চার দশকে মৌলবাদীদের মুনাফা ২ লাখ কোটি টাকা

ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫

2গত ৪০ বছরে (১৯৭৫-২০১৪) মৌলবাদের অর্থনীতির ক্রমপুঞ্জীভূত নিট মুনাফার পরিমাণ হবে কমপক্ষে দুই লাখ কোটি টাকা। মৌলবাদীদের বিভিন্ন বিনিয়োগ থেকে প্রতিবছর নিট মুনাফা হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। গতকাল শনিবার এক সেমিনারে এ তথ্য তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এ সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এতে সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী। ‘বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও জঙ্গিবাদ : মর্মার্থ ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে আবুল বারকাত বলেন, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা উগ্র রূপ ধারণ করেছে। এ সাম্প্রদায়িকতা অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ উভয় শক্তির মাধ্যমে ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতাভিত্তিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’কে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করে সুসংগঠিত জঙ্গি কার্যক্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে উদ্যত। ড. বারকাত আরো বলেন, মূলধারার রাষ্ট্রের মধ্যে তারা (মৌলবাদীরা) সৃষ্টি করেছে আরেকটি রাষ্ট্র। মূলধারার সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার। মূলধারার অর্থনীতির মধ্যে আরেকটি অর্থনীতি, যাকে বলা হচ্ছে মৌলবাদের অর্থনীতি। ২০১৪ সালে এই মৌলবাদের অর্থনীতির খাত-প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বার্ষিক নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা।

এ তথ্য তাঁর এক প্রবন্ধে আগেই প্রকাশিত হয়েছে। গতকালের বক্তৃতায় নিজের সেই প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়েই এ তথ্য তুলে ধরেন বারকাত। তাঁর মতে, এ আয়ের সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ আসছে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। পর্যায়ক্রমে বেসরকারি সংস্থা, ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন থেকে আসছে ১৮.৮ শতাংশ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০.৮ শতাংশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৯.২ শতাংশ, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা থেকে ৮.৫ শতাংশ, সংবাদমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি থেকে ৭.৮ শতাংশ এবং পরিবহন যোগাযোগ থেকে ৭.৫ শতাংশ। আবুল বারকাত বলেন, ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও মৌলবাদী জঙ্গিত্ব সব ধরনের সভ্য আচরণের মাত্রা অতিক্রম করেছে। এদের রুখতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত মৌলবাদী জঙ্গিদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। জঙ্গি অর্থায়নের উৎস সম্পর্কে সরকার যা জানে, অতি দ্রুত গণমাধ্যমে তা প্রচার করে এদের রুখতে হবে। এ জন্য তৃতীয়পক্ষীয় অডিটের মাধ্যমে জামায়াত-জঙ্গি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে সম্পদ বাজেয়াপ্ত, আইনি হস্তান্তর, ব্যবস্থাপনা ও পর্ষদে পরিবর্তন আনার সুপারিশ তুলে ধরেন তিনি।

ড. বারকাতের প্রস্তাব, বাজেয়াপ্ত করা সব সম্পদ মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ও পঙ্গুত্ববরণকারী পরিবার এবং পরবর্তী সময়ে জঙ্গিদের হামলায় নিহত ও আহতদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। আর সরকারের মধ্যেও অনেক জঙ্গি ‘প্রমোটর’ রয়েছে। এদের চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ ছাড়া সবার অংশগ্রহণে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানান এ অর্থনীতিবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপকের মতে, ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও মৌলবাদী জঙ্গিত্বের মদদ দিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্র, যার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ব্রিটেনের এমপি লর্ড কার্লাইলের অবস্থান। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এরাসহ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থা রক্ষার চেষ্টা করেছে। ট্রাইব্যুনাল ও বিচারকাজ ঠিক হয়নি বলে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে তারা। মৌলবাদী জঙ্গিদের অর্থায়নের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি মানবতাবিরোধী অপরাধী মীর কাসেম আলী বাঁচার জন্য ওয়াশিংটনভিত্তিক লবিস্ট ফার্মকে তিন দফায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি দিয়েছেন।

এদের রুখতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত মৌলবাদী জঙ্গিদের গডফাদারদের আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিচার শেষ করে শাস্তি কার্যকর করতে হবে। বারকাত বলেন, অনেকেই মনে করেন জঙ্গি ধর্মীয় গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড পরিচালনার সব অর্থ বিদেশ থেকে পেয়ে থাকে। তবে এ ধারণা অনেকাংশে সঠিক নয়। কেননা মৌলবাদ ইতিমধ্যে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক শক্ত ভিত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বাহক শক্তিটি মুক্তিযুদ্ধে জনগণের সম্পদ হরিলুট করেছে। আশির দশকে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ সরবরাহ পেয়েছে, যা তারা আর্থ-রাজনৈতিক মডেল গঠনে বিনিয়োগ করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ মুনাফা আসছে। এ মুনাফার এক অংশ ব্যয় করছে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে, একাংশ প্রতিষ্ঠান প্রসারে আর একাংশ নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে। ড. বারকাত বলেন, মূলধারার অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ হলেও মৌলবাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১০ শতাংশ হারে। ফলে একটি সময়ে মৌলবাদের অর্থনীতি মূল অর্থনীতিকে খেয়ে ফেলতে পারে।

দেশের মোট বার্ষিক জাতীয় বিনিয়োগের ১.০২ শতাংশ রয়েছে মৌলবাদীদের কাছে। আর বেসরকারি বিনিয়োগের ১.৩১ শতাংশ বা সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের ২.১ শতাংশ বা বার্ষিক রপ্তানি আয়ের ১.৫৪ শতাংশ বা বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের ৫.৫৮ শতাংশ অথবা বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের অভ্যন্তরীণ সম্পদের ৮.৬২ শতাংশের সমপরিমাণ রয়েছে তাদের হাতে। আবুল বারকাত বলেন, গত ৪০ বছরে বিভিন্ন মানদণ্ডে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটি থেকে বেড়ে ১০ কোটি হয়েছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। দরিদ্ররা দরিদ্রই থাকছেন। সব সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে কিছু মানুষের কাছে। গত চার দশকে সরকারিভাবে যে আড়াই লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে তার ৭৫ শতাংশ লুট করেছে দুই লাখ দুর্বৃত্ত। এরা এখন বছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা সমপরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি করে। এরাই বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত। এসব ব্যক্তি বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঘুষ দুর্নীতি করে, ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি, দেশের এক কোটি বিঘা খাসজমি ও জলাভূমি অবৈধভাবে দখলে রেখেছে এরা।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.