আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস , বুদ্ধিজীবী কিলিং মিশনে ছিল খুনে আলবদর বাহিনী

ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫

5সেই ভয়াল দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে দেলোয়ার হোসেনের চাহনিতে ছিল ভয় আর আতঙ্ক। কান্নার দমকে বারবার থেমে যাচ্ছিল কণ্ঠ। কাঁদতে কাঁদতে ৭০ বছরের দেলোয়ার হোসেন বর্ণনা দেন, কীভাবে আলবদরদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, কীভাবে বাঁচার আকুতি ঝরেছিল সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের কণ্ঠে।
৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলোয়ার হোসেন দিয়েছিলেন সেই বর্ণনা। এর আগেও বহুবার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকারে বলেছেন এসব কথা। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার অনেক সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে চাকরিজীবী দেলোয়ারকেও চোখ-হাত বেঁধে বাসা থেকে ধরে মোহাম্মদপুরের সদর দপ্তরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। এরপর অন্যদের সঙ্গে তাঁকেও হত্যার জন্য নিয়ে যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। তবে তিনিই একমাত্র ভাগ্যবান, যিনি পালিয়ে আসতে পেরেছেন আলবদরদের হাত থেকে। রায়েরবাজারের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীও শুধু তিনি।
বাঙালি জাতিকে ধ্বংস ও মেধাশূন্য করার মহাপরিকল্পনার শেষ অধ্যায় ছিল ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী নিধন। দেলোয়ার হোসেনের সাক্ষ্যে এটা স্পষ্ট, একাত্তরের ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী নিধনের ‘কিলিং মিশন’ বাস্তবায়ন করে খুনে আলবদর বাহিনী। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে গত ২১ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টার পর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে ওই সময়ের আলবদর নেতা, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের।
নৃশংস আলবদর বাহিনী: সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে বলা হয়েছে, জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী গঠন করে।
পাকিস্তানি গবেষক ও লেখক সেলিম মনসুর খালেদ তাঁর আলবদর বইয়ে একাত্তরে আলবদর গঠনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। ওই বই উদ্ধৃত করে মুজাহিদের আপিলের রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, একাত্তরে মেজর জেনারেল আবদুর রহীমের সঙ্গে ঢাকার ছাত্র সংঘের নেতারা দেখা করে আলবদরের বিষয়ে কথা বলেন। জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে কথা বলে আবদুর রহীম আলবদরের বিষয়টি চূড়ান্ত করেন, একই সঙ্গে লে. কর্নেল আহসানুল্লাহকে আলবদর গঠনের ব্যাপারে প্রাথমিক নির্দেশনা দেন। ঢাকায় আলবদরের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিগেডিয়ার বশীরকে। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়, জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডেস্কে পাওয়া নথিগুলোর মধ্যে আলবদর-সম্পর্কিত একাধিক গুপ্ত নথি পাওয়া গেছে।
রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের মেজর রিয়াদ হোসেন মালিক একাত্তরে শেরপুর এলাকায় দায়িত্বে ছিলেন। একাত্তরের ১৬ মে তিনি ছাত্র সংঘের ৪৭ জন সদস্যকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। ২১ মে তিনি ছাত্র সংঘের ওই সদস্যদের ‘আলবদর’ নামকরণ করেন। একাত্তরের শেষ দিকে ছাত্র সংঘের সদস্যদের ৭ থেকে ১২ দিনের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে সারা বাংলাদেশে আলবদর বাহিনী ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
আলবদরের সদর দপ্তর: আপিল বিভাগ ও ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে বলা হয়েছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে (একাত্তরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) স্থাপন করা হয়েছিল আলবদর বাহিনীর সদর দপ্তর। একাত্তরের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজাকার বাহিনীর প্রধান ও শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ কর্মকর্তাকে নিয়ে জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে রাজাকার ও আলবদর শিবির পরিদর্শন করেন। বর্তমানে জামায়াতের আমির, ওই সময়ে নিখিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি নিজামী, মুজাহিদরা সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগকে আলবদররা চোখ বেঁধে কাদামাখা গাড়িতে তুলে প্রথমে এখানে নিয়ে আসে। সেখানে নির্মম নির্যাতনের পর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হতো পাশের রায়েরবাজার অথবা মিরপুরের বধ্যভূমিতে। সেখানেই তাঁদের হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হতো। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম, টিভি ও রেডিওর প্রতিনিধিরা মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে গিয়ে কয়েকটি কক্ষে রক্তের স্রোতোধারা দেখেন। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রগুলো। একাত্তরের ডিসেম্বরে ওই কলেজটিকে এক হত্যাপুরীতে পরিণত করেছিল ঘৃণ্য আলবদররা।
মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চন্দ্র দাস ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সংগ্রহশালার পরিদর্শক। কয়েক দিন আগে অবসরে গেছেন তিনি। এরপরও বুদ্ধিজীবী দিবসের আগের দিন গতকাল দুপুরে তাঁকে দেখা গেল ডাকসু সংগ্রহশালায় রাখা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবিগুলো পরিষ্কার করতে l হাসান রাজাআলবদর বইটি উদ্ধৃত করে মুজাহিদের রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার এক প্রান্তে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যখন পাকিস্তানি দখলদারেরা আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ঢাকার আরেক প্রান্তে আলবদরদের সদর দপ্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন মুজাহিদ। বাংলাদেশের বিজয় দিবসকে এক ‘বেদনাদায়ক দিন’ ও পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণকে ‘ট্র্যাজেডি’ উল্লেখ করে সেদিন মুজাহিদ বলেন, ‘আমরা বিগত দিনগুলোর জন্য লজ্জিত নই। আর সামনের দিনগুলোর জন্য নিরাশও নই।…বন্ধুরা! আমি বাধ্য হয়ে আদেশ দিচ্ছি, আপনারা হিজরতে বের হয়ে যান।’ এরপর আলবদর সদস্যরা সদর দপ্তর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
ভয়ংকর দুই ঘাতক: চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন ভয়ংকর দুই আলবদর। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, বুদ্ধিজীবী কিলিং মিশনের অপারেশন ইনচার্জ ছিলেন চৌধুরী মুঈনুদ্দীন, আর আশরাফুজ্জামান ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের একটি ডায়েরি পাওয়া যায়, তাতে ১৯ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। পাকিস্তানি লেখক ও গবেষক সেলিম মনসুর খালেদের কাছেও আশরাফুজ্জামান তাঁর ডায়েরি লেখার কথা স্বীকার করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই মুঈনুদ্দীন পালিয়ে যান যুক্তরাজ্যে, আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ভয়ংকর এই দুই খুনিকে এখনো দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকরের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি সরকার।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.