ইউনিভার্সিটি অফ কমনসেন্সের ক্লাসরুমে একদিন

ডিসেম্বর ২১, ২০১৯

এক ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি অবশ্য শুরুতেই ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞেস করবো, ও ভাই আপনি কী আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি! এতোটা পথ ভিন্নমতের লোকের সঙ্গে যেতে পারবো না! আমার আবার দুই মিনিট পর পর “সহমত ভাই” না বললে শরীর খারাপ লাগে!

ইউনিভার্সিটি অফ কমনসেন্সে প্রতিদিনই ছাত্রের সংখ্যা বাড়ছে। নানান হাবিজাবি-হিজিবিজি ডিগ্রি নিয়েও আজকাল লাভ হচ্ছে না। চাকরির ইন্টারভিউ পর্বে কেউ নেপচুন গ্রহকে নেপালের রাজধানী বলছে তো; H20 কী প্রশ্নের উত্তরে বলছে, এই নামে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ চাকরির ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে প্রার্থীকে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জ্ঞান দিচ্ছে ‘নাসা গবেষণায় জানা গেছে, কেবল আশুরার রাতে উল্কাপতন হয় না।’

সুতরাং যার যে ডিগ্রিই থাকুক; ইউনিভার্সিটি অফ কমনসেন্স থেকে একটি ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে আসার নির্দেশ এসেছে। অমনি ঝাঁকে ঝাঁকে নানা বয়েসী লোক সান্ধ্যকালীন কোর্স করছে সেখানে।

ক্লাসের শুরুতেই শিক্ষক জিজ্ঞেস করে, ধরো ট্রেনে চড়ে কোথাও যাচ্ছো। পাশের সিটে বসে আছেন এক লোক। তার সঙ্গে কীভাবে আলোচনা শুরু করবে!

একজন উত্তর দেয়, প্রথমেই জিগামু, কই যাইতাছেন ভাই!

আরেকজন উত্তর দেয়, আমি জিগামু, ভাই কী সার্ভিস করেন, নাকি বেকার! যদি কয় চাকরি করে, জিগামু, স্যালারি কত পান! সিক্স ডিজিট আছেনি!

আরেকজন সহাস্যে উত্তর দেয়, ভাই কী বিবাহিত নাকি জীবিত! বাচ্চা কাচ্চা নিছেন! যদি কয়, বাচ্চা আছে। সম্পূরক প্রশ্ন করুম; বিবাহের ঠিক কত মাস পরে বাচ্চা নিলেন একটু ক্লিয়ার করবেন!

শিক্ষক জিজ্ঞেস করে, ধরো ভদ্রলোকের সঙ্গে একজন মহিলাও ভ্রমণ করছেন; সেক্ষেত্রে কী বলবে!

একজন উত্তর দেয়, জিগামু, ভাবীর পর্দা-পুসিদা নাই কেন! উনি সহি পোশাক পরেন নাই কেন!

— যদি সঙ্গের মহিলা স্ত্রী না হয়ে ছোট বোন হন সেক্ষেত্রে কী হবে!

–তাইলে তো আদর্শ; পুরা জার্নির সময়টা টাংকি মারুম; ভাব জমাইতে শুরু করুম। ফেসবুক আইডি খুইজা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠামু।

–সঙ্গের মহিলা যদি ভদ্রলোকের অফিস সহকর্মী হন; অফিসের কাজে যাচ্ছেন তারা!

–তাইলে তো জিগানো ফরজ; আপনেরা না-মেহরাম। একলগে সফর করতেছেন কেন!

ধরো মহিলা পর্দা পুসিদা করেই যাচ্ছেন; সেক্ষেত্রে কী বলবে!

আরেক ছাত্র উত্তর দেয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে; উনি কী সৌদি-সংস্কৃতি আমদানির চেষ্টা করছেন! এইটা চলবে না। আপনি কী পরবেন না পরবেন এইটা ঠিক করে দেবো আমরা।

এক ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি অবশ্য শুরুতেই ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞেস করবো, ও ভাই আপনি কী আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি! এতোটা পথ ভিন্নমতের লোকের সঙ্গে যেতে পারবো না! আমার আবার দুই মিনিট পর পর “সহমত ভাই” না বললে শরীর খারাপ লাগে!

আরেক ছাত্র বলে, সে কী মুসলমান নাকি বিধর্মী এইটা জাইনা নেয়া ফরজ।

শিক্ষক জিজ্ঞেস করে, ভদ্রলোক যদি কোন আলাপ জমাতে আগ্রহ না দেখান!

এক ছাত্র রেগে বলে, উঁহ এতো সহজ; আলাপ না কইরা যাবে কোথায়! সুশীল কইয়া ঝাড়ি দিমু।

আরেক ছাত্র বলে, আলাপ জমাইতে রাজি না হইলে বুইঝা নিতে হবে, এই লোক পাওয়ারফুল। তখন তারে তেল দিমু। তেলে গলে না এমন লোক লোক নাই। বার বার ‘স্যার’ ‘স্যার’ কমু। এইভাবে পইটা গেলে একটা চাকরি চামু!

এক ছাত্র বিজ্ঞের মতো বলে, ভদ্রলোকরে করা যায় এমন অনেক প্রশ্ন বাদ পইড়া গেছে। উনার দেশের বাড়ি কোথায় এইটা না জিগাইলে ক্যামনে হয়!

এবার শিক্ষক অত্যন্ত শান্তভাবে জিজ্ঞেস করে, যদি লোকটা ভিন্নমতের বা ভিন্নধর্মের হয়!

এক ছাত্র বলে, ভিন্নমতের লোকের চরিত্রহনন করাটাই ঐতিহ্য। সেইক্ষেত্রে ফেসবুকে উনার আইডি সার্চ কইরা উনার “বেডরুমের” রহস্য জানার চেষ্টা করতে হবে। উনার ফ্রেন্ডলিস্টের ঘনিষ্ট যারা; মানে কমেন্ট-টমেন্ট বেশি করে; তাগো ইনবক্সে গিয়া এই লোকের বেডরুমের খবর নিতে হবে। তারপর মুখের ওপর তারে ঝাইড়া দিতে হবে; যা আছে কপালে!

আরেক ছাত্র বলে, লোকটা ভিন্নধর্মের হইলে সিটটা চেঞ্জ কইরা নিতে হবে! সিট চেঞ্জ না করা গেলে ট্রেনের রেষ্টুরেন্ট থেকে বিফ কাটলেট এনে কৌশলে মাটন কাটলেট বইলা খাওয়াইয়া দিতে পারলেই বেহেশতের পাসপোর্ট কনফার্ম।

অন্য এক ছাত্র বলে, আমি তারে নিজ ধর্মে দাওয়াত দিবো!

এক অত্যন্ত পাকা টাইপের ছাত্র বলে, লোকটা উন্নয়নের শত্রু নাকি মিত্র সেইটা জাইনা নেয়া অত্যন্ত জরুরী। শত্রু হইলে ফুন কইরা সামনে কোন স্টেশানে “হেলমেট ভাই”-দের ডাইকা নিয়া পিটাইয়া দিতে হবে! উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন কম্প্রোমাইজ নাই।

আর সহযাত্রী যদি ভদ্রলোক না হয়ে ভদ্রমহিলা হোন; সেক্ষেত্রে কী হবে!

সবাই সমস্বরে বলে, তাইলে তো ঈদ হইয়া গেলো। পাশে বইসা নীরবে ঠেইলা ঠেইলা তার দিকে অগ্রসর হতে হবে; যদি হালকা একটু হাতের বা পায়ের স্পর্শ পাওয়া যায়; সেইটাই ক্বাফি। আর লুকাইয়া লুকাইয়া তারে দেখতে হবে। চোখ দুইটা মাছির মত উনার শরীরের নানান জায়গায় গিয়া বইসা আসবে। আনন্দই আনন্দ। অপেক্ষা করতে হবে মহিলা ঘুমাইছে কীনা! তখন হাতটা গিয়া–

শিক্ষক বলে, থাক থাক; আর বলতে হবে না। ব্যাপারটা ক্লিয়ার।

পেছন থেকে এক ছাত্র উঠে আসে হাতে হাতুড়ি নিয়ে, অনেক ক্লাস হইছে স্যার। এতো পুছার টাইম নাই। আমার কমনসেন্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটটা দেন। আমি যাইগা। আমরা জানি না; এমন কোন বিষয় নাই। অযথা উন্নয়নের শত্রুরা শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করে, এই “কমনসেন্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট”-এর ঝামেলা পাকাইছে।

শিক্ষক বলে, কোর্স শেষ না করে কোন সার্টিফিকেট নয়।

পেছন থেকে এক ছাত্র বলে, স্যার আপনারই তো কমনসেন্স নাই। দেখতেছেন আমরা সব অত্যন্ত সাকসেসফুল লোক; অনেকে পার্টি শার্ট পইরা চুলে জেল দিয়া আসছি। বাইরে গাড়ি-বাইক সবারই আছে। আপ্নেরে দেখলাম রিক্সা থিকা নামতে। যে কমনসেন্স দিয়া আজ পর্যন্ত একটা গাড়ি কিনতে পারলেন না; ঐডা আমগো দরকার নাই।