দেনমোহর কি সম্মানের?

ডিসেম্বর ২৫, ২০২০

“যে মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত, ধনাঢ্য পরিবারের সেই মেয়ের দেনমোহর হতে হবে বেশি এবং যেই মেয়ে অশিক্ষিত, গরীব ঘরের মেয়ে তার দেনমোহর হবে কম” সমাজের এই পদ্ধতিটাও ত্রুটিপূর্ণ। যে নারী শিক্ষিত সে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করতে পারবে অথবা করতে না চাইলে তার পরিবারের সক্ষমতা আছে তার ভরণপোষণ করবার। কিন্তু যে মেয়ে অশিক্ষিত সে কীভাবে নিজেকে চালিয়ে নেবে যেখানে তার পরিবারেরও সামর্থ্য নেই। আর তাকেই আপনারা স্ট্যাটাসের মাপকাঠিতে কম দেনমোহর দিয়ে ঠকাচ্ছেন।

বেশ কয়েক বছর আগেও আমাদের সমাজে যৌতুক প্রথা যেভাবে ভাইরাসের মত বিচরণ করছিলো, তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো। এমনকি মানি লন্ডারিংয়ের যে সব ক্ষেত্র আছে তার মধ্যে যৌতুককে একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। সমাজের বুদ্ধিজীবীদের আলোচনা-সমালোচনা, মিনা কার্টুন দেখিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, আইন করে নিষিদ্ধ করে যৌতুকের প্রত্যক্ষ যে ভার্সনটি প্রচলিত ছিলো সেটি মোটামুটি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বলতে লজ্জা হয়— লুকিয়ে, বেনামে এটার চর্চা এখনো কিছু কিছু বিয়েতে হয়ে থাকে। তবে আশার কথা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ শিক্ষিত ছেলেমেয়ে এই যৌতুক প্রথাকে ঘৃণার চোখে দেখছে।

অন্যদিকে যৌতুকের মতই আরেকটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে দেনমোহর।মোহর শব্দের ইংরেজি হচ্ছে ব্রাইড প্রাইস (Bride Price)। যার বাংলা করলে হয় বউ -এর মূল্য। প্রাক ইসলামি যুগে বিয়ে করতে হলে বরের পক্ষ হতে কনের পরিবারকে মোটা অংকের মূল্য পরিশোধ করতে হতো এখানে বলা রাখা ভালো সেই মূল্য কনে পেতো না, পেতো কনের অভিভাবক। সেই পদ্ধতিটিকেই ইসলামিক রীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে একটি বড় ধরণের পরিবর্তনের মাধ্যমে।

ব্রাইড প্রাইস হচ্ছে সেই মূল্য যেটি দিতে হবে কনের অভিভাবককে কিন্তু দেনমোহর দিতে হবে কনেকে। এটি কনের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত করা হবে। এই বিষয়ে কথা বললে আমার মুল বক্তব্য আর শুরু করা যাবে না। যতটুকু বলেছি তা বলেছি বর্তমান সমাজের কিছু লোককে উদ্দেশ্য করে যাতে তারা বুঝতে পারে এই পদ্ধতি বেচা-কেনার পদ্ধতি থেকেই উদ্ভব হয়েছে। অর্থাৎ আপনি যখন দেনমোহর নিয়ে দর কষাকষি করছেন মুলত আপনি কত বেশি দামে আপনার মেয়েকে বিক্রি করতে পারবেন সেই চেষ্টা করছেন।

ইসলামিক দৃষ্টিতে দেনমোহরের কোন সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। দশ দেরহামকে সর্বনিম্ন ধরা হয়ে থাকে, এছাড়াও কিছু কিছু হাদিস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় একটা লোহার আংটি বা শুদ্ধুভাবে কোরান শিক্ষাটাও দেনমোহর হতে পারে।

সীমা নির্ধারণ করা না থাকলেও আমাদের সমাজের কিছু মানুষ নিয়ম করেছে দেনমোহর নির্ধারণ হবে মেয়ের স্ট্যাটাস এবং  তার খালা ফুফুদের যে হারে দেনমোহর নির্ধারিত হয়েছে তার ধারাবাহিকতায়।

আরো সহজ করে বলতে গেলে যে মেয়ে গরীব, কম শিক্ষত, পারিবারিক স্ট্যাটাস কম তার জন্য কম দেনমোহর আর যে মেয়ে ধনী, উচ্চ শিক্ষিত, পারিবারিক স্ট্যাটাস বেশি তার জন্য বেশি দেনমোহর নির্ধারিত হবে।

এখানে একটি প্রশ্ন করা যেতে পারে দেনমোহরের এই দরকষাকষিতে কেনো মেয়ে পক্ষ অধিক দেনমোহর নির্ধারণ করতে চায়? চায়। এর কারণ একটাই। আর তা হচ্ছে নিরাপত্তা। অর্থাৎ যদি স্বামী তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেয় তাহলে স্ত্রী যেনো তাকে প্রদেয় দেনমোহরের মাধ্যমে বাকি জীবন চলতে পারে। কিন্তু বাকিতে অধিক হারে দেনমোহর নির্ধারণ করার কুটিল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বামী যেনো তার আর্থিক অভাবের কারণে তার স্ত্রীকে ছেড়ে যাওয়ার সাহস করতে না পারে। অর্থাৎ তাকে অদৃশ্য দড়ি দিয়ে পাকড়াও করে রাখা।

আপনি এমন একটা আত্মীয়তা করতে যাচ্ছেন শুরুতেই অবিশ্বাস আর অনাস্থা দিয়ে। শুধুমাত্র টাকার অভাবে যে লোক আপনার মেয়েকে আপনার বোনকে ছাড়তে পারছেন না, সেই কাপুরুষের কাছে কীভাবে আপনি আপনার মেয়েকে, বোনকে রাখতে চাইছেন? আর যদি আপনি বিশ্বাস করেন এই লোক আপনার মেয়ের জন্য, বোনের জন্য শতভাগ যোগ্য এবং সে স্ত্রীর মর্যাদা দেবে ভালোবাসবে, বিশ্বাস থাকবে তাহলে কেনো আপনি আপনার মেয়ের বা বোনের স্বামীর উপর এত বড় ঋণের বোঝা দিয়ে তার সম্মানহানী করছেন?

“যে মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত, ধনাঢ্য পরিবারের সেই মেয়ের দেনমোহর হতে হবে বেশি এবং যেই মেয়ে অশিক্ষিত, গরীব ঘরের মেয়ে তার দেনমোহর হবে কম” সমাজের এই পদ্ধতিটাও ত্রুটিপূর্ণ। যে নারী শিক্ষিত সে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করতে পারবে অথবা করতে না চাইলে তার পরিবারের সক্ষমতা আছে তার ভরণপোষণ করবার কিন্তু যে মেয়ে অশিক্ষিত সে কীভাবে নিজেকে চালিয়ে নেবে যেখানে তার পরিবারেরও সামর্থ্য নেই। আর তাকেই আপনারা স্ট্যাটাসের মাপকাঠিতে কম দেনমোহর দিয়ে ঠকাচ্ছেন।

একজন শিক্ষিত পরিবার তাদের মেয়েকে এমনভাবে যোগ্য করবে যেনো তাকে কারো দান খয়রাতের ভরসাই জীবন পার করতে না হয়।