পছন্দের প্রার্থীকে সাধারণ সম্পাদক বানাতে স্থগিত সিলেট উপজেলা আ.লীগ কমিটি

নভেম্বর ২৭, ২০১৯
। । টিউলিপ সিদ্দিকের বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হিরন মিয়া । ।

গত ২৫ নভেম্বর ঘোষিত সিলেট সদর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। একপক্ষের দাবি স্থানীয় নেতাকর্মীদের আপত্তির মুখে স্থগিত করা হয়েছে কমিটি। তবে কমিটির নেতারা বলছেন, ঘোষিত কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নানা অভিযোগ তোলা হয়েছে, যা আদৌ সত্য নয়। আর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, স্থগিত করা হয়নি।

জানা গেছে, গত রোববার (২৪ নভেম্বর) সিলেট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলরে প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন সিরাজ, কেন্দ্রীয় সদস্য বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান, জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট লুৎফর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান, জেলার সহসভাপতি ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আশফাক উদ্দিনসহ অন্যান্য নেতারা। প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত সব নেতারাই সমঝোতার মাধ্যমে কমিটি গঠন করার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন। তা মেনে নেন সভায় উপস্থিত কাউন্সিলরসহ স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

কিন্তু কাউন্সিল অধিবেশনে বেঁকে বসেন জলার সহসভাপতি ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আশফাক উদ্দিন। মূলত তার বলয়ের লোকদের নিয়ে পুরো কমিটি গঠনের জন্যই তিনি বিপত্তি শুরু করেন।

সূত্র জানায়, কমিটি গঠন নিয়ে দীর্ঘ দিন থেকেই তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আলোচনা করে আসছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় আশফাক চেয়ারম্যানের গ্রুপ থেকে সভাপতি আর তার বিরোধী পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত নেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। সেই হিসেবেই দ্বিতীয় অধিবেশনে কান্দিগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান  নিজাম উদ্দিন কে সভাপতি আর মোগলগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিরন মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশনে। কিন্তু দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলে কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের দাবি তুলেন আশফাক অনুসারীরা। অথচ গেল ১৪ বছর আগে গঠন করা উপজেলা কমিটিতে অনেকেরই কাউন্সিলর হিসেবে নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও সদর উপজেলার বাসিন্দা হলেও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন সিরাজকেও কাউন্সিলর হিসেবে রাখা হয়নি। কাউন্সিলর তালিকা নিয়ে নানা অসঙ্গতি তুলে কমিটি গঠনের ঘোষণা ছাড়াই স্থান ত্যাগ করেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। পরের দিন প্রেস রিলিজের মাধ্যমে নিজাম চেয়ারম্যানকে সভাপতি আর হিরন মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রেস রিলিজ পাঠায় জেলার নেতারা।

এরপর আরও মরিয়া হয়ে উঠেন আশফাকপন্থীরা। তারা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিরণ মিয়ার বিরুদ্ধে বিএনপি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেন। অথচ অভিযোগকারীদের অন্যতম টুনু মিয়া ২০১১ সালে ইউপি নির্বাচনে বিএনপি-জামাত সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন। এছাড়াও খাদিমপাড়ার কাউন্সিলর তালিকায় ছিলো বিএনপির সমুজ মিয়ার নাম।

সমুজ মিয়া ২০১৪ সালে পুলিশ নির্যাতন ও গাড়ি পোড়ানো মামলার আসামি ছিলেন। এছাড়াও একই পরিবারের আরো ২ থেকে ৩ জনকে কাউন্সিলর করা হয়। তালিকায় নাম আছে কিন্তু ঠিকানা নেই। অভিযোগ উঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমেদের নেতৃত্বে এসব তালিকা করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, গত ১০ বছর ধরে সমুজ মিয়া ইচ্ছে মতো টিআর, কাবিখা, এডিপিসহ উন্নয়নের নানা খাতের বরাদ্দের অর্থ আত্মসাত ও অপব্যবহার করেছেন। উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভায় এর প্রতিবাদ করায় হিরন মিয়ার ওপর তার যত ক্ষোভ।

অভিযোগ রয়েছে, আশফাক চেয়ারম্যান সিটি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম মোমেন এলাকার উন্নয়ন কাজ তিনি নিজেই তদারকি করায় আশফাক আহমদ তার ইচ্ছে মত কাজ করতে পারছেন না। উল্টো উন্নয়ন কাজে বাঁধা দিচ্ছেন। এমনকি উপজেলার মাসিক সভায় তিনি পদত্যাগ করার হুমকি দেন। এছাড়াও সদর উপজেলা ও বিভিন্ন ইউনিয়নে তার বলয়ের লোক দিয়ে কমিটি করেছেন। দীর্ঘদিন থেকে এসব কমিটির কার্যক্রম নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।

এদিকে সদর উপজেলার আওয়ামী লীগের ঘোষিত  কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিরন মিয়া ২০১১ সালে দলীয় সমর্থনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করেছেন। সব শেষ তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে দলীয় প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিজয়ী হন। সূত্র জানায়, তিনি লন্ডনে আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরে গেলে হিরন মিয়া সে সময় সার্বক্ষণিক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী ছিলেন। এছাড়া ২০০১ সালের নির্বাচনের পর লন্ডনে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা সমাবেশে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন হিরন মিয়া। তিনি ২০০৩ সালে বিএনপি বিরোধী সমাবেশে আজকের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও সভা করেন।

সূত্র জানায়, নানারকম অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের প্রেক্ষিতে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটির কার্যক্রমের বিষয়টি এখন দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরে জমা আছে। দু একদিনের মধ্যেই আসতে পারে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগ) আহমদ হোসেন বলেন, ‘সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি সোমবার ঘোষণা করা হলেও এই কমিটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। এবিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।’

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি নেতাকে সিলেট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে, এমন অভিযোগ তোলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। এ কারণেই সদরের কমিটি স্থগিত করা হয়েছে।’

কমিটি নতুন আসবে, নাকি পুরাতন কমিটিকে হালনাগাদ করা হবে এ প্রসংঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনও সিদ্ধান্ত হলে তা জানানো হবে। কমিটির ব্যাপারে আপাতত কোনও সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ ডিসেম্বর। সেজন্য নেতাকর্মীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ব্যস্ত রয়েছেন।’

এদিকে হিরন মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছি। লন্ডনে বসবাস করলেও কোনও সময়ই বিএনপির রাজনীতি করিনি। এই ধরণের কোনো ডকুমেন্টস নেই। আমার রাজনৈতিক সফলতা দেখে একটি মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ দুই যুগ ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তার সপক্ষে অনেক প্রমাণ আছে।