তুমি কি আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি

জুন ১৫, ২০২০

বিমান যখন আকাশে উড়াল দিলো; আমি খাঁচা থেকে পালিয়ে আসা পাখির আনন্দ পেলাম। দেশের জন্য মন খারাপ হলো; কিন্তু এদেশে আমি সামান্য প্রজা; একে ভালোবাসার অধিকার আমার নেই। আমি যে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির কারোরই সহমত ভাই নই। এই দেশ ওদের উপনিবেশ আর আমি যেন ওদের দাস। নাকে খত দিয়ে জার্মানি পালিয়ে গেলাম।

শাহবাগের গণজাগরণ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। এই তারিখে মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো বাংলাদেশের তরুণেরা ন্যায়বিচারের দাবিতে পথে নেমেছিলো। এতোকাল একাত্তরের ঘাতকদের ক্ষমতা কাঠামোর দায়মুক্তি দিয়ে মোটাতাজা করা হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিএনপি-জামায়াত আমলে।

২০০১ সালে আমার সিভিল সার্ভিসের শেষ দিনগুলোতে; বিটিভিতে দায়িত্বপালন কালে সংসদ নির্বাচনি বক্তৃতা রেকর্ডিং-এর সময় শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া-এরশাদ-নিজামি এরকম হেভিওয়েট নেতাদের নির্বাচনি বক্তৃতা দেখে সেখানে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে কীনা; সেটা যাচাই করার কাজটুকু আমাকে দেয়া হয়েছিলো। উল্লেখ্য যে এই নেতারা সবাই তাদের বক্তৃতার স্ক্রিপ্টে টুকুটাক পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে নেন।

সেইখানে নিজামির বক্তৃতা রেকর্ডের সময়; একাত্তরের ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছিলো’। সিভিল সার্ভিসের একজন নবীন কর্মকর্তার এই বে-আইনি বক্তৃতা বন্ধ করার সামর্থ্য ছিলো না। সে ক্ষমতা আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয়েরও ছিলো না। আমি চেহারার প্রতিক্রিয়া লুকাতে না পারায়; একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, গণতন্ত্রে সব মত আর পথই কথা বলবে; মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে তোমার দায়িত্ব সবার বক্তব্য প্রচারকে ফ্যাসিলিটেট করা।

এই নির্বাচনে নির্বাচনি ফলাফল সমন্বয় করে বাংলাদেশ বেতারে প্রচারের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়। এসময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে কান কথা লাগায়; বাংলাদেশ বেতারের স্বঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চেকপোস্টের লোকেরা। তারা কলাবাগানে এক হাতির নেতার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেয়, মাসকুয়াত (শুদ্ধ উচ্চারণে মাসকাওয়াথ বলতে না পারায়)-কে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হোক। চেতনার পত্রিকার কলার পাতায় সে খবর ছাপা হয়। আমি এ খবর পড়ে অবাক হই। পুরো আওয়ামী লীগ শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভিউ করলো, বধ্যভূমি নিয়ে রেডিও ডকুমেন্টারি করলো যে কর্মকর্তা; তাকে দুই ইঞ্চি চিন্তার দেশ চেতনার চেকপোস্টের দালালেরা গান্ধা কইরা দিতে চেষ্টা করলো এভাবে! এরকম ঘটনা সিভিল সার্ভিসে অনেক ঘটেছে। অনেক কর্মকর্তাকে এভাবে গান্ধা করে দিয়েছে খালা ও মামীর কানকথার লোকজ আসরের চুলবুলিতে।

বাংলাদেশ বেতারের শীর্ষ পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা বললেন, কিছু লোক কিছু কথা বলবেই। তোমাকে নিয়ে এই আপত্তি বরং বিএনপি তুলতে পারতো; যেহেতু তোমাকে টিভি স্ক্রিণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুসন্ধানী অনুষ্ঠানে দেখা গেছে; ভোরের কাগজে তোমার ‘বিষণ্ণতার শহর’ সিরিজের ছোট গল্পে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ আছে; এমনকী শেখ হাসিনার সঙ্গে মেগা শো ‘জনগণের প্রশ্নঃ প্রধানমন্ত্রীর উত্তর’ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছো তুমি। কারো কথায় কান না দিয়ে নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করো; যা দেখবে তা পরে লিখতে পারবে।

এই নির্বাচন আমি খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। ক্ষমতার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগকে উড়িয়ে দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছিলো। মধ্যরাত পর্যন্ত যে ফলাফল আসে তাতে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ছিলো। মধ্যরাতের পর ফলাফল আসা বন্ধ হয়ে যায়। এসময় রিটার্নিং অফিসাররা বিএনপির জন্য ক্ষমতার প্রসাদ সাজাতে থাকে। এরপর শেষ রাতের দিকে যখন ফলাফল আসতে শুরু করে; তখন বিভিন্ন কেন্দ্রে এগিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের ঘরে আকাশ-কুসুম সব নিম্ন সংখ্যা আসতে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় বিএনপি ৩০০ আসনই যেন পাবে। এরপর নির্বাচন ফলাফল কবিদের কাব্যকলায় একটু হুঁশ ফিরলে ৩০টি আসন আওয়ামী লীগকে ছেড়ে দেয়া হয়। আমি যেহেতু প্রতিটি আসনের দিকে সাঁঝ থেকে খেয়াল রাখছিলাম; তাই অবাক হয়ে দেখলাম, অনেক পিছিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জিতিয়ে দিয়ে; সংসদে কথা বলতে পারবে না এই ভরসায়; এমন কিছু প্রার্থীকে ঐ ৩০টি আসনের কিছু দেয়া হয়।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলো; ফলে কিছুটা ভোট কমেছে; এই ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর হিসেব করলেও আওয়ামী লীগ কমপক্ষে ১০০টি আসন পাবার মতো ফলাফল করেছিলো ভোটের দিন মধ্যরাত অবধি ফলাফলে। কিন্তু কয়েক ঘন্টার বিরতি নিয়ে কেয়ারটেকার সরকার গণতন্ত্রকে জীবন্মৃত করে ‘সর্বনাশা’ এক নির্বাচনী ফলাফল প্রসব করে।

পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ এর নির্বাচন, বাংলাদেশ আমলে ১৯৯১ সালের নির্বাচন আর ১৯৯৬-এর নির্বাচন ইতিহাসের তিনটি সুষ্ঠু নির্বাচন; যেখানে জনমত প্রতিফলিত হয়েছে। তা বাদে বাকি সব নির্বাচনই সেনাবাহিনী রাজি হলে; সিভিল প্রশাসন পছন্দসই ফলাফল রচনার ধাপ্পাবাজির নির্বাচন। জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গণতন্ত্রকে ধর্ষণ ও হত্যার নির্বাচনি ফলাফল।

২০০১-এর সেই প্রতারিত ভোরের দিকে ফলাফল ঘোষণার বুথের চারপাশে ভিড় করে থাকা বিএনপির সহমত ভাইয়েরা বুনো ষাঁড়ের মতো উল্লাসে বুথে ঢুকে পড়ে। প্রত্যেক নির্বাচনী ফলাফলের পরেই জিতে যাওয়া আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বেনিফিশিয়ারি কোলাবরেটরেরা এইরকম বুনো উল্লাস করে। কারণ দেশ লুন্ঠনের ম্যান্ডেট পেয়েছে; এখন ধনী হবার; বিদেশে টাকা পাচারের, সেকেন্ড হোম বানানো; বাড়ি গাড়ি ভুড়ি বাগিয়ে ক্ষমতার হারেমে পিউ-পাপিয়ার বাইজি নাচানো; দেশ নিয়ে জুয়া খেলা, হত্যা-ধর্ষণ-লুন্ঠন-ক্রসফায়ারের লাইসেন্স পেয়ে গেলে সে উল্লাস তো ম্যাটাডোরের বুঁদ ষাঁড়ের মতো দৌড়ে আসা নৃশংসতার উল্লাস হবেই।

নির্বাচনি ফলাফলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখে; আমি বিষণ্ণতা নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন পাশে বসা বাংলাদেশ বেতারের জাতীয় বেতার ভবনের সংবাদ বিভাগের প্রধান আমার কাঁধে হাত রেখে কিছুটা রস ছড়াতে বললেন, পত্রিকায় তোমাকে নিয়ে ছোড়া গোবরটাই তো এখন দেখছি কাজে লাইগা গেলো। মন খারাপ করোনা; ক্ষমতা খুব নোংরা জিনিস; এটা আঁকড়ে ধরতে গোবর লেপা নির্বাচনি ফলাফলই এদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস।

‘তুমি আওয়ামী লীগ নাকি তুমি বিএনপি’ এরকম অনৈতিক অনধিকার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে যাতে আর না হতে হয়; আমি যেন কলতলার লিলিপুটদের গান্ধা কইরা দেবার লা গোবরিনা ফেস্ট-এর বাইরে আমার আনন্দময় সৃজনশীলতার জগত তৈরি করতে পারি; সে প্রত্যয়ে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিদেশে চাকরি করলে একজন মানুষ দেশের জন্য রেমিটেন্স উপার্জন করে; তাই সিভিল সার্ভিস রুলে ছুটি বা লিয়েন নিয়ে বিদেশে কাজ করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

কিন্তু মগের মুল্লুকে কীসের আইন; কীসের সার্ভিস রুল; এবার বাংলাদেশ বেতারের বিএনপির সহমত ভাইয়েরা আমার ছুটির আবেদন আটকে দেয়। ২০০২ সালের মার্চ থেকে জুলাই আমি বিএনপির নরক যন্ত্রণা ভোগ করি। কেন আমার জীবন যাত্রার মান আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, কেন আমি শেখ হাসিনার শো থেকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার হেভিওয়েট মন্ত্রীদের নিয়ে শ্রোতার মুখোমুখি মন্ত্রী সিরিজের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছি; সে প্রশ্ন নিয়ে আমার কাছে হাজির হন গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা। তারাই খোঁজ নিয়ে পেয়েছে রাজশাহীর একজন অতীতের আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর দূর-সম্পর্কের আত্মীয় আমি। তারা এটাও জেনেছে রাজশাহীর সাবেক এক বিএনপির মন্ত্রীরও দূর সম্পর্কের আত্মীয় আমি; তাহলে আমি কী আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি।

আমি তাদের বোঝালাম, আমি একজন মানুষ; আল্লাহ আমাকে মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে জন্ম দিয়েছেন। দেশকে ভালোবেসেই সিভিল সার্ভিসে এসেছি। জীবনে আমি আনন্দ আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু খুঁজি না; টেকাটুকার আনন্দ কী এ আমি বুঝি না; বুঝতে চাইও না।

সিভিল সার্ভিসের বড় ভাইয়েরা পুনঃ পুনঃ সার্ভিস রুল দিয়ে চ্যালেঞ্জ করে; এই ছুটি আমার প্রাধিকার এটা বার বার বলে আমাকে ছুটির মুক্তিসনদ জোগাড় করে দিলে ভয়ে ভয়ে বিমানবন্দরের দিকে যাই। ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ ছবির পিয়ানো বাদক যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাতসির ভয়ে ভয়ে কুঞ্চিত হয়ে হাঁটতো; বিমান বন্দরে আমি ঠিক সেরকম অসহায়ত্বে হাঁটি। এদেশের আমি যেন কেউ নেই, এদেশে আমার প্রপিতামহের
সততা আর আন্তরিকতার শ্রম ঘাম, আমার আব্বা-আম্মার সারাজীবন ছাত্র পড়ানোর আনন্দ খোঁজার পরেও আমাকে প্রমাণ করতে হবে আমি কী আওয়ামী লীগ নাকী বিএনপি!

বিমান যখন আকাশে উড়াল দিলো; আমি খাঁচা থেকে পালিয়ে আসা পাখির আনন্দ পেলাম। দেশের জন্য মন খারাপ হলো; কিন্তু এদেশে আমি সামান্য প্রজা; একে ভালোবাসার অধিকার আমার নেই। আমি যে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির কারোরই সহমত ভাই নই। এই দেশ ওদের উপনিবেশ আর আমি যেন ওদের দাস। নাকে খত দিয়ে জার্মানি পালিয়ে গেলাম।

(চলবে)

মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক