দেশব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী তল্লাশি অভিযান জরুরি

মার্চ ২৬, ২০১৭

মাসকাওয়াথ আহসান || জাতীয় গণহত্যা দিবস ও স্বাধীনতা দিবসকে চ্যালেঞ্জ করে সিলেটে যে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে; তা বাংলাদেশ সমাজের সুস্থ ও ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক বিকাশ না ঘটার কারণেই ঘটেছে।

সাংস্কৃতিক পরিসরে অত্যন্ত দুর্বল মেধা ও ভঙ্গুর আত্মসম্মানবোধের লোকেরা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে থাকার কারণে বাঙালি সংস্কৃতির আলোকায়ন ঘটেনি। সমাজের মনন তৈরিতে অমনোযোগ ও আন্তরিকতার অভাবের কারণেই মাটির সংস্কৃতিকে প্রায় সরিয়ে দিয়ে একটি অপরিচিত সৌদি সংস্কৃতির ভিত্তি পাকাপোক্ত করেছে।

নব্বই-এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিলো; সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিলো; সেখানে জাতীয় দিবসসহ পহেলা বৈশাখ ও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে অনুষ্ঠান হতো; বার্ষিক নাটক হতো; একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানটি গাইতে গাইতে সবাই শহীদ মিনারে যেতো। ঐ সময় স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক নেতৃত্ব বিকশিত হতো; শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ জনমানুষের মাঝে লক্ষ্য করা যেতো।

বাঙালি রেনেসাঁর মূলমন্ত্র ছিলো সাদাসিধে জীবন যাপন; উচ্চতর চিন্তা (সিম্পল লিভিং-হাই থিংকিং)। নব্বই দশক পর্যন্ত বিটিভির নাটকগুলোতে আমরা এই মধ্যবিত্তের দেখা পাই; যা সমাজের অল্পে তুষ্ট মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্বশীল ছিলো। আর এই যে সাংস্কৃতিক চর্চার আবহ; তা ছিলো একটি পরমতসহিষ্ণু সুন্দর চিন্তার সমাজ তৈরির নিরন্তর প্রয়াস।

সাদাসিধে জীবন যাপন; উচ্চতর জীবন যাপনের সুন্দর জীবন দর্শনটি পাল্টে উচ্চতর জীবন যাপন ও বামন চিন্তাকেই ক্রমে বেছে নেয় সমাজ। মধ্যবিত্ত সমাজ দ্রুত উচ্চ মধ্যবিত্ত হবার লোভে পড়িমরি করে উপার্জনের ইঁদুর দৌড়ে শামিল হয়ে যায়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব হারিয়ে যায়। আত্মমর্যাদাহীন ভাঁড় বুদ্ধিবৃত্তিক একটি বৃত্ত তৈরি হয়; যারা পদ-পদবী-পদক-প্লটের লোভে ক্ষমতাকাঠামোর সামনে আত্মসমর্পণ করে রাজ-সাংস্কৃতিক নেতা বনে যায়।

অতীতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে বুদ্ধিজীবী সমাজের একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমীহের সম্পর্ক ছিলো। সেটি হারিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতারা যখন ক্ষমতা কাঠামোর স্তাবক হয়ে পড়েন; সাধারণ মানুষের মাথার ওপর থেকে তখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের ছায়া হারিয়ে যায়।

রাজবুদ্ধিজীবী ও নিও এফলুয়েন্ট সোসাইটির মাঝ থেকে সাম্যভাবনাটি হারিয়ে গেলে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহারের শিকার হতে থাকে কথিত “নব্য ধনিক বা স্বচ্ছল শ্রেণী”র কাছ থেকে। তখন সাধারণ মানুষ মাথার ওপর আবার ছায়া খোঁজে; পেয়েও যায়; সুবিধাপ্রাপ্ত ধনিক মোল্লারা ওয়াজ-নসিহত করে; সুমিষ্ট ব্যবহারাদি করে সাধারণ মানুষের মনও জিতে নেয়। “সাম্য” এনে দেবার ছলনায় ধনিক মোল্লারা তাদের চিন্তার রঙ্গে সমাজ রাঙ্গাতে থাকে; সেটা যে রক্তের রঙ; বিভাজনের মন্ত্র এটা আজ সমাজ খানিকটা টের পেলেও; ইতোমধ্যে এতো মানুষের ব্রেণ ওয়াশ করা হয়েছে কথিত “সাম্য” এনে দেবার জন্য জিহাদের মন্ত্রে যে; বিপুল সংখ্যক নাগরিক সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করে জিহাদই মুক্তির পথ।

এরমধ্যে সমাজের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা সব “স্যার” হয়ে পড়ে; আর মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা “হুজুর” হয়ে পড়ে। স্যারদের বেশীরভাগই বাঙালি সংস্কৃতির শিক্ষা না পাওয়ায়; এক পর্যায়ে হুজুর হয়ে পড়ে। ফলে জিহাদের এপোলজিস্ট বা সমর্থকের সংখ্যা ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যেও বাড়তে থাকে।

মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায় এবং বিশৃংখলভাবে এডহক ভিত্তিতে দলগুলো চলায় তারা জনগণের মনের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে উদাসীন। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র থাকায় ও পশ্চিমা রাজনৈতিক দলের মডেলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দলগুলো পরিচালিত হওয়ায়; এরা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে পরিকল্পনা করে দলীয় কর্মীদের জীবন গড়ার কাজটি করতে থাকে। এতে করে প্রশাসনযন্ত্রে মেধার ভিত্তিতেই ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও জিহাদের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকেরা ঢুকে পড়ে।

অনাদরে দেশজ সংস্কৃতির শক্তি অদৃশ্য হয়ে পড়ে। শাহবাগ থেকে শহীদ মিনারের মধ্যে সীমাবদ্ধ অসংখ্য উপদলে বিভক্ত হয়ে দেশজ সংস্কৃতির চর্চা করতে থাকে কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী। কিংবা টিভিতে বিশেষ বিশেষ দিবসগুলোতে সামান্য দেশজ সংস্কৃতি চর্চা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে দেশজ সংস্কৃতির চর্চাকারীরা নিরন্তর কলহে লিপ্ত। এর বিপরীতে ধর্ম ভিত্তিক সংস্কৃতি চর্চা চলতে থাকে সর্বব্যাপী ও ঐক্যবদ্ধভাবে।

এইভাবে ক্রমশঃ আত্মপরিচয়ের জায়গায় দেশজ সংস্কৃতি হারিয়ে গিয়ে ধর্ম ভিত্তিক সংস্কৃতি জায়গা করে নেয়। এইখানে দেশজ সংস্কৃতি চর্চাকারীদের পাকিস্তান জুজু ও ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি চর্চাকা্রীদের ভারত জুজু সমাজের আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির পথ রুদ্ধ করে। ষড়যন্ত্রসূত্রের মানসিক রোগ নিয়ে কোনো সমাজ কখনোই নিজের ভেতরের সমস্যা সমাধান করতে পারেনি।

রাজনৈতিক দলগুলো বাজার বুঝে ধর্ম-ভিত্তিক সংস্কৃতিকেই তোল্লাই দিতে থাকে। সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে অন্যধর্মের মানুষ থাকবে কেন এই ধোয়া তুলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতারা আজ প্রায় সমান শতাংশে অন্যধর্মের মানুষকে উচ্ছেদ করে তাদের বাড়ি-জমি-সম্পদ সম্ভোগ করছে।

ফলে উগ্র জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেবার জন্য উর্বর এক জমিন হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আরো কাল হয়েছে ক্ষমতাকাঠামোর মোল্লা তোষণ ও জঙ্গিবাদের ব্যাপারে অস্বীকার প্রবণতা। জঙ্গিরা যখন দেখে সরকার তাদের শক্তি লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করে; সরকারের প্রতিপক্ষ তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে; তখন সর্বদলীয় জামাই আদরে জামাত-শিবির যেন জামাতা-শিবির হয়ে ওঠে। নানাদল ফুলের মালা দিয়ে তাদের বরণ করেও নেয়।

ওদিকে সোভিয়েত পতনের পর বাম ভাবনার স্বপ্নভঙ্গে হতাশ বামেদের একাংশ আবার জিহাদকে আদর্শিক সাম্যবাদী আন্দোলন হিসেবে অপব্যাখ্যা করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। অথচ পৃথিবীর যেসব দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে; সেখানে নির্বিচারে নিরাপরাধ মানুষ হত্যা ছাড়া কোনো ইতিবাচক আদর্শ চোখে পড়েনি জঙ্গিগ্রুপগুলোর মাঝে। সামাজিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা এমন ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠেছে যে, সিরিয়া-ইরাক-আফঘানিস্তানের অনেক মানুষকে তারা দেশত্যাগে বাধ্য করেছে; আর পাকিস্তান তো পুড়ছেই। এই দেশগুলোতে জঙ্গিদের বর্বরতা দেখার পরেও বাংলাদেশ সমাজের কেন বোধোদয় হলোনা; ঘুরে ফিরে পা দিলো জঙ্গিদের পাতা ফাঁদে; এ সত্যিই বিস্ময়কর এক ব্যাপার।

এখন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শুধু জঙ্গিবাদ আক্রান্ত সিলেটে মনোযোগ না দিয়ে সারাদেশেই সন্ত্রাসবাদ বিরোধী তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করা জরুরি। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হবার কোনো বিকল্প নেই।

ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসে নানা দেশে একে আদর্শিক সংগ্রাম ভেবে সরকারগুলো ভুল করে সমঝোতা ও সংলাপের চেষ্টা করায় অযথা সময় ক্ষেপন হতে দেখা গেছে। সন্ত্রাসবাদীরা আরো শক্তি সঞ্চয়ের সময় পেয়েছে। অতীতের এইসব অভিজ্ঞতার আলোকে তাই প্রশমন চেষ্টায় সময় নষ্ট না করে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে কঠোর হওয়া অধিক বাস্তব সম্মত বলে মনে হয়।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও ব্লগার

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.