হেফাজতের দাবি ও আওয়ামী লীগের বক্তব্য

ডিসেম্বর ৯, ২০২০

কিন্তু দুধ আর কলা দিয়ে পোষা সাপ তো এখন বড় হয়েছে। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশোধ অন্যদিকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ইন্ধন। সেইসঙ্গে জামায়াতের সার্বিক সহযোগিতা, রাষ্ট্র ও প্রশাসন যন্ত্রের প্রচ্ছন্ন ইতিবাচক ইশারা তো আছেই। সব মিলিয়ে হেফাজত বসে থাকার নয়। ইস্যুভিত্তিক শক্তির জানান দেওয়ার প্রস্তুতি তাদের মধ্যে। তাইতো একটু সময় নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ফের মাঠে নামে। আবারো পিছু হটে। তবে সামনের দিনগুলোতে তারা আর পিছু হটবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন বা শঙ্কা থেকেই যায়।

  • রাজন ভট্টাচার্য

উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী হেফাজতে ইসলাম। যাদের জন্ম যুদ্ধপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতের আঁতুর ঘর থেকে। রাজনৈতিক কারণে হঠাৎ করেই সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দেশের সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই সংগঠনটি। এর নেপথ্যে রয়েছে সরকারের প্রচ্ছন্ন ছায়া। মূলত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকেই হেফাজতকে তোষণ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তবে ১৪দল এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধ। শরিক নেতাদের হেফাজতবিরোধী বক্তব্য থেকেই বিষয়টি একেবারেই পরিস্কার হয়েছে অনেক আগে থেকেই।

প্রশ্ন হলো—এত আপোসকামীতার পরও হেফাজত কেন শেষ পর্যন্ত জাতির জনকের জন্মশতবর্ষের কর্মসূচীর মধ্যে বেপরোয়া আচরণ করছে। রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে। দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে হুঁঙ্কার দিচ্ছে। অন্য ধর্মের উপর চওড়া হচ্ছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কঠোর মনোভাব স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ একেবারেই কৌশলী অবস্থান।

মনে আছে ২০১৩ সালের পাঁচ মে শাপলা চত্বর সহ গোটা মতিঝিল এলাকা এমনকি ঢাকা মহানগরী ঘেরাও করেছিল হেফাজত। দিনভর তাদের তাণ্ডব লিলা দেখেছিল বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বের মানুষ। হটাত করেই সংগঠনটি এত মানুষ কোথায় পেল। ৫০ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসা ও গ্রামের সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের জনবলের উৎস। এ থেকে প্রমাণ হয় কওমি মাদ্রাসায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যাদের একটি বড় অংশ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে তারা এত বড় শক্তির জানান দিয়েছিল। অথচ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুই টের পায়নি? এখানেই শেষ ছিল না সবকিছু। 

হেফাজতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে সংস্কার এনেছিল সরকার। এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনের দাবির মুখে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের সড়কে ‘লালনের ভাস্কর্য’ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। বিমান বাহিনীর অফিসের সামনে ‘ডলফিন’ ভাস্কর্যে হামলা, মতিঝিলে বলাকা ভবনের সামনে ‘বলাকা’ ভাস্কর্যে হামলার কথা কারো ভুলে যাবার কথা নয়। আরেকটি ঘটনা ছিল সবচেয়ে আলোচিত সেটি হলো— সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য হেফাজতের দাবির মুখে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। দেশের বিভিন্নস্থানে শহীদ মিনার সহ মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনার উপর হামলার ঘটনাও কারো ভুলে যাবার কথা নয়।

একের পর এক রাষ্ট্র, সংবিধান ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান নেওয়ার পরও সরকার তাদের মোটিভ ধরতে পারেনি। এটা অবিশ্বাস্য। পেরেছিল ঠিকই। কিন্তু সময়ের কারণে তারা এত বড় মরণ কাঁমড় বসাবে এটা হয়ত স্বাভাবিক চিন্তায় আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আসেনি। এটা তো সত্য যে যতোই হেফাজতকে এক ছাতার নীচে রাখার চেষ্টা হোক; তারা কি কখনও আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলকে ভোট দেবে? মোটেও না। এটা তাদের নীতি ও আদর্শের বাইরে।

কিন্তু দুধ আর কলা দিয়ে পোষা সাপ তো এখন বড় হয়েছে। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশোধ অন্যদিকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ইন্ধন। সেইসঙ্গে জামায়াতের সার্বিক সহযোগিতা, রাষ্ট্র ও প্রশাসন যন্ত্রের প্রচ্ছন্ন ইতিবাচক ইশারা তো আছেই। সব মিলিয়ে হেফাজত বসে থাকার নয়। ইস্যুভিত্তিক শক্তির জানান দেওয়ার প্রস্তুতি তাদের মধ্যে। তাইতো একটু সময় নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ফের মাঠে নামে। আবারো পিছু হটে। তবে সামনের দিনগুলোতে তারা আর পিছু হটবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন বা শঙ্কা থেকেই যায়।

দেশ বা বিদেশে হেফাজতের অবস্থান বা তারা কি চায় এ বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট।  মিমাংসিত। আওয়ামী লীগের একটি অংশ ক্ষমতার প্রয়োজনে হেফাজতকে কোলে তুলে নিলেও দেশের প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধিচর্চার মানুষ কিন্তু তাদের মোটেও গ্রহণ করেনি। অনেকে একেবারেই ঘৃনার চোখে দেখেন তাদের। শেষ কথা হলো যার কাছে যাকে ভালোলাগে। তবে কি ভালো মন্দের বিচার বিশ্লেষণ কিছুই থাকবে না?

ডিসেম্বর। বিজয়ের মাস। এ মাসকে সামনে রেখেই হেফাজত প্রকাশ্যে রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধীতায় নেমেছে। পুলিশের অনুমতি ছাড়াই করোনার ঊর্ধগতির মধ্যে সমাবেশ করে হুঁঙ্কার ছেড়েছে। ‘ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে তা টেনে হিঁচড়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে’। এখানেই শেষ নয় মুমিনুল ও বাবুনগরীরা একসুরে বলেছে, মসজিদের নগরীতে ভাস্কর্য এবং মূর্তি থাকতে পারবে না। এমনি দেশেও নয়!

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংগঠন হেফাজতের বক্তব্যের পর কি বলছে ক্ষমতাসীন দল। এ নিয়ে দৃষ্টি ছিল সবার। যা বলছে তা আরো বিতর্কিত এমনকি বিপজ্জনকও বটে! আরেকটি বাড়িয়ে যদি বলা যায় আত্মঘাতি বক্তব্য দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা স্পস্টভাবেই বারবার বলছেন, ‘ভাস্কর্য এর মূর্তি এক নয়’! তার মানে কি। ভাস্কর্য ভাঙা যাবে না- আর মূর্তি ভাঙা যাবে! না বোঝে আওয়ামী লীগ কতোবড় সর্বনাশের পথে পাঁ দিয়েছে এ নিয়ে কেউ ভাবছেন কিনা জানিনা। যদি তাই হয় সামনের দিনগুলোতে হেফাজতের দাবি হবে একটি। তা হলো দেশে কোন মূর্তি থাকবে না। বা রাখা যাবে না। অন্য ধর্মের মানুষ কোন ভাবেই ধর্মচর্চা করতে পারবেন না। তখন কি হবে?

অথচ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যুক্তি দিয়ে অনেক কিছুই বলার ছিল। প্রথমেই বলা যায়-ভাস্কর্য হল একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্মারক। তুরস্ক, আরব, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, আলজেরিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতেও ভাস্কর্য রয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তাদের জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণ করে এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তাই আমাদের দেশে ভাস্কর্য নির্মাণ অবৈধ কিছু নয়।

তাছাড়া মূতি বা প্রতিমা হলো অন্য ধর্মের বিষয়। দেশের সংবিধান অন্য ধর্ম চর্চার বৈধতা দিয়েছে। তারা রাষ্ট্রের নাগরিক। সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম চর্চা এদেশে বৈধ। সবার সমান সুবিধা ও স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ রয়েছে। কোনো মানুষের ধর্ম চর্চা ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় বাঁধা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া একেবারেই সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। প্রতিমা/মূর্তি সঙ্গে রয়েছে পারলৌকিকতার সম্পর্ক। ভাস্কর্যে সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ইহজাগতিকতার। তার মানে এই নয় যে প্রতিমা নাজায়েজ আর ভাস্কর্য জায়েজ- এখানে কোনো ধরনের তুলনা গ্রহণযোগ্য নয়।

তাছাড়া কেউ যদি প্রতিমা ভাঙচুর করে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এসব বিষয় তুলে ধরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য দিতে দেখা যায় না। তারা কেনো দেন না এ প্রশ্ন আমার মতো হয়ত অনেকের।

কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র জাসদ (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন) থেকে শুরু করে অন্যরা হেফাজতের কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধীতার পাশাপাশি তাদের দাবির বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। এমনি হেফাজতীদের গ্রেফতারেও দাবি জানানো হচ্ছে। সিপিবি, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক ৬০টি সংগঠন একযোগে হেফাজতরিরোধী আন্দোলনে নেমেছে। এখন দেশের ৬৪ জেলায় হেফাজতের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হচ্ছে। সোচ্চার দেশের মানুষ। মিছিল আর শ্লোগানে উত্তাল দেশ।

যেমন ২০০১ সালে রাজনৈতিক সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সব মহল রাস্তায় নেমেছিল। অথচ ক্ষমতাসীন দলের দোদুল্যমান অবস্থানের কারণে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি দেখাতে পারছে না। যা গোটা জাতির জন্য দুঃখজনক। যারা নামছেন তারা দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যাল নিয়ে নয়। নিজেদের মনে জমা হওয়া যন্ত্রণা থেকে হেফাজতের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে আওয়ামী লীগের এমন অবস্থান কি মিত্র দলগুলোর মধ্যে ফাঁটল সৃষ্টি করতে পারে না। হয়ত পারে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষের মনে কষ্টের রেখাপাত করা খুবই স্বাভাবিক।

লেখক:- সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক জনকণ্ঠ।