১০৪৩ আত্মঘাতী জঙ্গি সক্রিয়

ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫

02পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের আদলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটছে। বগুড়া ও রাজশাহীর বাগমারায় মসজিদে বোমা হামলাও একই সূত্রে গাঁথা। এই দুটি ঘটনার সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি জড়িত বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে। দেশে জেএমবির ১০৪৩ জন আত্মঘাতী সদস্য সক্রিয় আছে। এদের সবাই বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ওত পেতে আছে সুযোগ বুঝে হামলার পরিকল্পনা নিয়ে। এদের পাশাপাশি জামা’আতুল মুজাহিদীন ও হরকাতুল জিহাদের ৯০১ জন জঙ্গি আসামির তালিকা রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক এবং আদালত থেকে জামিন পাওয়া অন্তত ৭৩ জন আসামি রয়েছে, যারা পলাতক থেকে জঙ্গি থাবা বিস্তৃত করছে দেশে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার মিরপুরে জঙ্গি আস্তানায় ১৬ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বোমা বিস্ফোরকসহ আটকদের এবং আগে আটক অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় আত্মঘাতী জঙ্গিদের ব্যাপারে অনেক তথ্য পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা। ইতিমধ্যে তাঁরা এই আত্মঘাতী সক্রিয় জঙ্গিদের তালিকা তৈরি করেছেন বলে জানা গেছে। এই তালিকায় ১০৪৩ জনের নাম রয়েছে।

এই তালিকায় যাদের নাম আছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন হলো সেলিম হাওলাদার, আবু নাইম, গোপালগঞ্জের মাওলানা আমিরুল ইসলাম, আনিছুর রহমান খোকন, ইউনুছ আলী সরদার, জুলফিকার আলী, রাঙামাটির আবদুল হালিম, সিলেটের আরিফ, আহম্মেদ, নারায়ণগঞ্জের আবদুল আজিজ সৈকত, রবিউল ইসলাম সোহাগ, লক্ষ্মীপুরের নজরুল ইসলাম সুমন, লিয়াকত শেখ, আবদুল আহাদ খান, আমির খান, মাওলানা ওবাইদুর রহমান, আবু নোমান আমানউল্লাহ, রুহুল আমিন, গিয়াস উদ্দিন, মৌলভীবাজারের মারুফ মোহাম্মদ ইউসুফ, ময়মনসিংহের আবদুস সামাদ, মুক্তাগাছার হাতেম আলী, আমিনুল ইসলাম, মাওলানা আমিরুল ইসলাম, আনিরুল ইসলাম ওরফে আনিস, এইচ এম শফিকুল ইসলাম ওরফে শাকির, নুর সাঈদী, টাঈাইলের আবু তাহের প্রমুখ। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি যেসব জঙ্গি ধরা হয়েছে তাদের কাছ থেকে আত্মঘাতী জঙ্গিদের ব্যাপারে নানা রকমের তথ্য পাওয়া গেছে। মিরপুরের বাসা থেকে যাদের ধরা হয়েছে তারা জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত। জঙ্গিরা বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সুধীসমাজের লোকজনকেও টার্গেট করে আছে।

তিনি বলেন, জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশেষ অভিযান শুরু হবে। ইতিমধ্যে র‌্যাব-পুলিশের বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সূত্র জানায়, মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবির ঢাকা অঞ্চলের সামরিক শাখার সেকেন্ড ইন কমান্ড সোহেল রানা ওরফে হিরন ওরফে কামাল ওরফে রায়হান, আবু সাঈদ ওরফে রাসেল ওরফে সালমান, ইলিয়াস ওরফে ওমর ফারুক, মহসিন আলী ওরফে রুবেল ও মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক ওরফে শাকিল ওরফে নজরুল ইসলামকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা গোয়েন্দাদের জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের অনেক আত্মঘাতী সদস্য রয়েছে। তারা নানা বেশে চলাফেরা করে, সাংকেতিক ভাষায় কথাবার্তা বলে। তারা বড় ধরনের হামলা চালিয়ে শক্তি জানান দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা গেছে, আত্মঘাতী জঙ্গিরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। জেএমবির মহিলা ইউনিটও সক্রিয় আছে।

ডিবির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা শুনলে গা শিউরে ওঠে। মিরপুরের আস্তানা থেকে আটক ওই পাঁচ জঙ্গির মধ্যে দুজন আছে আত্মঘাতী সদস্য। তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ আছে। যেসব আত্মঘাতী জঙ্গি আত্মগোপনে আছে তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্প্রতি দেশে যে কয়টি বোমা বা গ্রেনেড হামলা হয়েছে তাতে আমরা আতঙ্কিত। ইসলামকে বিভাজনের চেষ্টা চলছে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে। জঙ্গিরা এখন সুরক্ষিত স্থানে আক্রমণ করছে। কৌশলে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। জঙ্গিদের কঠোর হস্তে দমন করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বড় বিপদ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

তিনি বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলেই রাজনৈতিকভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। এতে করে অপরাধীরা বেশি লাভবান হচ্ছে। রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। যেসব আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করছে তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জঙ্গি কার্যক্রমসহ অন্যান্য অপরাধ রোধ করা যাবে না। বগুড়া ও রাজশাহীতে দুটি মসজিদে যেভাবে হামলা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, এতে পাকিস্তান বা আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের হাত আছে। এসব বিষয় দ্রুত তদন্ত করতে হবে। আত্মঘাতী জঙ্গিদের দ্রুত চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের আওতায় আনতেই হবে। তা না হলে জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জঙ্গিদের নিধন করতে যা যা প্রয়োজন তাই করা হবে। কৌশলে জঙ্গিরা নড়াচড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশের জঙ্গিদের ব্যবহার করছে—এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তবে এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা আত্মঘাতী কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ওই ঘটনায় দুজন অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে একজন মারা গেছে।

’ আরেক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জঙ্গিদের কিভাবে মদদ দেওয়া হয়েছে তা জনগণ দেখেছে। তারা জেএমবিকে উৎসাহ দিয়েছে। জেএমবির মিছিলে পুলিশ পাহারা পর্যন্ত দিয়েছিল। তখন বলা হতো, জেএমবি বলতে কোনো জঙ্গি সংগঠন নেই। তবে আমাদের সময়ে সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আমরা হার্ড লাইনে চলে গিয়েছি।’ কেউ তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলে তাদের রক্ষা করা হবে না বলে তিনি হুঁশিয়ারী উচ্চারন করেন। জঙ্গি আসামির তালিকা : জানা গেছে, সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর ‘জেএমবি সদস্যদের হালনাগাদ তালিকা’ শিরোনামে দেশের সব জেলা পুলিশ এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে তথ্য নেওয়ার পর তা একত্র করে একটি তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকার শুরুতে ক্রমিক, জেলার নাম, আসামির নাম-ঠিকানা, জঙ্গি সংগঠনের নাম, মামলাসংক্রান্ত তথ্য, তদন্ত/বিচারের ফলাফল, কারাগারের নাম ও ঠিকানা, জামিনে অবস্থানরত আসামির অবস্থান, জামিনদারের নাম ও মোবাইল নম্বর এবং সাজা ভোগ ও মুক্তিপ্রাপ্ত আসামিদের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি রয়েছে।

এই তালিকায় দেশের সব জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে জঙ্গি মামলার আসামির সর্বশেষ ক্রমিক পৌঁছেছে ৯০১ পর্যন্ত। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত, জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত, জামিনে গিয়ে পলাতক, সাজা ভোগ শেষে কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত জঙ্গি মামলার আসামিরা কে কোথায় কী করছে সেই তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে চলতি বছরের ২৩ মার্চ নগরের আকবর শাহ থানা, অক্টোবর মাসে কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তারকৃত জেএমবি নেতা ও সদস্যদের নাম নেই তালিকায়। চট্টগ্রামে পুলিশের তালিকাভুক্ত জেএমবি নেতা ফারদিনের বিষয়েও তালিকায় তথ্য নেই। তবে শুরু থেকে পলাতক ফারদিন নামের এই নেতার নাম গত মার্চে আকবর শাহ থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার এরশাদ হোসেন মামুন এবং অক্টোবরে গ্রেপ্তার জঙ্গি সদস্যদের জবানবন্দিতেও পেয়েছে পুলিশ। সেই ফারদিনকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন নগর পুলিশের কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল। জঙ্গি দমনে পুলিশ ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে না—এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি শনিবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জঙ্গি দমনে পুলিশ অবশ্যই আন্তরিক। এ কারণে চট্টগ্রামে একাধিক জঙ্গি গ্রেপ্তার এবং জঙ্গিদের বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে।’ ফারদিন গ্রেপ্তার না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফারদিনকে পুলিশ খুঁজছে।’ তালিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, দেশে ৯০১ জন তালিকাভুক্ত জঙ্গি মামলার আসামির মধ্যে অন্তত ৭৩ জন পলাতক রয়েছে, যাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সালেহীনের নামও রয়েছে। তালিকা বিশ্লেষণ করে অন্তত ১৭২ জন আসামির নাম পাওয়া গেছে, যাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে যাদের দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে সেই তথ্যও রয়েছে তালিকায়। সেখানে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ তাঁদের সহযোগী জঙ্গিদের নাম রয়েছে। এ ছাড়া খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়েও তথ্য আছে তালিকায়। তালিকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি জঙ্গিদের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করতে এবং জঙ্গি মামলার আসামিদের সর্বশেষ অবস্থান বিশ্লেষণ করতেই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পলাতক জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। এ ছাড়া জামিনে থাকা এবং সাজা ভোগের পর যেসব জঙ্গি এখন কারাগারের বাইরে আছে, তারা কে কোথায় কী করছে এবং জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কি না সেই বিষয় তদারকি করা হচ্ছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.