আড়াই লাখ শূন্য পদ!

ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫

02সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে এর মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি অন্যতম। স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য সারা বিশ্বে স্বীকৃত। কৃষির সাফল্য এতটাই ব্যাপক যে চাল আমদানিকারক থেকে বাংলাদেশ এখন রপ্তানিকারক দেশ। নারীশিক্ষার প্রসারেও দেশ আজ মডেল। তবে এসব সাফল্য যে মন্ত্রণালয়গুলোর হাত ধরে এসেছে সেগুলোই ভুগছে জনবলের অভাবে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, শিক্ষকের অভাবে পাঠদান বন্ধ হওয়ার জোগাড়, কৃষি কর্মকর্তার পদও শূন্য। যথাযথ অনুমোদন থাকার পরও এসব পদ পূরণে দৃষ্টিকটুভাবে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সরকারপ্রধান বারবার তাগাদা দিয়েও এসব শূন্য পদ পূরণ করাতে পারছেন না। বেকারের এই দেশে মন্ত্রণালয়গুলোর প্রশাসনিক অদক্ষতায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে বলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

গত ২৬ অক্টোবর মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শূন্য পদের বৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে শূন্য পদ বেড়েছে ২.১১ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৪২ হাজার ৪১২। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা দুই লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৮টিতে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি শূন্য পদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। এর অধীন দপ্তরগুলোতে ২৭ হাজার ৮৩৫টি পদ খালি পড়ে রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরই শূন্য পদ ১৭ হাজার। পাঁচ হাজার করে শূন্য পদ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও সেবা পরিদপ্তরে। এর পরই রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর অধীন বিভিন্ন দপ্তরে শূন্য পদ ২৬ হাজার ৫১৬টি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শূন্য পদ ২২ হাজার ১৬৩টি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১৫ হাজার ৭৮৪, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে ১৩ হাজার ৩৮৬ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে শূন্য পদ ১১ হাজার ৯৬৪টি। এ ছাড়া ১০ হাজারের বেশি পদ খালি কৃষি মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।

সাতটি জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ চলছে। এরই মধ্যে লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মৌখিক পরীক্ষা কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে। চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর বাধ্য হয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে সাবধান করেছে।

এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থ দিয়ে বা তদবিরে চাকরি পাওয়ার সামান্যতম সুযোগ কারো নেই। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফল ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে বুয়েট কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করা হচ্ছে। যে জেলায় পরীক্ষা হচ্ছে, সে জেলার ডিসিসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষেরও আগে প্রশ্নপত্র পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ পরীক্ষার দিন সকাল ৮টার দিকে প্রশ্নের সফট কপি সংশ্লিষ্ট জেলায় পাঠানো হয়। সেই কপি তাত্ক্ষণিকভাবে পূর্বনির্ধারিত ছাপাখানায় নিয়ে ছাপিয়ে পরীক্ষার হলে সরবরাহ করা হয়। এর পরও প্রতারকচক্র থেমে নেই। তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একজন প্রতারক ১০ জনের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। এই ১০ জনের মধ্যে তিনজনের চাকরি এমনিতেই হচ্ছে। প্রতারক যদি বাকি সাতজনের টাকা ফেরতও দেয় তাহলেও তার আয় ভালো থাকে। কারণ যে তিনজনের চাকরি এমনিতেই হয়েছে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সে হয়তো দুই লাখ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

প্রায় পাঁচ বছর ধরেই শূন্য পদের তালিকার শীর্ষে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নানা উদ্যোগের পরও এসব পদ পূরণ করা যাচ্ছে না। গত মাসে নার্সদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৬ বছর করা হয়েছে। এর আগেও ২০১২ সালে তাঁদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু সংকট কাটেনি। তাই বারবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে বয়সসীমা বাড়ানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এভাবে নার্সদের চাকরিতে প্রবেশের বিদ্যমান সংকট দূর হবে না। মন্ত্রিসভা একবার বিশেষ বিবেচনায় বয়সসীমা ৩৬ করতে পারে। কিন্তু বারবার করলে সংকট আরো দানা বাঁধবে। এখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা রয়েছে। শুধু নার্স নয়, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে জনবল সংকট প্রকট। চিকিৎসকের পদ যেমন শূন্য, তেমনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদও খালি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বাসুদেব গাঙ্গুলী  বলেন, সারা দেশে হাসপাতালের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে নতুন নতুন হাসপাতাল হচ্ছে। ৩০ বেডের হাসপাতাল হয়ে গেছে ৫০ বেডের, এক শ বেডেরটা আড়াই শ বেডের। আড়াই শ বেডেরটা হয়ে যাচ্ছে বিশেষায়িত হাসপাতাল। নতুন হাসপাতাল মানেই আরো পদ সৃষ্টি। তবে এসব পদে লোক নিয়োগ সহজ কাজ নয়। এ কারণে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে।

সম্প্রতি মন্ত্রিসভা নার্সদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৬ বছর করেছে। যেখানে বিসিএসসহ সব নিয়োগে বয়সসীমা ৩০ বছর, সেখানে নার্সদের জন্য কেন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হলো—এ প্রশ্নের জবাবে বাসুদেব গাঙ্গুলী বলেন, নার্স নিয়োগে আগে থেকেই একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়োগ হয় ব্যাচভিত্তিক। দেখা যায়, ২০তম ব্যাচ পাস করে বসে আছে, আর নিয়োগ হচ্ছে কেবল ১৩তম ব্যাচের।

ভূমি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে জনবল সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সংশ্লিষ্ট পদে লোক না থাকায় নিম্ন পদের কর্মকর্তারা উচ্চতর পদের দায়িত্ব পালন করছেন। সাধারণ মানুষ যখন জরুরি কাজে ভূমি অফিসে যায় তখন বলা হয়, একা চারজনের কাজ করছি। এই দোহাই দিয়ে তাঁরা অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা  জানান, জনবল নিয়োগের আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। একটি পদে নিয়োগের জন্য অনুমোদন চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঁচবার ফাইল পাঠানো হয়েছে। প্রতিবারই নানা ধরনের তথ্য চেয়ে ফাইল ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া মামলার কারণে কানুনগো, সাব এসও এবং এএসও নিয়োগ দিতে পারছে না ভূমি মন্ত্রণালয়। ভূমি প্রশাসনের অনুমোদিত জনবল হচ্ছে সাত হাজার ৬৩২টি। এর মধ্যে চার হাজার ২৫০টিই শূন্য। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ (ভূরেজ) অধিদপ্তরের আওতায় জোনাল সেটলমেন্ট অফিসারের ১৯টি পদের মধ্যে ১৩টিতে জনবল আছে। বাকিগুলো শূন্য। চার্জ অফিসারের ৩৫টি পদের মধ্যে সাতটিতে অফিসার কাজ করছেন। ২৮টি পদে কোনো জনবল নেই। সদর সহকারী সেটলমেন্ট অফিসারের ১০টি পদের একটিতেও কাজ করার লোক নেই।

১৯৭১ সালের পর জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাদ্য উত্পাদন। কৃষিবিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণা আর কর্মকর্তাদের নিবিড় তদারকিতে এ সাফল্য। যেসব কৃষিবিজ্ঞানী ও কর্মকর্তার হাত ধরে এ সাফল্য সেসব পদের অনেকগুলোই এখন শূন্য। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জানিয়েছেন, একসঙ্গে কয়েকটি ব্যাচের কর্মকর্তারা অবসরে চলে গেছেন। নিচের দিকেও কিছু পদ খালি হয়েছে। শিগগিরই এসব পদে লোক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। একসঙ্গে কয়েক হাজার পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর সহায়তা নেওয়া হবে।

সরকারের শূন্য পদ পূরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাগিদ দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় মন্ত্রিসভা বৈঠকে শূন্য পদে লোক নিয়োগ নিয়ে তিনি তাঁর অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদসচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের সচিব কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, সরকারের একটি পদ সৃজন করতে সর্বোচ্চ এক হাজার ছয় দিন সময় লাগে। শূন্য পদ পূরণে আরো লাগে এক হাজার ৯৫ দিন। চূড়ান্ত নিয়োগ দিতে মোট লাগে দুই হাজার ৬০১ দিন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠাল, তাদের সময় লাগে ৩৬৫ দিন। আর এ-সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদন দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সময় নেয় ৫৪০ দিন।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার  বলেন, ‘সরকারি পদ সৃজন হয় প্রয়োজনের তাগিদে। সেই পদ কেন পূরণ হবে না? অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কেন নিয়োগ আটকে থাকে তা আমলে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়।’

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.