লড়াকু মানবিক ভারতকে অভিবাদন
ডিসেম্বর ২০, ২০১৯ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভারতে সুশাসন ও সামাজিক সুবিচার না থাকায় শিক্ষার মান সেখানেও কমেছে। শিক্ষার মান দুর্বল হলে ওই শিক্ষা-ব্যবস্থার মাঝ দিয়ে অনগ্রসর চিন্তার মেরুদণ্ডহীন মানুষ বেরিয়ে আসে। অনগ্রসর চিন্তার মানুষ খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়। সবসময় ‘ওই আমার ভাগটা খেয়ে নিলোরে’, ‘ওই আমার উপার্জনটা নিয়ে নিলোরে’ এইরকম একটা অমূলক ভীতি বা প্যারানয়া কাজ করে তাদের মাঝে।
কলকাতা সম্পর্কে একটা মিথ সব সময়ই কানে এসেছে; ওখানকার মানুষ খুব হিসেবি। একটা কৌতুক শোনা যায়, একটা সিঙ্গারা খেতে দিয়ে হোস্ট বলেন, পুরোটাই খেয়ে যাবেন। কৌতুক বলে অতিরঞ্জিত কথন হলেও একথা ঠিক যে কলকাতার মানুষ মিতব্যয়ী।
কেন এই মিতব্যয়! এর কারণ হচ্ছে কলকাতার মানুষ সৎ ভাবে উপার্জন করে সারাজীবন আত্মনির্ভর সময় কাটাতে চান। রাষ্ট্রক্ষমতা বা রাজ্যক্ষমতায় যেই থাকুক তাতে সকাল দুপুর রাতের খাবারের পাতে যতটুকু খাদ্য প্রয়োজন তাতে পার্থক্য ঘটবে না । বাহুল্য খরচ কিংবা বড়লোকি দেখাতে গিয়ে আত্মনির্ভর বেঁচে থাকার কৌশলটি হারাতে চাননা কেউ।
এতে নাগরিক সমাজটি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে। দল-নিরপেক্ষ দেশ ও মানবপ্রেমের শক্তি আছে বলেই; কলকাতার নাগরিক সমাজে সতত সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। মুখ বুঁজে কোন অন্যায় মেনে নেবার পাত্র তারা নন।
একারণেই মোদি সরকারের নাগরিক আইন সংশোধনের প্রতিবাদে কলকাতা উত্তাল। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের এই শক্ত মেরুদণ্ড ক্রমে কলকাতার মেরুদণ্ডটি তৈরি করেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভণ্ড দেশপ্রেমিক উগ্রজাতীয়তাবাদীদের সমালোচনায় সোচ্চার ছিলেন; কোন কথাটা বললে কে গোস্বা হবে এসব ভাবার সময় তার ছিলো না। সত্যজিৎ রায় তার ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রে রাষ্ট্র-ক্ষমতার স্বৈরাচারি চরিত্রকে উপহাসে জর্জরিত করেছেন। রায় তার শিল্পের চাবুকে চাবকে শোষক শ্রেণীটিকে হুঁশে ফেরাতে চেষ্টা করেছেন।
এই ধারাবাহিকতায় এ যুগে এসেও কবি শ্রীজাত বা বক্তা চন্দ্রিলের মতো কলকাতার নাগরিককে আমরা দেখতে পাই; ‘তবে’ ‘কিন্তু’ না করে সোজা সাপটা মানুষ ও সভ্যতার পক্ষে কথা বলেন তারা। ‘সত্য’ কথা বলার পরিণতি কী হবে এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিৎ যেমন ভাবেননি, এ যুগেরও শ্রীজাত-চন্দ্রিলেরাও ভাবেন না।
পৃথিবীর যে কোন জায়গায় চিন্তায় অগ্রসর ও অনগ্রসর দুই রকমের মানুষ থাকে। কলকাতাতেও চিন্তায় অনগ্রসর মানুষ আছে। কিন্তু এই চিন্তায় অনগ্রসর মানুষ; যাদের সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্রে নিখুঁতভাবে দেখিয়েছেন; তারা কলকাতার প্রতিনিধিত্বশীল নয়।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভারতে সুশাসন ও সামাজিক সুবিচার না থাকায় শিক্ষার মান সেখানেও কমেছে। শিক্ষার মান দুর্বল হলে ওই শিক্ষা-ব্যবস্থার মাঝ দিয়ে অনগ্রসর চিন্তার অমেরুদণ্ডী মানুষ বেরিয়ে আসে। অনগ্রসর চিন্তার মানুষ খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়। সবসময় ‘ওই আমার ভাগটা খেয়ে নিলোর ‘, ‘ওই আমার উপার্জনটা নিয়ে নিলোরে’ এইরকম একটা অমূলক ভীতি বা প্যারানয়া কাজ করে তাদের মাঝে।
ভারতের নাগরিক আইন সংশোধনকাণ্ড এরকম প্যারানয়াগ্রস্ত লোকেদের মস্তিষ্কপ্রসূত। জার্মানিতে নাৎসি উত্থান ঘটেছিলো , ‘ওই ইহুদিরা সব খেয়ে নিলোরে’, ‘ঐ ইহুদিরা উপার্জন কেড়ে নিলোরে’ এরকম চিন্তা থেকে।
আসলে তো তা নয়। জার্মানির চিন্তা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের জগতটিকে সমৃদ্ধ করেছিলো ইহুদিরা। নাৎসিদের প্যারানয়াগ্রস্ত সহিংসতায় ‘জেনোসাইড’ ঘটে যাওয়ায় ইহুদি বুদ্ধিজীবীরা বাধ্য হয়ে এমেরিকায় পালিয়ে যাওয়ায়; জার্মানির বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে শূণ্যতা তৈরি হয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে এমেরিকার শিল্প-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-দর্শনের জগতটি। যে জার্মানি ‘এক্সপ্রেশনিজম’ চলচ্চিত্র আন্দোলনের পীঠস্থান ছিলো; সেখানে আজ চলচ্চিত্র জগত বলে আর কিছু নেই। জার্মান এক্সপ্রেশনিজম-এর কলাকৈবল্য উজ্জ্বল করেছে ‘হলিউড’ চলচ্চিত্র জগতকে। উপকৃত হয়েছে অ্যামেরিকা।
ইতিহাস থেকে চিন্তার জগতে অনগ্রসর মানুষেরা শিক্ষা নেয় না বলে; বার বার তারা ইতিহাসের কৃষ্ণগহবরে পড়ে যায়। ভারতের নরেন্দ্র মোদি ও তার সহযোগীরা জার্মানির সেই নাৎসি পদাংক অনুসরণ করে যে অন্ধকারের পথে পা বাড়িয়েছে; তা আত্মবিনাশী; এটা বোঝার বোধ-বুদ্ধি কট্টর হিন্দুত্ববাদি নিও নাৎসিদের আছে বলে মনে হয় না।
কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা নাগরিক সমাজ জীবনের পরোয়া না করে বৈষম্যমূলক সংশোধিত নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জারি রেখেছেন। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর লড়াইয়ে কে বিজয়ী হবে আমরা তা জানি না। কিন্তু এই লড়াইয়ে উচ্চকিত মানবিক ভারতের সাহসী মানুষদের প্রতি অভিবাদন জানাই।
- মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক
You must be logged in to post a comment.