোবাসতেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ হয় শান্তিনিকেতনে, ১৯২১ সালে। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাট্যগ্রন্থ ‘বসন্ত’ উৎসর্গ করেন নজরুলকে। আবার নজরুল যেসব পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, তার প্রত্যেকটির উদ্বোধনী সংখ্যায় লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কারাগারে থাকাকালে নজরুল অনশন শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম পাঠান— ‘অনশন ত্যাগ করো। আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়।’ নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর আর্শীবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘তুমি যে বিশ্বখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবিতার জগৎ আলোকিত হোক। ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’

১৯৩১ সালে দার্জিলিংয়ে নজরুলের সঙ্গে আবারও দীর্ঘ সময়ের সাক্ষাৎ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। একান্ত এই আলাপচারিতায় তাঁরা দু’জনই বেশ খুশি হয়েছিলেন। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট সন্ধ্যাবেলা, আকাশবাণীতে জীবনের শেষ আবৃত্তি ও গান করেছিলেন নজরুল। তিনি গেয়েছিলেন—‘ ঘুমাতেই দাও, শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না, জাগায়ো না।’ আর তাঁর আবৃত্ত নিজের লেখা কবিতাটি ছিল— ‘বাংলার রবি, ভারতের রবি অস্ত যায়, হায় গো হায়…।’
কে বড় কবি আর কে ছোট কবি, এই প্রশ্নে কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন, ‘বড়-ছোট কবি নিয়ে তর্ক করার পক্ষে আমি এখনও নই, আগেও ছিলাম না। এক সময় অপঠিত জীবনানন্দ দাশ এখন সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত কবি। এমনকি তিনি আমারও প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিক, নজরুল বিপ্লবী, জীবনানন্দ নিসর্গ, শামসুর রাহমান আধুনিক ও শহুরে কবি, আবার আল মাহমুদ তো আবহমান বাংলার কবি। তাই বড়-ছোট বলা কঠিন। কে বড় কবি, কে ছোট কবি সময় তা নির্ধারণ করবে। এ নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই।’ (দেশকাল, ২০১৮)

স্বভাবে কবি নজরুল ছিলেন আত্মভোলা। অনেকেই নিজেদের স্বার্থে তাঁকে ব্যবহার করেছেন, সুযোগ নিয়েছেন। আত্মজীবনীতে এসব কথা উল্লেখ করেছেন নজরুল ইসলামের পারিবারিক বন্ধু নোয়াখালীর মাহমুদ নূরুল হুদা। তিনি ছিলেন হোসেন শহীদ সোরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক সচিব। নূরুল হুদা লিখেছেন, ‘তাঁর (নজরুলের) আর্থিক সংকটের সুযোগে ডি. এম লাইব্রেরির মালিক ও স্বত্বাধিকারীরা আত্মভোলা কবিকে মাঝে মাঝে কিছু টাকা দিয়ে তাঁর বইগুলোর স্বত্ব কিনে নিয়েছিলেন। আরও অনেকে তাঁকে ব্যবহার করেন। এঁদের মধ্যে বর্ষীয়ান সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের নাম উল্লেখ করা যায়। নজরুলের কবি প্রতিভা ও তাঁর প্রতিষ্ঠার পেছনে নাসিরুদ্দিনের বিরাট অবদানের কথা সাড়ম্বরে প্রচার করা হলেও ব্যাপারটি একেবারেই ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের লেখা ছাপিয়ে বরং সওগাত এবং সওগাত সম্পাদকের মর্যাদা বৃদ্ধি ঘটে। সম্পাদক সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু পরম দুর্ভাগের বিষয় এই যে, এর বিনিময়ে নজরুল উপযুক্ত আর্থিক প্রতিদান পাননি। এমনকি, নজরুলের সঙ্গে নাসিরুদ্দিনের আচরণ অনেক সময় অনুমোদনযোগ্য ছিল না।’

তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ১৯৭৬ সালের ১৯ আগস্ট ১০টা ১০ মিনিটে মারা যান কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে এখানে কবিকে দাফনের বিষয়ে রাজি ছিল না। মাহমুদ নূরুল হদা লিখেছেন, ‘কবিকে দাফন করার ঘণ্টাদুয়েক পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কাজী সব্যসাচী ঢাকায় এসে পৌঁছায়। পৌঁছেই ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে সে আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গিয়ে আমি তাকে অত্যন্ত শোকাভিভূত দেখতে পাই। তার পিতাকে এখানে কবর দেওয়ায় সে তীব্র অসন্তোষ ও ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে। হয়তো এই ক্রোধ ও অভিমানবশত আমি ছাড়া বাংলাদেশের আর কারও সঙ্গে সে দেখা করতে অস্বীকার করে। তাকে নিয়ে আমি তার সদ্যসমাহিত পিতার কবরে গেলে সেখানেও এই শোক বিহ্বল সন্তানের ক্রোধ প্রকাশ অব্যাহত থাকে। এক পর্যায়ে সব্যসাচী কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং রুদ্ধকণ্ঠে বলতে থাকে যে, চুরুলিয়ায় তার মায়ের কবরের পাশে তার পিতার জন্য কবরের স্থান নির্ধারিত ছিল। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ওই সময়ে নজরুলের কবরে বিশিষ্ট কোনও বুদ্ধিজীবী বা সরকারি পর্যায়ের কেউ উপস্থিত ছিলেন না।’ (আমার জীবনস্মৃতি: মাহমুদ নূরুল হুদা)

ফরাসি বীর নেপোলিয়নের সঙ্গে গ্যেটের সাক্ষাৎকারের একটি ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে। গ্যেটে এফুর্টে শুয়ে আছেন শুনে, নেপোলিয়ন ঠিক করলেন, কবির সঙ্গে দেখা করবেন। এই ইচ্ছার খবর পেয়ে গ্যেটে চললেন নেপোলিয়নের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তখন সকাল। ফরাসি বীর প্রাতরাশে বসেছেন। জার্মান কবি ঘরে ঢুকতেই তিনি এক-দৃষ্টে তাঁর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন—‘Vous etes un hom me! একজন মানুষ আপনি!’ গ্যেটের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এমন সারগর্ভ উক্তি আর কেউ করেননি। নেপোলিয়ন গ্যেটেকে সম্মান-চিহ্নে ভূষিত করেন।

১৮০৬ সালে নেপোলিয়ন জেনার-যুদ্ধে জয়লাভ করে ভাইমারও নিজের দখলে আনেন। তাঁর সৈন্যবাহিনীর হাতে অবশ্য গ্যেটের ঘরবাড়ির বা জিনিসপত্রের কোনও ক্ষতি হয়নি। সৈন্যরা ভুল করে কবির বাড়িতে ঢোকে। তারা উৎকৃষ্ট শয্যার জন্য গোঁ ধরে এবং খোদ গ্যেটের ঘাড়ের ওপরে তলোয়ার ওঠায়। এ খবর সেনাপতির কানে গেলো পরের দিন। আর যায় কোথায়! তিনি ঘটনাস্থলে স্বয়ং এসে বেয়াড়া সৈন্যদের বিচার করেছিলেন। একজন কবির প্রতি ফরাসি সেনাপতির এই সম্মান প্রদর্শন ইতিহাসে উজ্জ্বল হরফে লেখা রয়েছে। গ্যেটের প্রতি ফরাসি সামরিক কর্তৃপক্ষের এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কারণেই তিনি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে জার্মানির অভ্যুত্থানে খুশি হননি।’’

‘‘কোরআন আর বাইবেলের সঙ্গে কম বয়সেই পরিচয় ঘটে গ্যেটের (পুরো নাম যোহান ভোলফগাং ফন গ্যেটে)। মূলত অনুবাদের মাধ্যমে প্রাচ্যদেশীয় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও কাব্যের স্বাদ গ্রহণ করেন কবি। একবার ভেবেছিলেন বেদ অনুবাদ করবেন ছন্দোবদ্ধভাবে। ‘শকুন্তলা’ উপাখ্যান পড়ে তিনি অভিভূত হয়ে কেঁদেছিলেন। শকুন্তলার প্রশস্তটি লেখেন ১৭৯২ সালে। এই কাহিনিটি তিনি পাঠ করেন স্যার উইলিয়াম জোনসের অনুবাদ থেকে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ফাউস্টের রচনারীতিতে সংস্কৃত নাটকের প্রভাব পড়েছিল খুব সম্ভবত তাঁর ‘শকুন্তলা’ পাঠের ফলেই। … ‘মোহম্মদের গান’ কবিতাটি লেখার আগে তিনি পবিত্র কোরআন ও হযরত মুহম্মদের (সা.) জীবনী ভালো করে পড়ে নিয়েছিলেন।’’ (মহাকবি গ্যেটে: আবু কায়সার, ১৯৯২)
টাইটেল মোটিফ: #FaruqueAhmedMoni