ইউপি নির্বাচনে ঢাকা-খুলনা বিভাগে সহিংসতার আশঙ্কা

নভেম্বর ৪, ২০২১

আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ঢাকা ও খুলনা বিভাগে সহিংসতার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সাম্প্রতিক কয়েকটি সহিংস ঘটনার বর্ণনা করে তারা নির্বাচনে শঙ্কার কথা জানান। এ সময় তারা সহিংসা এড়াতে নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়া এবং আচরণ বিধি লঙ্ঘনকারীদের প্রার্থিতা বাতিলের মতো কঠোর শাস্তির প্রস্তাব করেন।

বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) দুপুরে আসন্ন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ইউপি ভোট নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পর্যালোচনা সভায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তারা। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের সভাপতিত্বে এবং অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথের সঞ্চালনায় সভায় আরও সংযুক্ত ছিলেন— নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাত হোসেন চৌধুরী (অব.), সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার বিভাগীয় কমিশনার, উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক, পুলিশ কমিশনার ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা।

নির্বাচন কমিশন সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেন, ‘প্রথম ধাপের নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু এর পরে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে, তার কারণে কমিশন উদ্বিগ্ন। অবশ্য আজকে (বৃহস্পতিবার) আপনাদের বক্তব্যে কমিশন আশ্বস্ত। আশা করি, পরবর্তী ধাপগুলোর নির্বাচনও সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে।’

চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মকর্তারা পাহাড়ে ঝুঁকির কথা জানান। তারা সম্প্রতি কাপ্তাইয়ের সহিংস ঘটনা ও অতীতে বাঘাইছড়ির ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তাদের যে প্রস্তুতি তাতে খুব একটা সমস্যা হবে না বলে কমিশনকে আশ্বস্ত করেন কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রামের মতো রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করার কথা তুলে ধরেন মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ঢাকা, খুলনা এবং সিলেট বিভাগ থেকেও নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তারা প্রস্তুতির কথা জানান এবং বেশি সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ ফোর্স মোতায়েনের প্রস্তাব করেন।

খুলনার বিভাগীয় কমিশনার তার বক্তব্যে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নড়াইল, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ এবং মাগুরায় সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি মাগুরার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, ‘ওই ঘটনার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই এলাকায় যাওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। তবে কিছু সমস্যা ও শঙ্কা রয়েছে। আমরা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা সচেতন ও সজাগ আছি। আশা করি, ভালো নির্বাচন হবে।’ তিনি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ভয়াবহ সংকটের কথাও এ সময় তুলে ধরেন।

খুলনা রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি বলেন, ‘আমাদের জন্য মাগুরা, শৈলকূপা চ্যালেঞ্জিং। তবে আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আশা করি, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে।’

বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার আচরণ বিধি লঙ্ঘনে প্রার্থিতা বাতিলের মতো কঠোর শাস্তির কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রস্তাব থাকবে— আচারণ বিধি লঙ্ঘনের জন্য স্ট্রং পদক্ষেপ যেন নেওয়া হয়। দুই-চারটি প্রার্থিতা বাতিল হলে সেটা অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সকলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের মতো অপরাধ করার আগে এই বিষয়টি চিন্তা করবে।’

সিলেট রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি তার বিভাগের অন্য জায়গার পরিস্থিতি ভালো থাকলেও সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার ও ছাতকের পরিস্থিতি চ্যালিঞ্জিং বলে উল্লেখ করেন। দুর্গম ওই উপজেলা দুটির বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে একই দিনে ভোট হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা কঠিন হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা নিয়মিত ওয়ারেন্ট তালিম, ওয়ায়েন্ট-ভুক্ত আসামিদের গ্রেফতারসহ সার্বিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি তার বিভাগের অর্ধেকের মতো ইউনিয়ন পরিষদ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। জুম মিটিংয়ে তার বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সকলেই নিজ নিজ এলাকার ভালো পরিবেশের কথা তুলে ধরেছেন। তবে আমাদের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। ঢাকা বিভাগের যেসব ইউনিয়নে নির্বাচন হবে, তার অর্ধেকের মতো (৯০টি) উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজমান। এসব জায়গায় সহিংসতার আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুরের নির্বাচন নিয়ে আমাদের আশঙ্কা আছে। যাতে কিছু না ঘটে এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, তার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

এ সময় তিনি নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়ার প্রস্তাব করে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দেওয়ার আদেশ জারি হয়ে থাকে। এবার এ ধরনের কোনও নির্দেশনা আমরা পাইনি। যতদূর শুনেছি, এ ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে নির্বাচনের আগে বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলে ভালো হয়।’

ঢাকা রেঞ্জের কমিশনার নির্বাচনি আচরণ বিধির যথাযথ প্রয়োগের প্রস্তাব করে বলেন, ‘আচরণ বিধি লঙ্ঘন হলে যদি কঠোর শাস্তি দেওয়া হয় এবং তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়। সহিংস পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়।’

ঢাকার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারও ঢাকা বিভাগে নির্বাচনে চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন।

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন যখন মাঠ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, ঠিক তখনই ঢাকা বিভাগের নরসিংদী জেলায় নির্বাচনি সহিংসতায় তিন জন নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘প্রথম ধাপের নির্বাচন ভালো হয়েছে। তবে এরপর সহিংসতা বেড়েছে। এজন্য আমরা বিব্রত ও উদ্বিগ্ন। কেন পরিস্থিতির অবনতি, কেনইবা প্রাণহানি তা জানি না। এই বিষয়টি মোটেও কাম্য নয়। সকলে যার যার জায়গা থেকে সক্রিয় থাকলে, আর প্রাণহানি হবে না বলে মনে করি।’

তিনি বলেন, ‘আইনশঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বলবো, নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। আমরা খবর পাচ্ছি, যেসব সহিংসতা হচ্ছে তার শিকার স্বতস্ত্র প্রার্থীরা। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ আমাদের ফোন করেও এসব বলছেন। আমার মনে হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে তারা প্রতিকার পাচ্ছেন না। সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়া হলে সহিংসতা কমবে।’ অনেক স্থানে স্বতস্ত্র প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতেও পারেননি— এমন অভিযোগও ইসির কাছে এসেছে বলে এই কমিশনার উল্লেখ করে বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা মোটেও কাম্য নয়। এগুলো দেখতে হবে। আপনারা সক্রিয় হয়ে পূর্ণাঙ্গ শক্তি কাজে লাগালে সহিংসতা যারা করছে, তাদের দমন করা সঠিন হবে না। পাশাপাশি বলবো— নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যদি দায়িত্ব পালনে নির্লিপ্ত না থাকেন, তাহলে পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না।’

কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোকে বলবো, তারা যেন তাদের অতি উৎসাহী কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। তারা যেন বাড়াবাড়ি না করে। নির্বাচনে কোনও জানমালের ক্ষতি হোক চাই না। সেই ধরনের কিছু হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পিচপা হবো না।’

নির্বাচনি কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘সবাইকে বলবো— নির্বাচনি দায়িত্ব যেন আইনানুগ হয়। আইনের শৈথিল্য প্রমাণ হলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পিচপা হবো না। কোনও নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান না হওয়ার আশঙ্কা থাকলে, দরকার হলে ভোট বন্ধ করে দিতে হবে।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘সকলের বক্তব্য শুনে আমরা আশ্বস্ত। আশা করি, সুন্দর নির্বাচন হবে। এখানে খুলনা ও ঢাকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে সময়োপযোগী পদেক্ষেপের ফলে খুলনার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। ঢাকার বিষয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সফল হবো। গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে আগেভাগে ব্যবস্থা নেওয়া গেলে, সহিংস ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।’

ফোর্স বাড়াতে বললেন সবাই

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিয়ে দেশের আটটি বিভাগের প্রায় সবগুলোর মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বেশি সংখ্যায় পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েনের প্রস্তাব করেন। তাদের নিজস্ব ফোর্স ঘাটতির কথা বলে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে পুলিশ ফোর্স ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েনের জন্য অনুরোধ করেন। তাদের এলাকায় যে সংখ্যক ইউপি নির্বাচন হচ্ছে, সেই তুলনায় প্রয়োজনীয় পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেই উল্লেখ করে অন্য কোনও এলাকা বা কেন্দ্রীয় কোনও রিজার্ভ ফোর্স থেকে সেই ঘাটতি পূরণের প্রস্তাব করেন। এ সময়ে তারা একই ধাপে এত সংখ্যক ইউপির তফশিল না দেওয়ার প্রস্তাবও করেন। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা এই বিষয়ে তাদের খুব একটা আশার বাণী শোনাতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে সবগুলো নির্বাচন পুঞ্জিভূত হওয়ার ফলে প্রতিটি ধাপে তাদের বেশি করে ইউপির নির্বাচন করতে হচ্ছে। তারা ৩০০ থেকে ৩৫০টি করে ইউপি নির্বাচন প্রতি ধাপে করতে পারলে, এই সমস্যা হতো না। আপনাদেরকে সার্বিক বিষয়টি বিবেচনা করে যে জনবল রয়েছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। তারপরও আমি সচিবকে বলবো— জনপ্রশনাস মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করে ফোর্স বাড়ানোর কোনও ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটা দেখবেন।’