রাজনীতিতে গন্ডারপন্থার উত্থান

ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯

দেশের এই ‘সম্মান’-এর খনি ধরে রাখতেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে দক্ষিণ এশিয়দের একটি বড় অংশ ট্রাম্প ও বরিসকে ভোট দিয়েছে। কারণ এই দুটি লোক অভিবাসন আইনকে এমন টাইট দিয়ে দেবে যে; দক্ষিণ এশিয়ার লোক আর এসব দেশে আসতে পারবে না।

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয় অভিবাসীদের মাঝে উদারপন্থী যারা; তারা হাতে গোণা কিছু মানুষ। রোমান্টিক সেক্যুলার তারা। একটু পড়াশোনা-ভালো ছবি দেখার বাতিক আছে। ‘সমাজতন্ত্রে’-র স্বপ্নভঙ্গ শেষে সামাজিক গণতন্ত্রী হিসেবে সহজাতভাবেই তারা উদারপন্থী দলের সমর্থক।

দক্ষিণ এশিয়া থেকে যারা যুক্তরাজ্যে অভিবাসী হয়েছে; তাদের একটি বড় অংশ এখন সেখানকার রক্ষণশীল দলের ভোট-ব্যাংক। অতীতে প্রথম প্রথম সেখানে গিয়ে অভিবাসী দক্ষিণ এশিয়রা উদারপন্থী দলকে সমর্থন করতো। দেশের রক্ষণশীল বিদেশে উদারপন্থী -এ নিয়ে অনেক কৌতুকও প্রচলিত আছে। কিন্তু বিলেতে নিজের পায়ের নীচের মাটি একটু শক্ত হতেই; তারা ফিরে যায় আদি এবং অকৃত্রিম ঠিকানায়; রক্ষণশীলতা।

দক্ষিণ এশিয়ার লোক বিলেতে গিয়ে ভাগ্য বদলেছে; ফেলে আসা দক্ষিণ এশিয়ার লোক যেন আর বিলেতে যেতে না পারে;এটা নিশ্চিত করতে তারা কঠোর অভিবাসন আইনের পক্ষে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ব্যক্তিগত সাফল্য যেহেতু অন্যের সঙ্গে তুলনামূলক; তাই সে চায় না; দক্ষিণ এশিয়ার আরো মানুষ বিলেতে এসে তার কথিত সাফল্যের এভারেস্ট স্পর্শ করুক। এতে নিজ গ্রামে বেড়াতে গেলে তার বিশিষ্টতা ও সম্মানের মাত্রা বেশ কমে যাবে।

এই শ্রদ্ধা ও সম্মানের ‘আকুতি’ দক্ষিণ এশিয়দের মাঝে প্রবল। এ নিয়ে পশ্চিমাদের কোন মাথা-ব্যথা চোখে পড়ে না। তারা সবার সঙ্গে একই রকম আচরণ করে। দক্ষিণ এশিয়দের কাছে আবার এটা অনেক বড় ব্যাপার।

অনাবাসে এক বয়েসি ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো; উনি খুব সুন্দর থ্রি পিস স্যুট পরে বুক পকেটে ফুল লাগিয়ে বিকেল বেলা সিটি সেন্টার ঘুরতে আসতেন। কিন্তু মুখমণ্ডলে একটা মন খারাপের ভাব ফুটে থাকতো। তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার ছেলে-মেয়ে প্রতিষ্ঠিত, ফুরফুরে জীবন আপনার; আনন্দে থাকুন; এতো মন খারাপের কী আছে।

উনি গম্ভীর হয়ে বললেন, দেশে গেলে অনেক মান-সম্মান পাই। বিদেশে কোন সম্মান নাই।

দেশের এই ‘সম্মান’-এর খনি ধরে রাখতেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে দক্ষিণ এশিয়দের একটি বড় অংশ ট্রাম্প ও বরিসকে ভোট দিয়েছে। কারণ এই দুটি লোক অভিবাসন আইনকে এমন টাইট দিয়ে দেবে যে; দক্ষিণ এশিয়ার লোক আর এসব দেশে আসতে পারবে না।

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয় অভিবাসীদের মাঝে উদারপন্থী যারা; তারা হাতে গোণা কিছু মানুষ। রোমান্টিক সেক্যুলার তারা। একটু পড়াশোনা-ভালো ছবি দেখার বাতিক আছে। ‘সমাজতন্ত্রে’-র স্বপ্নভঙ্গ শেষে সামাজিক গণতন্ত্রী হিসেবে সহজাতভাবেই তারা উদারপন্থী দলের সমর্থক।

বলাবাহুল্য ট্রাম্প আর বরিস জনসনের মাঝে দক্ষিণ এশিয় গড়পড়তা রাজনৈতিক নেতাদের ছায়া আছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়দের বড় একটি ভোটব্যাংক তাদের ভক্ত। দক্ষিণ এশিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেভাবে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করেছে; তাতে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ প্রবণতা সেখানকার রাজনীতি ও সমাজে দৃশ্যমান হবে মনে হচ্ছে।

ট্রাম্প ও বরিস একটু অগ্রসর চিন্তার সমাজে উপহাসের পাত্র। যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দক্ষিণ এশিয় অভিবাসীরা তাদের মাঝে দক্ষিণ এশিয়া স্টাইল ‘শ্রদ্ধা’ ও ‘সম্মান’ লাভের আকুতি জাগিয়ে তুলবে এটা সুনিশ্চিত। ‘সহমত ভাই’ ও ‘স্যার’ কালচার অচিরেই দৃশ্যমান হবে সেখানে। কারণ নেতাকে তেল দেয়ার যে তৈলসূত্র দক্ষিণ এশিয়দের জানা আছে; তা ‘বিফলে মূল্যফেরত’।

ভোর বেলা বরিসের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে কলাটা-মূলোটা নিয়ে হাজির হয়ে ঠিকই দক্ষিণ এশিয় রক্ষণশীলরা সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হবে কনজারভেটিভ পার্টিতে। বরিসের বাবা-মায়ের সমাধি খুঁজে বের করে, দক্ষিণ এশিয় বরিস ভক্তেরা সেখানে অশ্রুসিক্ত নয়নে পুষ্পস্তবক অর্পণের ছবি তুললে; বরিসের উপায় থাকবে না; এদের
যুক্তরাজ্যের নানা প্রতিষ্ঠানে ‘সরকারি বালিশ বা জানালার পর্দা সরবরাহের’ ঠিকাদারি না দিয়ে।

বরিস শুধু একাই নয়; তার রক্ষণশীলের দলের অধিকাংশ নেতাই নেতা; কিন্তু বৃটেনের একটু চিন্তায় অগ্রসর মূলধারার সমাজে উপেক্ষিত। তাদের সঙ্গে সেলফি তুলে দক্ষিণ এশিয়রা তাদের বুঝিয়ে দেবে ‘বি কেয়ারফুল; তারা ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট।’

কিন্তু এর মানে কী এই ভোটে পরাজিত উদারপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ নয়! এই প্রশ্নের উত্তর রক্ষণশীল অভিবাসী দক্ষিণ এশিয়দের স্কুল-পড়ুয়া শিশুদের কাছে আছে। যে শিশুর বাবা বিলেতে এসে জীবন-যুদ্ধ করেছেন; দেশ ছাড়ার বেদনা ভুলতে যাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে হয়েছে দেশের প্রাচীন-সংস্কারগুলো; যার ইনফেরিওরিটি ঢাকতে ‘কনজারভেটিভ’ দলের ভোটার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আরো অভিবাসী আসাটা ঠেকাতে হবে; এইভাবে তাকে ‘সুপিরিয়র’ থাকতে হবে ফেলে আসা দক্ষিণ এশিয় গ্রামে। দারিদ্র্য-বঞ্চনা-জীবন সংগ্রাম তাদেরকে সরল মানুষ থেকে জটিল মানুষ করে তুলেছে।

কিন্তু তাদের সন্তানরা মোটামুটি সুন্দর একটি জীবন পেয়েছে; পড়ালেখা-সংগীত-চলচ্চিত্র-ভিডিও গেমস এগুলো তাদের নিত্যসংগী। খুব বেসিক জীবনের টানাপোড়েন তাদের নেই; তাই তারা বেসিক জীবনের ইনফেরিওরিটি বুঝতে পারে না। জীবনের গভীরের জীবন খোঁজে তারা। অভাবনীয় সুন্দর এই শিশু-কিশোরদের মন।

যে কোন সম্মিলনীতে কে বড় গাড়িতে এলো; কে বাইকে এলো, কে ট্রামে এলো এসব তার বাবা-মা’র চিন্তা। কিন্তু নবীন কিশোরের একটাই ভাবনা, বন্ধু এলো।

যে কোন রাষ্ট্রের সরকারি কাজগুলো সাধারণতঃ প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত ও ধনবানেরা করে থাকে। এমনকি বৃটিশরা তাদের উপনিবেশ চালাতে এদেরকেই নিয়ে আসতো। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত ও ধনবানদের ‘দেখিয়ে দেয়া’ ও ‘তাক লাগিয়ে’ দেবার চ্যালেঞ্জ থাকে। ফলে পপুলিস্ট রাজনীতিতে প্রথম প্রজন্মের ধনবান ও শিক্ষিত নেতা ও সমর্থকদের পাওয়া যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের লোকেরা ব্যস্ত থাকে সৃজনশীল কাজে। সেটা যদি ব্যবসা উদ্যোগ হয়; সেখানে সৃজনশীলতা থাকে আনন্দ আহরণের জায়গা। এরা গবেষণা ও উদ্ভাবন করে। কারণ এ ছাড়া সভ্যতার টিকে থাকা মুশকিল। ফলে রক্ষণশীল কিছুটা ধনবান ভোটারদের সন্তানেরা এইসব সৃজনশীল কাজের আকাংক্ষা নিয়ে উদারপন্থী হিসেবে গড়ে উঠছে।

বৃটেনেই আজকের শিশু-কিশোরেরা এতোটাই সাম্যচিন্তা লালন করে যে, তাদের দাদা-দাদী, বাবা-মাকে তাদের প্রথম জীবনের খানিক বিলাসিতার স্মৃতিঘন ছবি এলবাম থেকে সরাতে হচ্ছে। কেউ হয়তো বেড়াতে গিয়েছিলেন, বিমানের বিজনেস ক্লাসে; প্রগলভ হয়ে ছবি তুলেছিলেন; সেগুলো চোখে পড়াতে আজকের শিশু-কিশোর বিরক্ত হচ্ছে, বলছে, তোমাদের আত্মকেন্দ্রিক বিলাসিতায় পৃথিবীতে আজ এতোটা অসাম্য।

পূর্বপুরুষের প্লাস্টিক বর্জ্যে ধরিত্রী নাশের ট্র্যাজেডির মুখে বিক্ষুব্ধ শিশু-কিশোরদের মুখ আমরা মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছি।

কাজেই আজকের পপুলিস্ট রাজনীতিতে রক্ষণশীলতার উত্থান দেখে নিরাশ হয়ে পড়ার কারণ নেই। এখন রাষ্ট্র-ক্ষমতা ও নীতি নির্ধারণে থাকার চেয়ে বড় বিপদ আর নেই। দুঃসাধ্য চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে নিয়ত নতুন-প্রজন্মের সামনে নাস্তানাবুদ হবার জীবন এটা। সেখানে ট্রাম্প ও বরিসের মতো লোকই মানানসই; যাদের কাতুকুতু দিলে; তিন দিন পর হাসি পায়।