আবুল ও বাতেনের ডানকিনে মাছেদের জীবন

নভেম্বর ২৭, ২০১৯

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ‘বালিশ সরবরাহে’ দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয় বাতেন। তাকে নিয়ে ফেসবুকে ‘লা গোবরিনা ফেস্ট করে ও রগড় করে লায়লাতুন্নিসা। লীলাবতীর সঙ্গে তার ফেসবুক-যুদ্ধে দুটো পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। পর্যবেক্ষকরা দুটো পক্ষকে অনায়াসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের বলে অভিহিত করে। কেউ একধাপ এগিয়ে একে সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তির যুদ্ধ বলে অনুসিদ্ধান্ত দেয়।

বাতেনের জায়গা হয় কারাগারের আমদানি ওয়ার্ডে; আবুল সেখানে তসবিহ জপছিলো।

আবুল ও বাতেন একই গ্রামে বসবাস করে। দুরন্ত শৈশব তাদের। আবুল ধর্মীয় শিক্ষা নিতে থাকে। বাতেন সাধারণ শিক্ষা নেয়। আবুলকে তার মাদ্রাসার শিক্ষক শ্রেণী সংগ্রাম শেখায়। বাতেনকে তার বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত পাড়াত ভাই শ্রেণী সংগ্রাম শেখায়।

আবুল দাড়ি-টুপি-টাকনুর ওপর পাজামায় নিজেকে সুশোভিত করে। আর বাতেন পরে টি-শার্ট ও জিনস পাতলুন। আবুল আবুলই থাকে; গ্রামে থাকে।বাতেন শহরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই নিজের নামের আগে শুভ লাগিয়ে নেয়। শুভ বাতেন নামে সে পরিচিতি পায়।

আবুল চিন্তা করে, জিহাদের মাধ্যমে শারিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার মাঝেই মুক্তির ঠিকানা। অন্যদিকে বাতেন আগে চে গুয়েভারার ছবি অলা টি-শার্ট পরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু দৌড় ঝাঁপ করে পরে মত পালটায়, “উন্নয়নের সরকার; বার বার দরকার” শ্লোগানের আংরাখায়।

মাদ্রাসা শিক্ষক আবুলের কিশোর ব্রেণ ওয়াশ করে, জিহাদের ভ্রান্ত স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। আর পাড়াত বড় ভাই বাতেনের ব্রেণ ওয়াশ করে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো, বিপ্লবের ফ্যাশান প্যারেড করতে করতে ‘সহমত ভাই’ হবার কলাকৌশলগুলো।

একই গ্রামের আবুল আর বাতেন; ভোর বেলা রেললাইনের ধারে কাদা মেখে খালে ডানকিনে মাছ ধরতে ধরতে কত গল্প করতো; আর আজ আবুল একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি; অন্যদিকে বাতেন আধুনিকতার পোস্টার।

শুভ বাতেন সংস্কৃতি মামাদের দেখাদেখি ফেসবুকে শ্রেণী সংগ্রামে জীবন দেয়া নেতা-নেত্রীর ছবি শেয়ার করে। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে উদ্ধৃতি দিতে দিতে ‘বারিস্তায় কফির দাওয়াত’ পেয়ে যায় আধুনিকা লীলাবতীর পক্ষ থেকে।

অন্যদিকে আবুল জিহাদ মামাদের দেখাদেখি ফেসবুকে জিহাদের বার্তা প্রচার করে আর কথায় কথায় হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লায়লাতুন্নিসার মন জয় করে। আত্মঘাতি সন্ত্রাসী হামলার দম্পতি হিসেবে প্রস্তুত হতে থাকে তারা।

আর শুভ বাতেন অসাম্প্রদায়িকতার ম্যাজিক-লন্ঠন হয়ে সরকারি দপ্তরে ‘বালিশ সরবরাহের’ ঠিকাদারি বাগায়। লীলাবতীর সঙ্গে আত্মঘাতি দুর্নীতি-সন্ত্রাসী হামলার দম্পতি হিসেবে প্রস্তুত হতে থাকে।

ফেসবুকে আদর্শ-দম্পতি বাতেন ও লীলাবতী তাদের অকুন্ঠ দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শের কারণে রোল-মডেল হিসেবে অন্যদের আধুনিক হইবার একশোটি উপায় বাতলাতে থাকে।

আবুল আর লায়লাতুন্নিসা অত্যন্ত ধার্মিক ও সহি দম্পতি হিসেবে ফেসবুকে প্রতিষ্ঠা পায়। তাদের দাওয়াতে আকৃষ্ট হতে থাকে অন্যেরা। সহি ধার্মিক হবার একশোটি উপায় জানতে সবাই তাদের কাছে আসে।

বাতেন তার শৈশবের বন্ধু আবুলকে নিয়ে লজ্জিত। সে কথায় কথায় বলে, ছাগুটার সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক নাই। আবুলও তার শৈশবের বন্ধু বাতেনকে নিয়ে লজ্জিত। সে কথায় কথায় বলে, মুরতাদটার সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক নাই।

সাইবার পুলিশের সক্রিয়তায় আবুল গ্রেফতার হয়ে যায়। বাতেন তখন ছ্যা ছ্যা করে; রগড় করে। আবুল গ্রেফতার হয়েছে এই আনন্দে বাতেন তার অনুসারীদের নিয়ে বিরিয়ানি ফেস্ট করে। আবুলের সমালোচনায় ‘লা গোবরিনা ফেস্ট’ চলতে থাকে বাতেন ও লীলাবতীর টাইম লাইনে।

গ্রেফতার হওয়া আবুল তার জামিনের জন্য অনেক কষ্টে মাদ্রাসার সেই ব্রেণ-ওয়াশ করা শিক্ষককে ফোন করে। শিক্ষক বলেন, খাসজমি ও শোকরানা-মেহেফিল পাইয়া আমরা এখন উন্নয়নের সাহাবি। আমি আবুল বইলা কাউরে চিনিনা।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ‘বালিশ সরবরাহে’ দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয় বাতেন। তাকে নিয়ে ফেসবুকে ‘লা গোবরিনা ফেস্ট করে ও রগড় করে লায়লাতুন্নিসা। লীলাবতীর সঙ্গে তার ফেসবুক-যুদ্ধে দুটো পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। পর্যবেক্ষকরা দুটো পক্ষকে অনায়াসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের বলে অভিহিত করে। কেউ একধাপ এগিয়ে একে সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তির যুদ্ধ বলে অনুসিদ্ধান্ত দেয়।

বাতেনের জায়গা হয় কারাগারের আমদানি ওয়ার্ডে; আবুল সেখানে তসবিহ জপছিলো।

বাতেন শৈশবে তার ব্রেণ-ওয়াশ করা পাড়াত ভাইকে অনেক কষ্টে ফোন করে জামিনের ব্যাপারে সাহায্য চায়। পাড়াত ভাই মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছে। আগে মাঝে মাঝে দেশে এসে ‘উন্নয়নের সরকার, বারবার দরকার শ্লোগান দিতো। ক্যাসিনো-কাণ্ডে ধর-পাকড়ের পর সে গা-ঢাকা দিয়েছে। ফলে অপারগতা জানায় বাতেনকে সাহায্য করতে।

মনের দুঃখে বাতেন আর আবুল জেলখানায় শৈশবের ডানকিনে মাছ ধরার খেলা খেলে।