কী হচ্ছে ঢাকা কমার্স কলেজে?

নভেম্বর ২৫, ২০১৯

পরও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ, উপাধ্যক্ষ নিয়োগে অনিয়ম ও নারী শিক্ষককে যৌন হয়রানির অভিযোগের পর এবার পাঁচ জন সিনিয়র শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা কমার্স কলেজে। রুটিন দায়িত্ব পালনকারী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিজেই অব্যাহতির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন।

টিউটোরিয়াল প্রোগামে গত বছর ১২ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ, অধ্যক্ষ থাকার
অব্যাহতি পাওয়া শিক্ষকরা হচ্ছেন—মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক জাহিদ হোসেন শিকদার, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইলিয়াস, সমাজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বাহার উল্লাহ ভূঁইয়া, ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আবু তালেব এবং হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম শেখ।

ভুক্তভোগী শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘দেশের একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে পুরো ক্ষমতা আর দখলদারিত্বের রাজত্ব কায়েম করে। ১২ কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত চলাকালে বাংলা বিভাগের প্রধান সাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। এই সময়ের মধ্যেই নতুন করে সিনিয়রসহ মোট ৫ জন শিক্ষককে অবৈধভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ইচ্ছমতো চালাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটি। এখানে কী হচ্ছে তা দেখার কেউ নেই।’

এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম চুন্নু বলেন, ‘অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে কোনও সহযোগিতা নেয় না। নিজেরা আয় করেই চলে। অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে গোল্ডেন হ্যান্ডসেক দিয়ে। অর্থ সংকটের কারণে তাদের অব্যাহতি দিলেও নিয়মানুযায়ী যা পাওনা রয়েছে তা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’

তবে গভর্নিং বডির সদস্য অধ্যাপক মিয়া লুৎফার রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে উল্টো প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘আমি কেনও এসব নিয়ে কথা বলবো?’
এদিকে অব্যাহতি পাওয়া শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কলেজের দুই নারী শিক্ষক ও একাধিক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি অভিযোগ ওঠায় প্রতিবাদ ও বিভিন্ন অনিয়মে বাধা দেওয়ার কারণে পাঁচ শিক্ষককে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেওয়া হয়।

অব্যাহতি পাওয়া সহযোগী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল— যারা সিনিয়র শিক্ষক শুধু তাদের অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। আমি হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মোস্ট সিনিয়র হওয়ায় আমি এর শিকার হয়েছি। প্রতিবাদ করার কারণে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হলেও আমি কখনও কোনও প্রতিবাদ করিনি। আর অর্থ সংকটের কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে এটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।’

১২ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মিরপুরের ঢাকা কমার্স কলেজে টিউটোরিয়াল কোচিং প্রোগ্রামের নামে ১২ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সরকারি বাঙলা কলেজের অধ্যক্ষ এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধানকে প্রধান করে দুই সদস্যের কমিটিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই তদন্ত চলাকালেই সিনিয়র শিক্ষকসহ ৫ জনকে অব্যাহতি দিয়েছেন রুটিন দায়িত্ব পাওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।

অধ্যক্ষ থাকতেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ
চলতি বছর জানুয়ারিতে অধ্যক্ষসহ শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এরপর গত জুলাইয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় অধ্যাপক ড. এ এফ এম শফিকুর রহমানকে। তবে নিয়োগের পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট বিধিবিধানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়নি। পরে তাকে রেখেই উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) মো. শফিকুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

অধ্যক্ষ ড. আ ফ ম শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাকে গভর্নিং বডি থেকে বলা হলো হিসাব পারিচালনা করবেন না। তারপর তারা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষর নিয়োগসহ অনেকের নিয়োগেই ফাঁকি রয়েছে।’

উপাধ্যক্ষ নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. শফিকুল ইসলাম ছিলেন উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন)। তার নিয়োগ নিয়েও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির অভিযোগ করেন একজন অভিভাবক। লিখিত অভিযোগে বলা হয়, উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পত্রিকায় কোনও বিজ্ঞাপন না দিয়েই। প্রথমে ২০১৫ সালের ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, পরে ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একইভাবে অন্য একজন উপাধ্যক্ষ (বিজ্ঞান) অবৈধভাবে নিয়োগ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় লিখিত অভিযোগে।

বাংলা বিভাগের প্রধানের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ
কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান সাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে একই কলেজের নারী শিক্ষক ও একাধিক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়ারনির অভিযোগ ওঠে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ওই শিক্ষকের বিচার দাবিতে ২৫ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়েছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এখনও পৌঁছেনি বলে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা গেছে।

প্রতিবেদন করেছেন এস এম আববাস, সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন।