সাবেক স্ত্রীর মামলায় সাময়িক বরখাস্ত আব্দুর রাজ্জাক প্রকল্পে ফিরতে চান

ডিসেম্বর ১০, ২০২০

সাবেক স্ত্রীর মামলায় সাময়িক বরখাস্ত এবং পরে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) শিক্ষা ক্যাডারের ৩৪ ব্যাচের প্রভাষক আব্দুর রাজ্জাক গোপনে ছয় মাসের খোরপোষ ও ভাতা নিয়েছেন আলোচিত ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প থেকে। শুধু তাই নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে ওএসডি হিসেবে যোগদান না করে প্রকল্পে ফিরতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তিনি।

ওএসডি আদেশে স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ্র বলেন, ‘বিধিবিধান অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে ওএসডি হিসেবে পদায়ন করা কর্মকর্তা সেখানে যোগদান করে বেতনভাতা নেবেন।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাষক আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে সাবেক দুই স্ত্রীর মামলার বিষয়টি সামনে আসে। গত বছরের ২৪ নভেম্বর এক স্ত্রীর মামলার কারণে সাময়িকভাবে তাকে বরখাস্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ভূতাপেক্ষ ওই আদেশে ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তাকে বরখাস্ত দেখানো হয়।

ভূতাপেক্ষ জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইল জেলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৩য় আদালতে বাদী হয়ে তার সাবেক স্ত্রী যৌতুক বিরোধী আইনে মামলা করেন। ওই মামলায় চার্জ গঠন হয় এবং মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সেহেতু আব্দুর রাজ্জাককে বিএসআর (পার্ট-১) এর ৭৩ বিধি-এর নোট ২ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অফিস মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ভূতাপেক্ষভাবে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এরপর মন্ত্রণালয়ের ওই সাময়িক বরখাস্ত আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন আব্দুর রাজ্জাক। চলতি বছর ২৮ জানুযারি সাময়িক বরখাস্ত আদেশ স্থগিত করেন হাইকোর্ট। সাময়িক বরখাস্ত আদেশ হাইকোর্টে স্থগিত হলে মন্ত্রণালয় গত ৩ ফেব্রুয়ারি ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে পদায়ন করে তাকে। কিন্তু ওএসডি করার পরও আব্দুর রাজ্জাক জটিলতা সৃষ্টি করতে পদায়ন করা পদে যোগদান করেননি।

এরপর শুনানি শেষে গত ২০ জুলাই আব্দুর রাজ্জাকের দায়ের করা রিট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। সেই হিসেবে তিনি সাময়িক বরখাস্ত। তবে সাময়িক বরখাস্ত স্থগিত থাকার সময় গত ৩ ফেব্রুয়ারির ওএসডি আদেশটি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ আদেশ। সেই হিসেবে ওএসডি আদেশটিই বলবৎ রয়েছে। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক ওএসডি হিসেবে যোগদান না করে আইনি জটিলতা দেখিয়ে প্রকল্পে ফেরার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

ঢাকা শহর এলাকায় ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের সদ্যবিদায়ী প্রকল্প পরিচালক ড. আমিরুল ইসলাম প্রকল্প থেকে খোরপোষ নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এসডি হয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে যোগদান করলেও তিনি যোগদান করেননি। উল্টো মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন প্রকল্পে ফেরার জন্য। আর গোপনে প্রকল্প থেকে ছয় মাস খোরপোষ ও ভাতা নিয়েছেন সাময়িক বরখাস্ত হিসেবে, যখন আদালতে বরখাস্ত আদেশ স্থগিত ছিল।’

অভিযোগ করে সদ্যবিদায়ী এই প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘এসব জটিলতা সৃষ্টি করা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। গাড়িচালক থেকে শুরু করে প্রকেল্পের মোট ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ১১ জন তার বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগে করেছেন লিখিতভাবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের সার্ভিস রুল অনুযায়ী কোনও কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করলে তাকে আর বদলি করা যায় না। সর্বশেষ ওএসডি আদেশ অনুযায়ী এখন আমি সাময়িক বরখাস্ত নেই। কর্মকর্তারা রাজস্ব খাতে বেতন পান। সর্বশেষ যেখানে কর্মকর্তা থাকবেন সেখান থেকে বেতন নেবেন। আমি তাই নিয়েছি। ওএসডি আদেশ কার্যকর করতে হলে আরও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়, সেটি এখনও হয়নি। আরেকটি চিঠি জারি না করলে ওএসডি আদেশ কার্যকর হবে না, আমি যোগদান করলেও বেতন উঠাতে পরবো না।’ তিনি অভিযোগ করেন প্রকল্প পরিচালক ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করিয়েছেন।

তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, সর্বশেষ আদেশ মানতে হবে সরকারি কর্মকর্তাকে। কারণ এখন এ সংক্রান্ত মামলাটিতে তার বিষয় নিষ্পত্তি হয়েছে। সেই হিসেবে ওএসডি আদেশ বহাল। কিন্তু তিনি পদে যোগদান করেননি।

প্রকল্পের কর্মচারীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আব্দুর রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেউ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেই পারে। যেখানে গিয়েছি সেখানেই সমস্যা হয়েছে, হতেই পারে। আমি যখন প্রকল্পের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি, তখন আমার বিরুদ্ধে তারা থাকতেই পারে।‘

সদ্যবিদায়ী পরিচালক ও প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান, স্ত্রীর মামলায় আদালতে অভিযোগ গঠন হওয়ার কারণে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হতে পারেন জানতে পেরেই কৌশলে প্রকল্প থেকে খোরপোষ তুলেছেন রাজ্জাক। সাময়িক বরখাস্তের পর তার খোরপোষ উত্তোলন করার কথা ছিল অধিদফতর থেকে। আবার ওএসডি হওয়ার পরও একই জায়গা থেকে তার বেতন-ভাতা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু তিনি প্রকল্পে ফিরতে সাময়িক বরখাস্ত হিসেবে খোরপোষ ভাতা নিয়েছেন প্রকল্প থেকে।

স্ত্রীর মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মামলাগুলো এখন আর নেই, খারিজ হয়ে গেছে। আমি কাগজপত্র জমা দিয়েছি।’

অভিযোগ মতে, গত বছর ডিসেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত নিজের খোরপোষ ও ভাতা অনলাইনে সাবমিট করে উঠিয়ে নেন আব্দুর রাজ্জাক। বিল উত্তোলনের পর ওই মাসেই অফিস প্রধানকে বিল প্রদানে আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার নিয়োগের বিধান চালু হয়। সে কারণে বেতনভাতা ও খোরপোষ উত্তোলন করতে আয়ন-ব‌্যয়ন কর্মকর্তা হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের বিলে স্বাক্ষরের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে আব্দুর রাজ্জাক খোরপোষ ও ভাতা উত্তোলনে প্রকল্প পরিচালকের সহায়তা চান। এতে ধরা পড়ে, অধিদফতরে পদায়ন করা ওএসডি কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান না করেই প্রকল্প থেকে গোপনে ছয় মাসের খোরপোষ ও ভাতা তুলছেন।

প্রকল্পে ফেরার চেষ্টা
প্রকল্পে ফেরার জন্য আব্দুর রাজ্জাক সচিবের কাছে আবেদন জানান ওএসডি হওয়ার পর। ওই আবেদনে তিনি লিখেছেন প্রকল্পে দুর্নীতি-ঘুষ বন্ধ করার কারণে তাকে ভূতাপেক্ষভাবে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ জারি করা হয়। যদিও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে স্ত্রীর মামলায়।

এরপর প্রকল্প পরিচালক ড. মো. আমিরুল ইসলাম আব্দুর রাজ্জাককে সামলে চলার পরামর্শ দেন। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক নিজেকে সামলে নিয়ে গোপনে প্রকল্পের বিরুদ্ধে অপ্রচার শুরু করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার চেয়েছেন তিনি।

সাবেক দ্বিতীয় স্ত্রীর অভিযোগ
দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা আক্তার প্রকল্প কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগে জানান, ২০১৭ সালের ১০ মার্চ লালমাটিয়া কাজী অফিসে আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে বিয়ে করেন তিনি। বিষের পর শারীরিক নির্যাতন ও যৌতুকের জন্য চাপ দিতে থাকেন তার স্বামী। এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন স্বামী আব্দুর রাজ্জাক তথ্য তারও আরও একজন স্ত্রী ছিলেন তা গোপন করে তাকে বিয়ে করেছেন।

প্রথম স্ত্রীও ডিভোর্স করেন আব্দুর রাজ্জাককে
সাবেক দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা আক্তার লিখিত অভিযোগে জানান, প্রথম স্ত্রী মোছা. শায়লা শামিমা আব্দুর রাজ্জাকের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর স্বামীকে ডিভোর্স করেন। এরপর শায়লা শামিমা পাবনার বেড়া পারিবারিক আদালতে দেনমোহর ও খোরপোষের দাবিতে মামলা করেন। ওই মামলায় আংশিক ডিগ্রি হওয়ার কারণে পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি পেতে পাবনা জেলা জজ আদালতে আপিল মামলা করেন।

দ্বিতীয় স্ত্রীকে হুমকির অভিযোগ থানায়
সাবিনা আক্তার তার লিখিত অভিযোগে জানান, আদালতে মামলা করার পর আব্দুর রাজ্জাক তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা মো শাহাদত হোসেন খানকে মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। এসব কারণে ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সাবিনা আব্দুর রাজ্জাককে ডিভোর্স দেন। এসব কারণে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া মুক্তিযোদ্ধা বাবা শাহাদত হোসেন খান ২০১৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। এরপর বাবিনাকে অপহরণের হুমকি দেন আব্দুর রাজ্জাক। এই ঘটনায় থানায় অভিযোগও করেন সাবিনা আক্তার।

প্রকল্প পরিচালকের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে সাবিনা জানান আব্দুর রাজ্জাক তার বর্তমান স্বামীর কর্মস্থলে গিয়ে তার বিষয়ে কুৎসা রান এবং বর্তমান স্বামীকে হুমকি দেন সাবিনাকে তালক দেওয়ার জন্য। প্রকল্প পরিচালকের কাছে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন লিখিত অভিযোগে। সূত্র বাংলা ট্রিবিউন।