অসাধু কর্মকর্তাদের গ্যারাকলে বন্ধ খাল পুনরুদ্ধারের অনুসন্ধান

ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫

07অসাধু কিছু কর্মকর্তাদের যোগশাজস ও ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের অসহযোগিতায় থমকে আছে রাজধানীর ৪৩টি খাল পুনরুদ্ধারের অনুসন্ধান কাজ।

ফলে তিন বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে বিষয়টি অনুসন্ধান শুরু করলেও কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। রাজধানীর ৪৩টি খালের জমি দখল করে নিয়েছেন ১০ হাজার ৫০০ জন প্রভাবশালী। যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় ওই দখলকাজ সম্পন্ন হয়েছে এমন অভিযোগে ২০১২ সালে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

দুদকের অনুসন্ধান শুরু করার তিন মাসের মাথায় জনস্বার্থে হাইকোর্টে ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের (বর্তমানে ধামরাই কর্মরত) সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম একটি রিট (রিট নং-১০১৯০) আবেদন করেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের স্থাগিতাদেশ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ওই স্থাগিতাদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি পায়। ফলে দুদক থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে ভূমি জরিপ অধিদপ্তর থেকেও ওই রিট নিষ্পত্তিতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে নথিপত্র সংগ্রহ ছাড়া দুদকের অনুসন্ধান কাজের কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা  জানান, রাজধানীর বেশিরভাগ খালই বেদখল অবস্থায় রয়েছে। খাল দখলের সঙ্গে সরকারি দলের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকায় বারবার উদ্ধারের পরও দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। দখলকারীরা অধিকাংশই খালের কাছে থাকা বসবাসকারী বাসিন্দা, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও মাস্তান প্রকৃতির লোকজন। একটি কুচক্র মহলের রিটের বিপরীতে মহামান্য হাইকোর্ট থেকে স্থাগিতাদেশ থাকায় দুদকের অনুসন্ধান কাজ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে কমিশন থেকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টের রিট খারিজ না হলে অনুসন্ধান কাজ এগিয়ে নিতে পারছি না। কুচক্র মহল এসংক্রান্ত সকল নথিপত্র যাতে দুদকে সরবরাহ করতে না হয় সেজন্য অসৎ ‍উদ্দেশ্যে রিট করে অনুসন্ধান কাজ বন্ধ রেখেছে।’

এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘রাজধানীর খাল দখলের বিষয়ে হাইকোর্টে রিট রয়েছে, এটা সত্যি। এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার শুনানিও হয়েছে। তবে সর্বশেষ কী অবস্থা তা না দেখে বলা যাবে না। সম্ভবত হাইকোর্টের স্থাগিতাদেশ বহাল রয়েছে।’

সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের আগস্টে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক উপপরিচালক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু অনুসন্ধান শুরু করার দুই বছর পরেও কোন কূল কিনারা করতে পারেনি এই দল।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, জরিপ অধিদপ্তর থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা ছাড়া কার্যত কোন অগ্রগতি দেখাতে পারেনি অনুসন্ধান কমিটি। এমনকি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি। অনুসন্ধানে গতি আনতে শেষ পর্যন্ত দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে সম্প্রতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক সূত্রে আরো জানা যায়, বায়ান্ন গলির তেপ্পান্ন বাজারের রাজধানী ঢাকায় প্রতিটি বাজার ও গলির সঙ্গে এক সময় ছিল খালের সখ্য। আজ বাজার বা গলিগুলোর সন্ধান পাওয়া গেলেও হারিয়ে গেছে রাজধানী ঢাকার অহংকার অর্ধশতাধিক খাল। এ সব খালের অধিকাংশ জমি ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়েছে। যাদের সংখ্যা ১০ হাজার ৫১৫। এর মধ্যে সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্পও রয়েছে। তবে ৬০ থেকে ৮০ ভাগ জমি ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। খালগুলো উদ্ধার ও পুনঃখনন করা না করার কারণে বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

দুদক সূত্র আরো জানায়, মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে কর্তৃপক্ষ রাজধানীর খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কোনো কোনো খাল দখলমুক্ত করতে অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়ে যায় প্রভাবশালীদের বাঁধার কারণে। আর এর ভেতর দিয়েই প্রতিবছর খাল উদ্ধারের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।

সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরী ও এর আশপাশে বেদখল হওয়া খাল ও জলাশয় দখলকারীদের চিহ্নিত করা এবং ব্যক্তিমালিকানায় খালের জমি রেকর্ড করে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করতে ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের (আইন) নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।

তাদের দেওয়া প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো, মহানগর জরিপের সময় জরিপ কাজে সংশ্লিষ্ট ২১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খালের জমি দখলের কাজে সহায়তা করেছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রক্ষকই ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয় দখলকৃত কোনো কোনো খালের ওপর ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা। তদন্ত রিপোর্টে দখলকারীদের নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য এবং এ কাজে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয়েরও উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এদিকে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, এক সময় রাজধানীতে ৪৪টি খাল ছিল। যার মধ্যে ৩৫টি খাল শুকিয়ে গেছে বা দখল হয়ে গেছে। অন্যদিকে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ঢাকা ওয়াসার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপ অনুসারে খালের সংখ্যা ৩২। বর্তমানে এর ১৯টি আছে শুধু নকশায়, বাস্তবে নেই। বাকি ১৩টি খালের প্রস্থ ১০ ফুটের বেশি নয়। প্রতি বছর মে-জুন মাসে বর্ষা মওসুম শুরুর আগে কোটি টাকা খরচ করে খাল পুনরুদ্ধার এবং অবৈধ দখলমুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

খালগুলো হলো- বাসাবো খাল যা ৬০ ফুট প্রশস্ততার পরিবর্তে রয়েছে ২৫ ফুট, বেগুনবাড়ী খাল, মহাখালী খাল যেখানে ৬০ ফুটের পরিবর্তে রয়েছে ৩০ ফুট, রামচন্দ্রপুর খালে ১১০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৬০ ফুট, দ্বিগুণ খালে ২০০ ফুটের পরিবর্তে আছে ১৫০ ফুট, আবদুল্লাহপুর খালে ১০০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৬৫ ফুট এবং কল্যাণপুর খালে ১২০ ফুটের পরিবর্তে রয়েছে ৬০ ফুট।

এ ছাড়া রয়েছে গুলশান, বনানী, কাটাসুর, ইব্রাহিমপুর, বাউনিয়া, দিয়াবাড়ী, কল্যাণপুর খাল, শাহজাদপুর খাল। এগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও খালগুলো এখন ভূমিদস্যু ও দখলদারদের কারণে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

হারিয়ে যাওয়া খাল সম্পর্কে ওয়াসা সূত্র জানায়, কল্যাণপুর শাখা খাল-গ, বাইশটেকি, হাউজিং, পরিবাগ, রাজারবাগ, হাজারীবাগ, চরকামরাঙ্গীচর, সেগুনবাগিচা, আরামবাগ, গোপীবাগ, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও-বাসাবো, দক্ষিণগাঁও-নজীপাড়া, রাজারবাগ-কান্দিপাড়া, মুতিতোলা, বাউশার, গোবিন্দপুর ও ডুমরি খালের অস্তিত্ব এখন বিলীন।

খালগুলো বেদখল হওয়া বিষয়ে জানা যায়, খিলগাঁও-বাসাবো ডাউনে ক্রসরোড করে জিরানি খাল, সেগুনবাগিচা থেকে মানিকনগর পর্যন্ত ৩ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেগুনবাগিচা খালের অস্তিত্ব এখন দৃশ্যমান হয় না। ধানমন্ডি খালের অস্তিত্ব এখন বিলীন প্রায়। এক দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পরিবাগ খালের অবস্থাও একই রকম। গোপীবাগ খালের ওপর নির্মিত হয়েছে রাস্তা। ভরাট হয়ে গেছে রূপনগর খাল, পলাশনগর বাউনিয়া খাল, কালশী খাল, বাইশটেকি খাল, দুয়ারীপাড়া খাল। এসব খালের ওপর নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানির বিল্ডিং। রামচন্দ্রপুর খালে অপর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা রেখে মোহাম্মদী হাউজিং, বায়তুল আমান হাউজিং ও স্থানীয় বাজারের পশ্চিম দিকে মোট ৪টি রাস্তা বক্স কালভার্ট না দিয়ে পাইপলাইন দিয়ে খালের ওপর রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আরো জানা যায়, সেগুনবাগিচা খালের ওপর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কমলাপুর স্টেডিয়ামের দক্ষিণের সীমানা তৈরি করেছে। মাদারটেক ব্রিজ থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত অপর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা রেখেই নন্দীপাড়া খালের ওপর অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ করা হয়েছে। বনানী ও গুলশান লেকের ওপর দিয়ে তৈরী করা হয়েছে ক্রসরোড। মান্ডা ব্রিজ থেকে নন্দীপাড়া পর্যন্ত প্রায় ২৫ জায়গা নতুন করে দখল হয়ে গেছে। এসব জায়গায় গজিয়ে উঠছে টংঘর, দোকান, টিনের চালা ও বস্তি। সেগুনবাগিচা খালের সঙ্গে যুক্ত আড়াই হাজার ফুট দীর্ঘ গোপীবাগ খাল ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বেগুনবাড়ী খালের ভেতরে গড়ে উঠেছে বিজিএমইএ ভবন।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.