কথায় না কাজে বড় দুর্নীতিনাশ অভিযান

নভেম্বর ২৭, ২০১৯

প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের যে ডাক দিয়েছেন; তাতে আন্তরিকতা আছে; কিন্তু বাস্তবিক পরিকল্পনা ও কর্ম-কৌশল নেই। উনার চোখে ধরা না পড়া পর্যন্ত ঢাকা-শহরে পুলিশের নাকের ডগায় ক্যাসিনো চলেছে, শেয়ার বাজারটি যেমন সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো হিসেবে রয়ে গেছে। কেবল প্রধানমন্ত্রীর চোখে ধরা পড়া অপরাধের বিচার হবে; এ অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। দুর্নীতি ও অপরাধ বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে; ফরেনসিক টেস্টে টাকা-পাচারের প্রমাণ ও যে কোন হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ নির্ভুলভাবে বেরিয়ে আসে।

 

দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের কচ্ছপ গতি আমাদের আহত করে। কারণ আমরা খুব আশাবাদি জাতি। বানের জলে ভেসে চলার সময়ও বানভাসিদের দিকে টিভি ক্যামেরা তাক করলে তারা হাসে। কারণ তার বানভাসি হবার খবরটা সরকার জানলে; ত্রাণের ব্যবস্থা হবে; এমন একটা আশাবাদ তৈরি হয় তার মনে।

ছয় ঘণ্টা লেট করে ট্রেন এলেও ট্রেনে ওঠা মাত্র; সবার মুখে হাসি ফোটে। জ্যামে আট ঘণ্টা আকটে থেকে ছাড়া পেলে এতো ঘণ্টার তিক্ততা মন থেকে উবে যায়। সরকারি দফতরে গিয়ে রুটিন দুর্ব্যবহার শেষে কাজটি হলে জনগণের মুখে হাসি ফুটে। এতোক্ষণের অপমানের কথা ভুলে যায়। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সের দুর্ব্যবহারের মাঝেও জীবন নিয়ে ঘরে ফেরার পথে রোগী হাসে। শিক্ষকদের নিরন্তর অবহেলা শেষে ডিগ্রি নিয়ে ফেরার পথে শিক্ষার্থী হাসে।

রাজনৈতিক ক্যাডারের হুমকিতে ভীত জীবন কাটিয়ে ‘ক্রস-ফায়ারে’ ক্যাডারের মৃত্যু হলে আমরা মিষ্টি বিতরণ করি; আমরা হাসি। প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই আমরা খুশি।

প্রবাসী শ্রমিক বিমানবন্দরে দুর্ব্যবহার-পথে ছিনতাইয়ের ঝুঁকি কাটিয়ে বাড়ি ফিরে স্বজনের সঙ্গে দেখা হবার আনন্দে ভুলে যায় সতত অপমান আর বঞ্চনার কথা।

এই যে আমাদের নিয়ত নির্যাতিত হয়ে ক্রীতদাসের হাসিতে বেঁচে থাকা জীবন; এইখানে আমরা বৃটিশ-পাকিস্তানি ভিনদেশী লুন্ঠকদের লুন্ঠন শেষে নিজদেশের লুন্ঠকদের লুন্ঠনে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বেঁচে আছি। এ-ও আবার বাঁচা; দেশে কাজ না পেয়ে অবৈধ পথে সাগর সাঁতরে উন্নত দেশে যেতে জীবন বিপন্ন করে স্নেহময় গ্রাম কিংবা লোকালয়ের আদরের ছেলেটি।

রোজ সকালে মা ভাত মেখে মুখে দিতো যে আদরের সন্তানের; সে স্বদেশে কর্ম-সংস্থানের অভাবে ভিনদেশে দাস হয়; সেসব দেশের নব্যধনিকদের খাবার টেবিলে খাদ্য-পরিবেশন করে দাঁড়িয়ে থাকে; দেশেও নব্যসাহেবদের আলিশান খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের। গোটা পৃথিবী থেকে দাস প্রথা উড়ে গেলেও যেন দাস সরবরাহের বিশ্বস্ত দেশ হিসেবে রয়ে যাবে বাংলাদেশ।

সৌদি আরবে নারী শ্রমিকদের সম্ভ্রম ও জীবন হানির ট্র্যাজেডি স্পর্শ করে না স্বদেশের নীতি-নির্ধারকদের। কারণ প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো
টাকার রেমিটেন্সে শক্ত হয় ব্যাংক রিজার্ভ। সেই টাকা লুট করে প্রাসাদ গড়ে রাজনীতি-ব্যবসায়ী-ঠিকাদার-সামরিক ও বেসামরিক আমলা, ক্ষমতা কাঠামোর মিডলম্যানেরা। সুতরাং বাঁচুক-মরুক-ধর্ষিত হোক; তবু রেমিটেন্স জুগিয়ে যেতে হবে তাদের।

এই উপায়হীন ও অপরিবর্তনীয় জীবন-মৃত্যুর ফাঁদে আটকে যাওয়া বাংলাদেশের মানুষের অমিত প্রাণ প্রবাহের কোনো তুলনাই হয় না। তবুও কৃষক ফসল ফলায়, শ্রমিক কাজ করে, মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিঃসন্দেহে এই স্বপ্ন প্রতারণা করে; স্বপ্নগুলো লুট হয়ে যায়; সেই স্বপ্ন লুটপাট করে উন্নত দেশে সেকেন্ড হোম বানায় প্রতারকরা।

যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের বিশ্বের জ্ঞান আহরণ করে, গবেষণার মাধ্যমে: যার দেশকে প্রযুক্তি ও পণ্যে, চিন্তায় ও মননে আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল এনে দেবার কথা; সে লুন্ঠকদের দলে নাম লেখাতে দলীয় হেলমেট-হাতুড়ি কিংবা বিসিএস গাইড নিয়ে ঘুরে। জীবনের সাফল্য এখানে জনগণের প্রভু হওয়া; নিজের বাপ-চাচা-ভাইয়ের কাছ থেকে ‘স্যার ডাক শোনা’।

প্রধানমন্ত্রী যখন দুর্নীতি দমনের ডাক দিলেন; মৃত্যু-বিছানায় শুয়ে থাকা জনগণ তখন আশায় বুক বাঁধলো। শিশুরা ছড়া পড়লো, এইবার এইবার খুকু চোখ মেললো। ক্যাসিনো কালচারের উপজাত যুবলীগের কিছু নেতা আর চাঁদাবাজি কালচারের অধঃক্ষেপ ছাত্রলীগের কিছু নেতার শাস্তিদৃশ্যে দর্শকের সে কী হাততালি। কিছু মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির বিচার হবে এমন আশার বাতি জ্বালিয়ে দিলো, খবরের কাগজের কিছু বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশের রূপকথা-প্রতিবেদন। দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রায় পাঁচটি দশক ধরে ব্যর্থ হবার কারণ হিসেবে তোতাপাখির মতো বলে, আমাদের লোকবল বাড়াতে হবে। এই অল্প লোকবলই নির্দোষ মানুষকে জেল খাটিয়ে; দেশময় দুর্নীতি-সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য দিব্যি টিকিয়ে রেখে; অনুতাপহীন এক কমিশন আজো।

প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের যে ডাক দিয়েছেন; তাতে আন্তরিকতা আছে; কিন্তু বাস্তবিক পরিকল্পনা ও কর্ম-কৌশল নেই। উনার চোখে ধরা না পড়া পর্যন্ত ঢাকা-শহরে পুলিশের নাকের ডগায় ক্যাসিনো চলেছে, শেয়ার বাজারটি যেমন সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো হিসেবে রয়ে গেছে। কেবল প্রধানমন্ত্রীর চোখে ধরা পড়া অপরাধের বিচার হবে; এ অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। দুর্নীতি ও অপরাধ বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে; ফরেনসিক টেস্টে টাকা-পাচারের প্রমাণ ও যে কোন হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ নির্ভুলভাবে বেরিয়ে আসে।

কাজেই বাংলাদেশের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে যারা কাজ করছেন, তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা সমসাময়িক কৌশলগুলো শিখতে পেরেছে কীনা তা যাচাই করে দেখতে হবে। নইলে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান, রেটরিক হিসেবে রয়ে যাবে। সাম্প্রতিক দলীয় সভাগুলোতে প্রধানমন্ত্রী সততার যে উপদেশ দেন; এরকম উপদেশ বাংলাদেশের প্রতিটি অভিভাবক সন্তানকে দেন। কিন্তু বাস্তবে কাজ হয় কমই। কারণ পুরো সমাজ ছলে-বলে-কৌশলে ধনী হবার জুয়া-খেলাকেই জীবনের ধ্রুবতারা বানিয়েছে।

আশার ছলনে ভুলে; ক্ষমতার জুয়াড়িদের মোটিভেশনাল স্পিচে বার বার স্বপ্ন দেখানোর ছলের মাঝেও যতটুকু প্রত্যাশা বেঁচে আছে; তা-ও যেন লুট না হয়ে যায়; স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণে। ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হওয়া একটি দুর্নীতি বিরোধী অভিযান প্রয়োজন এক্ষুণি। নইলে আর কোনদিন বাংলাদেশের মানুষ আশাবাদি হতে পারবে না; হারিয়ে ফেলবে স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা।